সুপ্রিম কোর্ট হইতেও খালি হাতে ফিরিতে হইল নির্বাচন কমিশনকে। সম্প্রতি মাদ্রাজ হাই কোর্টে তুমুল ভর্ৎসনা জুটিয়াছিল কমিশনের। অতিমারির আবহে ব্যাপক নির্বাচনী জনসভা, প্রচার-অভিযানের পরেও রাজনৈতিক দল বা নেতাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা না করিয়া দেশকে কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গে ভাসাইবার জন্য হাই কোর্ট শুধু কমিশনকে একক ভাবে দায়ীই করে নাই, বিচারপতি মন্তব্য করিয়াছেন, নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা উচিত। সংবাদমাধ্যমে সেই মন্তব্য প্রকাশিত হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের সম্মানহানি হইয়াছে, এই যুক্তি দেখাইয়া শীর্ষ আদালতে গিয়াছিল কমিশন। সঙ্গে আর্জি ছিল, আদালতের বিচার বা রায় সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণগুলি প্রকাশেই সংবাদমাধ্যমের কাজ সীমাবদ্ধ থাকুক, বিচারকের মৌখিক মন্তব্য বা পর্যবেক্ষণগুলি যেন প্রকাশ না হয়— সুপ্রিম কোর্ট সংবাদমাধ্যমকে নির্দেশ দিক। কমিশনের এই আবেদন শীর্ষ আদালত খারিজ করিয়াছে।
কেবল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষাতেই নহে, সুপ্রিম কোর্টের এই প্রত্যাখ্যান গণতন্ত্রের রক্ষণে, সংবিধান-স্বীকৃত বাক্স্বাধীনতা রক্ষায়। শীর্ষ আদালত স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে, যে কোনও আদালতে বিচারপ্রক্রিয়ার ‘রিয়েল টাইম’ রিপোর্টিং, এমনকি বিচারক ও আইনজীবীদের কথোপকথন প্রকাশও বাক্স্বাধীনতার অঙ্গ। কোনও অবস্থাতেই সংবাদমাধ্যমকে এই বিবরণীসমূহ প্রকাশ হইতে বিরত করা যায় না, বরং এই স্পষ্ট ও অনর্গল প্রকাশ ভারতের সাংবিধানিক সংস্কৃতির অন্তরাত্মাকেই তুলিয়া ধরে, তাহার অবাধ স্ফুরণে আদালতই বলীয়ান হয়। একমাত্র শিশুর যৌন হেনস্থা এবং বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে আলাদা কথা, নচেৎ আদালতের বিবরণী প্রকাশে সংবাদমাধ্যমকে মুক্তকণ্ঠই হইতে হইবে। সুপ্রিম কোর্ট এই প্রসঙ্গে স্মরণ করাইয়া দিয়াছে সাম্প্রতিক কালে আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া সমাজমাধ্যমে ‘লাইভ’ দেখাইবার কথাও। এই সব কিছুই বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করিতে, এবং েসই কারণেই আদালতে বলা প্রতিটি মন্তব্য, প্রতিটি পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করিবার অধিকার সংবাদমাধ্যমের আছে। হাই কোর্টের বিচারপতির মন্তব্য অপ্রিয় ও অনভিপ্রেত মনে হইলেও, তাহাতে নির্বাচন কমিশন অবমানিত বোধ করিলেও তাহার জেরে শীর্ষ আদালতে আসিয়া নালিশ করিবার এবং সংবাদমাধ্যমের পায়ে বেড়ি পরাইবার কোনও যৌক্তিকতা নাই।
কমিশনের আবেদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা লেখা ছিল— মাদ্রাজ হাই কোর্ট এবং নির্বাচন কমিশন উভয়েই স্বাধীন সাংবিধানিক সত্তা, কমিশনকে হাই কোর্টের ভর্ৎসনায় দুই সত্তার ভাবমূর্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। কিন্তু শীর্ষ আদালতে নালিশ করিতে গিয়া নির্বাচন কমিশন সংবাদমাধ্যম নামক তৃতীয় আর একটি স্বাধীন সত্তার গুরুত্ব খর্ব করিয়া বসিল। হাই কোর্টের মন্তব্য প্রসঙ্গে শীর্ষ আদালত বলিয়াছে, উহা সম্ভবত কোভিড-অতিমারি পরিস্থিতির নিরিখে বিচারপতির গভীর উদ্বেগের তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু সেই মন্তব্য প্রকাশ করিয়া সংবাদমাধ্যম সঙ্গত কাজই করিয়াছে। মাত্র কয় দিন আগে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দিবস চলিয়া গেল, নির্বাচন কমিশন ও হাই কোর্টের এক আপাত-বিধুর সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে বাক্স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রহরায় সংবাদমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আরও এক বার নিশ্চিত হইল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy