Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus Lockdown

মন-বন্দি

এই উদ্বেগ শুরু হইয়াছিল তাহার স্থান হইতে স্থানান্তরে অবাধ যাতায়াতে বিমূঢ় বিরতিতে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২১ ০৪:৫৯
Share: Save:

সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিদরা বলিয়া থাকেন, দিনের শেষে মানুষ ভাল থাকিতে, শান্তিতে থাকিতে চায়। একক ভাবে, প্রিয়জনদের লইয়াও। ভারতে লকডাউনের বর্ষপূর্তিতে ফিরিয়া দেখিতে গেলে মনে হয়, এই একটি বৎসরে তাহার মানসিক শান্তি ও স্থিতি তলানিতে যাইবার জোগাড় হইতেছিল। ভারতের নাগরিক ইতিহাসের পাতায় মহামারি পড়িয়াছে, চোখের সামনে অতিমারি কোনও দিন দেখে নাই। সর্বগ্রাসী একটি রোগ তাহার বাড়ি, পাড়া, অঞ্চল, রাজ্য ডিঙাইয়া দেশে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, আর সেই রোগের আতঙ্ক বিশ্বের দখল নিয়াছে, এহেন চিত্র সে এত কাল কল্পবিজ্ঞানের বইয়ে বা চলচ্চিত্রের পর্দায় দেখিয়াছে, বাস্তবে দেখিবে ভাবে নাই। গত এক বৎসরে তাই মূর্তিমান ভয়ঙ্কর আসিয়া তাহার সামনে দাঁড়াইয়াছিল, সঙ্গে লইয়া আসিয়াছিল মৃত্যুভয়, অনিশ্চয়তার আতঙ্ক। তাহা কমিয়াছে বটে, নির্মূল হয় নাই। কিন্তু এই একটি বৎসরের দুঃসহ স্মৃতি তাহার আজীবন স্মরণে থাকিবে।

মনে পড়িবে, দমবন্ধ উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার সহিত প্রতিটি মুহূর্ত যাপনের কথা। এই উদ্বেগ শুরু হইয়াছিল তাহার স্থান হইতে স্থানান্তরে অবাধ যাতায়াতে বিমূঢ় বিরতিতে। জনহীন রাস্তাঘাট, ঝাঁপবন্ধ দোকান-বাজার, অর্গলিত কর্মক্ষেত্র ও বিনোদন পরিসর তাহাকে আনিয়া ফেলিয়াছিল বাধ্যতামূলক গৃহবন্দিত্বে, গৃহশান্তিতে নহে। ঘর ও বাহির পরস্পরের পরিপূরক, বাহিরের উদ্বেগ ঘরে ঢুকিয়া আসিলে শান্তি থাকে না। শারীরিক ও সামাজিক নৈকট্য বন্ধ হইয়া জীবনে তৈরি হইয়াছিল এক মানসিক ঘেরাটোপ। ঘরেও অন্তহীন উদ্বেগ, কোভিড-সংক্রমণের ভয়ে পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের অতিনিয়ন্ত্রণ প্রভাব ফেলিয়াছিল বাড়ির পরিবেশে। বিস্তর বিধিনিষেধ ও ঔষধ-তাড়িত গতানুগতিক জীবনে এক ঝলক খোলা হাওয়া যেইটুকু, দিনশেষে পাড়ার চা-দোকানে বসিয়া দুই দণ্ড মন খুলিবার সেই অবকাশও অতিমারি হরণ করিয়াছিল। শিশু-কিশোরদের জন্যও এই একটি বৎসর সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। স্বভাবগত চঞ্চলতা ও বহির্মুখী প্রবণতাকে দমাইয়া রাখা তাহাদের পক্ষে অস্বাভাবিক, মা-বাবাকে কাছে পাইলেই অভাব মিটে না। দৈনন্দিন স্বাভাবিকতার সামান্য ব্যত্যয় মানিয়া লইতেই ছোটদের বিস্তর অসুবিধা হয়, সেখানে স্কুলহীন, বন্ধুসঙ্গহীন জীবন হইয়া উঠিয়াছিল দুঃসহ। লকডাউনে বহু মানুষ বাড়ি হইতে দূরে আটকাইয়া পড়িয়াছিলেন, দীর্ঘকাল প্রিয়জনের নিকট ফিরিতে পারেন নাই। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের অসহায়তার শেষ ছিল না। বহু মানুষ এমনিতেই একা থাকেন, তাঁহারা মানসিক ভাবে আরও একাকী হইয়া পড়িয়াছিলেন। অনিশ্চয়তা, উদ্বেগের উপর এই একাকিত্বের ভার জীবনে আনিয়াছিল এক দুর্বহ অবসাদ। লকডাউন বুঝাইয়া দিয়াছিল, অতিমারিতে শুধু শরীর নয়, মনও সংক্রমিত, আক্রান্ত।

শিক্ষা, কর্ম, চাকুরি, উপার্জন, বহুবিধ পণ্য ও পরিষেবার উপভোগ— জীবনের শান্তি ও স্থিতির পশ্চাতে এগুলির অবদান অপরিহার্য। লকডাউনে এই সমস্তই বন্ধ বা বিঘ্নিত হইয়াছে। কেবল অর্থনীতি নহে, মুখ থুবড়াইয়া পড়িয়াছে মানুষের স্বাভাবিক সন্তোষও। কর্মহীন, উপার্জনহীন মানুষ হারাইয়াছেন আত্মসম্মান, মর্যাদার ন্যূনতম বোধ। লকডাউনের বর্ষপূর্তি এই মন ভাল না থাকিবার বিষাদেরও বর্ষপূর্তি। বিশ্বময় অশান্তির বার্ষিকী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE