Advertisement
১০ অক্টোবর ২০২৪
প্রবন্ধ ১

রাজনীতি দিয়ে সমাজ ভাগ করার পরিণাম

সমাজকে তার নিজের শক্তি ধরে রাখতে দিলে আজ এই প্রাচীন জৈন উৎসবটি দেশজোড়া অশান্তির কারণ হত না, মাংস খাওয়ার অধিকার নিয়ে মিটিং-মিছিলও করতে হত না। সমাজ নামক বস্তুটা মরেই এসেছে, তবু রাজনীতি তার উপর খাঁড়ার ঘা দিতে ছাড়ে না।মু  ম্বই-এর মীরা-ভায়ান্দর মিউনিসিপ্যাল অঞ্চলটি আলাদা করে জৈন এলাকা বলে পরিচিত নয়। তবে এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে পঁচিশ শতাংশই জৈন, সংখ্যায় যেটা দাঁড়ায় প্রায় ১.৫ লক্ষ। অনেক দশক ধরেই তাঁদের বসবাস এখানে। অনেক দশক ধরেই বছর’ভর তাঁদের নানাবিধ উৎসব, আচারপালন।

প্রার্থনা থেকে প্রতিবাদে। জৈন পুরোহিতদের জনসমাবেশ, ভায়ান্দর, মুম্বই, ১২ সেপ্টেম্বর। ছবি: পিটিআই।

প্রার্থনা থেকে প্রতিবাদে। জৈন পুরোহিতদের জনসমাবেশ, ভায়ান্দর, মুম্বই, ১২ সেপ্টেম্বর। ছবি: পিটিআই।

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

মু  ম্বই-এর মীরা-ভায়ান্দর মিউনিসিপ্যাল অঞ্চলটি আলাদা করে জৈন এলাকা বলে পরিচিত নয়। তবে এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে পঁচিশ শতাংশই জৈন, সংখ্যায় যেটা দাঁড়ায় প্রায় ১.৫ লক্ষ। অনেক দশক ধরেই তাঁদের বসবাস এখানে। অনেক দশক ধরেই বছর’ভর তাঁদের নানাবিধ উৎসব, আচারপালন। পর্যুষণ-এর সময় নিরামিষাশী সম্প্রদায়টি আরও কঠোর শুদ্ধাচার পালন করেন। এত কাল ধরে তাঁরা এতে কোনও অসুবিধে বোধ করেননি, বাধা পাননি, সবচেয়ে বড় কথা, সম্প্রদায়ের বাইরে অন্যদের এত কাল তাঁরা কোনও কাজে বাধাও দেননি।

তা হলে এ বার হল কী? হঠাৎ কি তাঁরা খেপে উঠলেন? বলতে শুরু করলেন, পাড়ায় পাড়ায় সব অজৈন মানুষকেই মাংস খাওয়া বন্ধ করে জৈন ব্রত পালনে সাহায্য করতে হবে? অন্যদের উপর জবরদস্তি করে নিজেদের ধর্মাচার পালনের মধ্যে যে হিংসাভাব, তা কি অকস্মাৎ ভুলে বসলেন অহিংসার পূজারিরা?

