এই প্রথম বার ভারতের গ্রামাঞ্চলের টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) বা মোট জন্মহার নেমে এল ২.১-এ। সংখ্যাটি তাৎপর্যপূর্ণ। গড় জন্মহার এই স্তরের উপরে থাকলে জনসংখ্যা ক্রমশ বাড়ে; এই স্তরের নীচে নেমে গেলে জনসংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে— আর, টিএফআর যদি ২.১ হয়, যাকে রিপ্লেসমেন্ট রেট বা প্রতিস্থাপক হার বলা হয়, তা হলে জনসংখ্যা বর্তমান স্তরে স্থির হবে। ভারতের শহরাঞ্চলে টিএফআর বহু দিন আগেই ২.১-এর নীচে নেমে গিয়েছে, এখন তা ১.৬-এর কাছাকাছি। এ বার গ্রামাঞ্চলেও এই হার নেমে এল প্রতিস্থাপক হারে। জন্মহার হ্রাস পাওয়ার কারণগুলি অজানা নয়। মহিলাদের মধ্যে সাক্ষরতা বৃদ্ধি, মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার গড় মেয়াদ বৃদ্ধি, সহজে জন্মনিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার নাগাল পাওয়া— এগুলি যেমন কারণ, তেমনই জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ও আর একটি কারণ। বিশেষত নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে, যেখানে সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উপরে নির্ভরতা ক্রমশ কমছে, কিছু ক্ষেত্রে কার্যত আর নির্ভরতা নেই। তেমন পরিবারে সন্তানসংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আর্থিক বিবেচনা ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে। পাশাপাশি, এখনও তুলনায় অতি অল্পসংখ্যক হলেও বিশেষত শহরাঞ্চলে আরও একটি প্রবণতা ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে— অনেক দম্পতি এখন স্বেচ্ছায় নিঃসন্তান থাকছেন। তার পিছনে উভয়ের অতি ব্যস্ত কর্মজীবন, সন্তান প্রতিপালনে বৃহত্তর পরিবারের সহায়তা পাওয়ার সুযোগ না থাকা ছাড়াও, ব্যক্তিগত অভিরুচির প্রশ্নটি তো রয়েছেই। ফলে, রাজনৈতিক নেতারা যা-ই বলুন না কেন, জনবাহুল্য ভারতের প্রকৃত সমস্যা নয়— অনতিদূর ভবিষ্যতে জনসঙ্কোচন তৈরি করতে চলেছে তার চেয়ে বড় সমস্যা।
তার কারণ হল, জন্মহার হ্রাস পেলে জনসংখ্যার চরিত্র বদলায় একটি নির্দিষ্ট ভাবে— মোট জনসংখ্যায় বয়স্কদের অনুপাত বাড়তে থাকে, এবং তরুণদের অনুপাত কমে। ফলে, এক দিকে কর্মক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা কমে, আর বাড়তে থাকে প্রবীণদের সংখ্যা। বিশ্বমঞ্চে সমস্যাটি পরিচিত— জাপানের মতো বহু উন্নত দেশই এখন জনবিন্যাসের এই স্তরে রয়েছে। জনবিন্যাসের চেহারাটি এমন হলে এক দিকে চাপ পড়ে দেশের সামগ্রিক উৎপাদন-সম্ভাবনার উপরে; অন্য দিকে, প্রবীণদের দেখভাল করার জন্যও প্রয়োজন হয় বিপুল অর্থের। ভারতের মতো দেশে, যেখানে মাথাপিছু জাতীয় আয় এখনও অত্যন্ত কম, সেখানে এই সমস্যা ভয়ঙ্করতর— কারণ, প্রবীণদের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব নিতে রাষ্ট্র অক্ষম। এখনও পরিবারের বয়স্ক, উপার্জনে অক্ষম সদস্যদের দেখভালের দায়িত্ব সম্পূর্ণত ন্যস্ত পরিবারের উপার্জনশীল সদস্যদের উপরে। কিন্তু, ভবিষ্যতে রাষ্ট্রকে যদি আরও বড় মাপে এই দায়িত্ব পালন করতে হয়, তবে ভারত আদৌ প্রস্তুত কি না, এই প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়ার কোনও উপায় নেই।
পরিবর্তনশীল জনবিন্যাসের আরও একটি চরিত্র ভারতকে উদ্বিগ্ন করবে। দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এবং পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলিতে, অর্থাৎ মাথাপিছু উৎপাদনে দেশের যে রাজ্যগুলি এগিয়ে রয়েছে, মোট জন্মহার কমছে দ্রুততর বেগে। উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের দরিদ্রতর রাজ্যগুলিতে এই হ্রাসের বেগ তুলনায় কম। জনসংখ্যাতত্ত্বে এই প্রবণতাটি পরিচিত— আয়ের সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সম্পর্কটি ব্যস্তানুপাতিক। পরিসংখ্যান ভাঙলে দেখা যাবে, এই আঞ্চলিক প্রভেদের পাশাপাশি রয়েছে আরও একটি প্রবণতা— ব্যক্তিগত স্তরেও যাঁর আয় কম, সন্তানসংখ্যা তাঁরই বেশি। এই জনগোষ্ঠীকে যদি ভবিষ্যতে উৎপাদনশীল শ্রমশক্তিতে পরিণত করতে হয়, তবে রাষ্ট্রকে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য, এই দু’টি খাতে আরও অনেক বেশি মনোযোগী হতে হবে। নয়তো, কয়েক দশকের মধ্যেই ভারত পরিণত হবে একটি অতি নিম্ন উৎপাদনশীলতাবিশিষ্ট অর্থনীতিতে। আধুনিক দুনিয়া সম্পূর্ণত প্রযুক্তিনির্ভর হবে। অদক্ষ শ্রমিক নিয়ে সেই পৃথিবীতে সসম্মানে টিকে থাকা কার্যত অসম্ভব।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)