প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং রাহুল গান্ধী। ছবি: পিটিআই
রবীন্দ্রনাথ ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ মানসীর ভাব-মূর্তি রচনা করেছিলেন, সৃষ্টি হয়েছিল এক অপূর্ব কাব্যগীতির। নিজের ভাবনা এবং ধারণা দিয়ে জগৎসংসারের নানা বিষয়ের ছবি আঁকবার চেষ্টা সবাই প্রতিনিয়ত করে চলে। মুশকিল হল, আপন মনের মাধুরীটি ঠিক কেমন, মানসপ্রতিমার চেহারা-চরিত্র তার উপরেই নির্ভর করে। সেই মাধুরীর রসায়নে যদি গোলমাল থাকে, গরলই যদি হয় প্রকৃত পানীয়, তবে দেবতা দানব হয়ে যেতে পারে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা চলছে প্রায় আড়াই মাস। দলীয় সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি বিভিন্ন রাজ্যের নানা অঞ্চলে পদযাত্রা করছেন, বহু মানুষের সঙ্গে তাঁর দেখা হচ্ছে, কথোপকথন চলছে, সেই জনসংযোগের নানা দৃশ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। দৃশ্যগুলিতে সচরাচর কোনও আতিশয্য নেই, নেই আত্মপ্রচারের উৎকট তাড়না, মানুষের সঙ্গে মানুষের সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্কই সেখানে নানা ভাবে প্রকাশিত। নেতা হিসাবে রাহুল গান্ধী কত নম্বর পাবেন, তাঁর দল ভোটের বাজারে কত দাম পাবে, সে-সব প্রশ্ন স্বতন্ত্র, কিন্তু এই কর্মকাণ্ডটি ইতিমধ্যেই এক স্বাস্থ্যকর নিদর্শন হয়ে উঠেছে। বিভাজনে বিসংবাদে বিদ্বেষে আকীর্ণ ভারতীয় রাজনীতির পরিসরে বহুত্বের দৈনন্দিন উদ্যাপনের নিদর্শন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দর্শন অন্য গোত্রের। তাঁদের আপন গোত্রের। তিনি রায় দিয়েছেন, রাহুল গান্ধী ক্ষমতার লোভে এই যাত্রায় নেমেছেন। এই অভিযান পরিবারতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার তাগিদে। মন্তব্যটি আপাতদৃষ্টিতে নাবালকোচিত বলে মনে হতে পারে। রাহুল গান্ধী একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। সেই দল ক্ষমতার লড়াই থেকে অবসর নিয়েছে, এমন কথা শোনা যায়নি— নরেন্দ্র মোদীরা অনেক দিন যাবৎ ‘কংগ্রেস-মুক্ত’ ভারত গড়বার স্বপ্ন সওদা করছেন বটে, কিন্তু কংগ্রেসকে তাঁরা নিশ্চয়ই সেই স্বপ্নের শরিক বলে মনে করেন না। এই পদযাত্রা যে একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং সেই রাজনীতি যে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা তথা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, সে-কথা তো বালকেও বোঝে, তা নিয়ে পাড়া মাথায় করার অর্থ কী?
প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সতীর্থরা কি উদ্বিগ্ন? গুজরাত নির্বাচন সমাগত। রাহুল গান্ধী নির্বাচনী প্রচারে গুজরাতে সমাগত। তাঁর পদযাত্রা কি তাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়িয়েছে? সেই গুরুত্ব কি বিজেপির ভোটে ভাগ বসাতে পারে? নরেন্দ্র মোদীর পোড়-খাওয়া ভোট-ভাবুক মগজে এই প্রশ্নগুলি জাগ্রত হয়ে থাকলে বিস্ময়ের কোনও কারণ নেই। সুতরাং তাঁকে পদযাত্রার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে। সেই যুদ্ধের অস্ত্র কী? অস্ত্র বিভাজন। মেধা পাটকর যে-হেতু রাহুল গান্ধীর সঙ্গী হচ্ছেন, অতএব তাঁর নর্মদা বাঁচাও অভিযানকে ‘গুজরাত-বিরোধী’ প্রতিপন্ন করতে তৎপর হয়েছেন শ্রীযুক্ত মোদী। পরিবেশ রক্ষা ও জনকল্যাণের বৃহত্তর এবং সুদীর্ঘমেয়াদি পরিপ্রেক্ষিতেই নর্মদা প্রকল্পের মতো উদ্যোগের সমালোচনা গড়ে উঠেছে, প্রকৃতি-পরিবেশের বাস্তুতান্ত্রিক সঙ্কটের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই সমালোচনার গুরুত্ব আরও বহু গুণ বেশি বলে প্রমাণিত হয়েছে, অথচ দেশের প্রধানমন্ত্রী সেই নৈতিক অবস্থানকে ‘গুজরাত-বিরোধী’ বলে প্রতিপন্ন করতে বিচিত্র এবং উৎকট অপপ্রচার শুরু করলেন! এই প্রচার ভোটের বাজারে ফলপ্রসূ হতেই পারে, যেমন দু’দশক আগে ফল দিয়েছিল ‘গুজরাতি অস্মিতা’ নিয়ে তাঁর পরিকল্পিত ঢক্কানিনাদ। কিন্তু তাতে গুজরাতের প্রকৃত মঙ্গল হয়নি, দেশেরও না। রাজনীতির কারবারিরা ভোটের কথা ভেবেই কাজ করবেন বা প্রচার করবেন, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু বিভাজনের কৌশলটিই সমস্ত বিষয়ে শাসকের রাজনীতির প্রকরণ হলে, ভারত জোড়ার অভিযানকেও ভারত ভাঙার অভিযান বলে দেখানোর তৎপরতা প্রকট হলে তা গভীর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy