শহিদ শব্দটি অর্থগত ভাবেই নিরপেক্ষ নয়। এক পক্ষের শহিদ অন্য পক্ষের শত্রু, নিদেনপক্ষে অ-মিত্রসুলভ— নিতান্ত সাধারণ বুদ্ধির কথা। তৃণমূল কংগ্রেস দৃষ্টান্ত, শহিদ হতে পারে রাজনৈতিক দলভিত্তিক। বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী দৃষ্টান্ত, শহিদ হতে পারে আদর্শভিত্তিক, রাজনৈতিক পন্থাভিত্তিক। দেশ বা গোষ্ঠীর ভিত্তিতেও শহিদ হতে পারে। সুতরাং কে কোন শহিদকে মান্য করছেন, তা নিয়ে খবরদারি করা গণতান্ত্রিক রীতিসম্মত নয়। তদুপরি, কাউকে শহিদ মানার দায়ে কোনও রাজ্যের জননির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে হেনস্তা করা তো গণতান্ত্রিক নয়-ই। তবে গণতন্ত্রের এই সব গোড়ার কথাই বর্তমান ভারতে অপ্রাসঙ্গিক, ফলত কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাকে শহিদ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের সময় বলপ্রয়োগ করে আটকানো হল। লেফটেন্যান্ট গভর্নরের নির্দেশে, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদনে তাঁকে রীতিমতো হেনস্তা করা হল। ওমর আবদুল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ১৩ জুলাই কাশ্মীর উপত্যকার শহিদ দিবসে কাশ্মীরের প্রায় সকল নেতৃত্বকে সে দিন গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল, তবুও তিনি নকশবন্দ সাহাব সমাধিস্থলে শহিদদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে গিয়েছিলেন। কেন্দ্রশাসিত উপত্যকায় শাসন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার মূল ভার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের উপর ন্যস্ত। তবে পাশাপাশি নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীরও কিছু অধিকার ও দায়িত্ব থাকার কথা। অথচ দুই পক্ষেরই জেদাজেদিতে সে দিন যে পরিস্থিতির উদ্ভব হল, তাতে কেবল গণতান্ত্রিক দেশের সম্মানহানি হল না, খানিক অকারণেই হয়তো বড় বিপদের মেঘও ঘনাতে শুরু করল।
কাশ্মীর উপত্যকায় শহিদদের স্মৃতি ও সম্মান একটি অতি সংবেদনশীল বিষয়। একটি বিশেষ দিনে শান্তিপূর্ণ ভাবে সম্মান প্রদর্শনের সেই রীতিকে দমিয়ে রাখা সাময়িক পন্থা হিসাবে সফল হলেও দীর্ঘমেয়াদে তাতে বৃহত্তর সঙ্কট উপস্থিত হওয়া অসম্ভব নয়। রাজ্যের নেতার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন জনতার ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। কেন্দ্রীয় শাসকের তরফে এই কাণ্ডজ্ঞানের কথাগুলি মনে রাখা জরুরি। কাশ্মীরে স্বশাসনের দাবিদাররাই হোক, আর উপত্যকার ধর্মভীরু আইনমান্যকারী সাধারণ মানুষই হোক, আঞ্চলিক শহিদদের সম্মান ধ্বস্ত হওয়ার বার্তা ছড়ালে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। ৩৭০ ধারা বিলোপ পরবর্তী কালে উপত্যকার পরিবেশ ‘স্বাভাবিক’ ও ‘শান্ত’ ইত্যাদি লাগাতার প্রচার যে অনেকাংশে ফাঁপা, সাম্প্রতিক পহেলগাম সন্ত্রাস তা বুঝিয়ে দিয়েছে। তবু এখনও উপত্যকার সাধারণ মানুষ শান্তিপ্রিয়, তাও বোঝা গিয়েছে পহেলগাম-উত্তর সময়ে। এই সময়ে প্রশাসনের অসতর্ক পদক্ষেপে অতিরিক্ত দমনপীড়ন, শহিদের অসম্মান, সম্মানিত নেতার হেনস্তা ইত্যাদি বিষয়ে আর একটু সংবেদনশীলতা প্রত্যাশিত ও বাঞ্ছনীয়।
সম্মানের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতির বিষয়টিও। রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিটি ক্রমশই উপত্যকার জনসমাজে জোরালো হয়ে উঠছে। ওমর আবদুল্লা মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, এ কোনও নতুন দাবি নয়, সাম্প্রতিক অতীতে সংসদের বাইরে, ভিতরে, আদালতে, বারংবার কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে— ফলে কাশ্মীরি জনসমাজের এই দাবি পূরণ করা এখন কেন্দ্রের কর্তব্য। সম্প্রতি সেই দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে বিরোধী পক্ষ থেকে রাহুল গান্ধী ও মল্লিকার্জুন খড়্গে প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে এ বিষয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেছেন। তাতে লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী বিশেষ সাংবিধানিক নিরাপত্তা দানের বিষয়টিও আলাদা গুরুত্বে উল্লিখিত হয়েছে। তবে রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতিরও আগে আসে কাশ্মীরিয়তের প্রতি সম্মান। কেন্দ্রীয় প্রশাসন যদি এখনও না বোঝে যে স্থানীয় জনসমাজের সহযোগিতার বিষয়টিকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে কাশ্মীরের শান্তি ফেরানো অসম্ভব, তা হলে ভারতের কাশ্মীর ক্ষত নিরাময়ের কোনও সম্ভাবনাই তৈরি হতে পারে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)