প্রশ্নটা দরকারি। সম্ভবত এর উত্তরের মধ্যেই একটা সংকট লুকিয়ে।

বিজেপি-শাসিত মীরা ভায়ান্দর মিউনিসিপ্যালিটিই সবচেয়ে আগে মাংসের উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যার থেকে উৎসাহ পেয়ে এগিয়ে আসে বৃহন্মুম্বই কর্পোরেশন, আর একের পর এক রাজ্য, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়, হরিয়ানা। মুম্বই শহরে অন্যান্য জায়গাতেও জৈনরা যথেষ্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাঁদের কিছু অংশ সম্পন্ন এবং প্রভাবশালী, সুতরাং রাজ্যের বিজেপি সরকারের চোখে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণও বটে। অনেক দিনের পর্যুষণ পালনের প্রথাটি নিয়ে মীরা ভায়ান্দরে প্রথম নড়নচড়ন শুরু হয় এই শতকের গোড়ায়, কিছু গোষ্ঠী চাপ দিতে থাকেন বছরের এই সময়ে গোটা অঞ্চলেই প্রাণিহত্যা বন্ধ করার জন্য। ২০০১ সাল থেকে অঘোষিত ভাবেই এই সময়ে মাংস দোকানগুলি বন্ধ থাকতে শুরু করে। আদালতের নির্দেশও মেলে, স্থানীয় ভাবে কোনও কর্পোরেশনের খাদ্য-সংক্রান্ত ঘোষণার অধিকার আছে। বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু সম্প্রতি বলেছেন, আদালতের ওই নির্দেশটি বিতর্কিত, তবে স্থানীয় ভিত্তিতেই ওই রায় দেওয়া হয়েছিল। ক্ষমতায় ক্ষমতা বাড়ায়, দাবি ওঠায় আরও দাবি। এ বছর মীরা ভায়ান্দরের কিছু সক্রিয় জৈন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেন বিষয়টিতে পাকা সরকারি ছাপ দেওয়ানোর জন্য। এই দাবি উপেক্ষা করাই যেত, কিন্তু রাজনীতি এমন সুযোগ ছাড়বে কেন? বিজেপি-শাসিত কর্পোরেশনের নেতা দিনেশ জৈন মহাড়ম্বরে নিরামিষের ধ্বজা উড়িয়ে দিলেন। ভাবলেন, জৈনদের খুশি করাও হল, বিজেপি-র সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আধ-পা হলেও এগোনো গেল। আধ-পা এগোনোর বদলে অবশ্য তাঁর কার্যক্রম দেশ জুড়ে পাঁই পাঁই দৌড় শুরু করল, অতটা হয়তো দিনেশজিও ভাবেননি। অবস্থা এমনই দাঁড়াল যে, শত্রুরা বিজেপি-র নামটা পর্যন্ত পাল্টে দিয়ে বলল, ভারতীয় জৈন পার্টি!

ধর্মের নামে রাজনীতি কী প্রক্রিয়ায় চলে, আর সেই রাজনীতি কী ভাবে ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে, ছোট বৃত্ত থেকে বড় বৃত্তের দিকে অবধারিত ধাবিত হয়, তিক্ততা আর অবিশ্বাস বিষাক্ত গ্যাসের মতো হাওয়ায় ছড়াতে থাকে— গত একশো বছরে তার সঙ্গে আমাদের অল্পবিস্তর পরিচয় হয়েছে বইকী। এও আমরা বুঝে নিয়েছি যে, এই বিষাক্ত অসহনকে ধাপে ধাপে বাড়িয়ে নেওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ থাকলে, সেই পরিবেশ বিস্তারে আগ্রহী রাজনীতি হাতের কাছে মজুত থাকলে আর কথাই নেই, এক এক বারে বড় বড় ধাপ ওঠা যায়। মুম্বই-এর গল্পটা সেই বিষাক্ত সিঁড়ির গল্প। কোনও জায়গায় প্রশাসন যদি দিনেশ জৈনদের নিয়েই তৈরি হয়, যাঁরা সমাজের বিভাজন তৈরি করে ভাগাভাগির সুবিধেটা নেওয়ার অপেক্ষায় থাকেন, তা হলে এত দিনের ধর্ম, অনুষ্ঠান, এত দিনের আমিষ-নিরামিষের সহাবস্থান, সবই মুহূর্তে ঘুলিয়ে যেতে সময় লাগে না। যাঁরা এত কাল দিব্যি পাশাপাশি বসবাস করে এসেছেন, তাঁরাই হঠাৎ পরস্পরের দিকে দাঁতনখ বার করে তেড়ে যেতে শুরু করেন।

মীরা ভায়ান্দরে এই মুহূর্তে সেই নাটকীয় পট-পরিবর্তনের ছবি। যে দেড় লাখ জৈন এত দিন সমস্যা ছাড়াই নিজেদের আচার-ধর্ম ালন করে আসছিলেন, তাঁরা আজ হঠাৎ উত্তেজিত সমাবেশ করছেন, মাংস বন্ধের সিদ্ধান্তে চার দিকে যে প্রতিবাদ, তার বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড-স্লোগান নিয়ে রাস্তায় নামছেন। গত শনিবার বভন জিনালয় জৈন মন্দিরের সামনে মিলিত হলেন সাতশো মানুষ, দুই ঘণ্টা তাঁরা প্রকাশ্য উপবাস করে মাংস-বন্ধের মেয়াদ কমিয়ে দুই দিন করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন। অন্য দিকে, মাংস-পন্থী আন্দোলনের প্রধান সেনাপতি শিব সেনার উদ্ধব ঠাকরে এমন বাণীও দিলেন যে, মাংসের বিরোধিতার আগে জৈনরা যেন নিজেদের ভবিষ্যৎটা এক বার ভেবে দেখে: ‘মুসলিমদের পাকিস্তান আছে, জৈনদের কী আছে, তারা কোথায় যাবে?’ ‘সেনা’পতি তিনি, রাখঢাকের তোয়াক্কা তাঁর নেই। জৈন মন্দিরগুলির সামনে মাংস কাটার ব্যবস্থা করছে তাঁর নন্দী-ভৃঙ্গীরা। ব্যাপার এতই গুরুতর যে জৈন প্রতিনিধিদল গিয়ে ঠাকরের সঙ্গে দেখা করেছেন। সেখানে মুখে তাঁরা যা-ই বলে আসুন, মনে মনে কী ভাবছেন, অনুমান সহজ। ভাবছেন, এই তো, সংখ্যাগুরুর অমন আক্রমণের কারণেই তো নিজেদের বাঁচাবার ব্যবস্থা করতে হয়, অন্যদের খাওয়া বন্ধ করে নিজেদের উপবাস নিশ্চিত করতে হয়।

এত বছর, এত দশক, এমনকী এত শতক, তাঁদের এ সব ভাবতে হয়নি। আজ হচ্ছে।

গর্ত খোঁড়ার নীতি

সব মিলিয়ে, মীরা ভায়ান্দরকে একটা ছোট প্রতীক হিসেবে দেখার লোভটা সামলানো যাচ্ছে না। আমাদের দেশে বিভাজন আর অনৈক্যের সুযোগসন্ধানী রাজনীতি কী ভাবে সামাজিক বহুত্বকে ভেঙেচুরে খানখান করে দেয়, তার স্পষ্ট ‘কপিবুক’ প্রতীক চোখের সামনে। এই ঘটনাই প্রমাণ, একটা সমাজে নানা রকম সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, বৃত্ত তাদের নানা অভ্যাস, সংস্কার, অনুষ্ঠান, আচার নিয়ে বহু কাল ধরে থাকতে থাকতে এক আশ্চর্য সকালে কেমন আবিষ্কার করে, সব সহাবস্থান, সহযোগিতা, সহচিন্তা একেবারে অবাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। বার বার দেখা গিয়েছে, এই সম্প্রদায় গরু খায়, ওই সম্প্রদায় গরু পুজো করে, এই সম্প্রদায় মদ্যপান করে না, ওই সম্প্রদায় মদ্যপান করে, এই সম্প্রদায়ের মসজিদে যখন নমাজ পড়া হয়, ওই সম্প্রদায়ে বিসর্জনের বাজনা তখনই বাজে, এই সব নিয়েই সমাজটা দিব্যি চলতে চলতে হঠাৎ কোথা থেকে কী হয়ে যায়, সব সহাবস্থান ভেঙে পড়ে। পরাধীন ভারতে সম্প্রদায় রাজনীতির ইতিহাস পড়তে গিয়ে অবাক লাগে, মসজিদের সামনে গানবাজনা নিয়ে সংকট তো উনিশশো বিশ-তিরিশের ঘটনা, তাও কয়েকটি মাত্র জায়গায়। তার আগে কেন অশান্তি হয়নি? ওই একই সময়ে অন্যান্য জায়গাতেই-বা কেন হয়নি? কত মসজিদ, কত মন্দির, কত গুরুদ্বার আজও পাশাপাশি, রাস্তার এ পারে ও পারে। কেউ কেন তাদের ভেঙে দু’খান করেনি? কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির আর জ্ঞানবাপী মসজিদ ১৭৯০ সাল থেকে গায়ে গায়ে লাগা। পুরনো বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙেই নাকি আওরংজেব এই মসজিদ তৈরি করেন, এই জনরবও অলিগলিতে চালু। তাও কেন বাবরি মসজিদ কাণ্ডের আগে অশান্তি ছড়ায়নি? ভাগাভাগি, মারামারি ছাড়াই তবে নানা ধর্ম চলতে পারে, সাংগঠনিক ধর্মও চলতে পারে, এমনকী সাংগঠনিক ধর্মের অশান্তি-বিবাদের নিষ্পত্তিও ঘটতে পারে। কট্টর শিবির থেকে বিভাজনের দাবি উঠলে সেই দাবিকে সামাল দেওয়াও যেতে পারে। নানা পদ্ধতিতে সকলের পাশাপাশি থাকার বন্দোবস্ত করে দিতে পারাটাই সমাজের কাজ।

আসলে ভারতীয় সমাজের বহুত্ব বলতে আমরা সংস্কৃতির বিবিধতাটুকুই বুঝি। বোধহয় তার চেয়ে একটু বেশি বোঝা উচিত। এই সমাজের মধ্যে বিরোধিতা বা দ্বন্দ্ব মেটানোর বহু পদ্ধতি, বহু বন্দোবস্ত— সেটাও বোঝা উচিত। সমাজের মধ্যে তো সব সময়েই যে পরম ঐক্য বিরাজ করে না, প্রবল ভ্রাতৃত্বের বোধটিও সারাক্ষণ জাগ্রত থাকে না। যে কোনও পাড়ার মতো সমাজ নামক পাড়াটাতেও বিরোধ বা দ্বন্দ্ব এখানে ওখানে সর্বত্র, আবার সেই দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও সর্বত্র। পাড়ার লোকই আগ বাড়িয়ে দ্বন্দ্ব পাকায়, পাড়ার অন্য লোকরা এসে সেই সব ঝামেলা মেটায়। পুলিশ আসে কেবল জরুরি অবস্থায়, কারও বিপদ ঘটলে। মীরা ভায়ান্দরের কথাই ধরি। সত্যিই যদি গত পনেরো বছর ধরে এই অঞ্চলে মাংস বিক্রিবাটা এই সময়টার জন্য বন্ধ থেকে থাকে, খুচরো অশান্তি এরা যদি নিজেরাই মিটিয়ে থাকে, আজ আলাদা করে প্রশাসনিক উদ্যোগটা নেওয়ার দরকার ছিল কি? যেখানে কোনও পক্ষেই বিপদের সম্ভাবনা নেই, অধিকারের ক্ষুণ্ণতা নেই, সেখানে রাষ্ট্র বা প্রশাসনের পদক্ষেপ কি অবাঞ্ছিত নয়? রাজনীতি দিয়ে সমাজের জায়গা ভাগাভাগির চেষ্টাটা না করে সমাজটাকে তার নিজের অভ্যেসের মধ্যেই ছেড়ে দিতে পারলে আজও হয়তো সেখানে অশান্তি ঘটত না।

এ যেন অকারণে একটা ছোট ফুটোকে বাড়িয়ে বা়ড়িয়ে বিরাট অন্ধকার গর্ত করে তোলা। গর্ত না হয়ে ফুটোই থাকলে আজ এই জৈন উৎসবটিকে দেশজোড়া আলোচনার বিষয়ও হতে হত না, মাংস খাওয়ার অধিকার নিয়ে মিটিং-মিছিলেরও দরকার পড়ত না।

সমাজ নামক বস্তুটা মরেই এসেছে। তবু, আজও, রাষ্ট্র আর রাজনীতি তার উপর বিনা প্ররোচনাতেই খাঁড়ার ঘা দিতে ছাড়ে না।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE