Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
corona virus

পুষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

‘লকডাউন’ চলাকালীন সরকারি ভাবে মাথা পিছু চাল, গম, ডাল দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাতে কি মিটছে পুষ্টির ঘাটতি? করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য খাদ্যতালিকায় থাকা উচিত প্রোটিন এবং ভিটামিন। তা না হলে সার্বিক ভাবে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানুষের।

চাল-আটার সঙ্গে আনাজও বিতরণ করা হচ্ছে পুলিশের তরফে। অমৃতসরে। ফাইল চিত্র

চাল-আটার সঙ্গে আনাজও বিতরণ করা হচ্ছে পুলিশের তরফে। অমৃতসরে। ফাইল চিত্র

নয়ন মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২০ ০১:১৭
Share: Save:

ছোটবেলায় আমরা কচ্ছপ ও খরগোশের গল্প পড়েছি। দ্রুতগামী হওয়ায় খুবই দম্ভ ছিল খরগোশের। আর সেই দম্ভের জেরেই কচ্ছপের গতিকে তাচ্ছিল্য করে প্রতিযোগিতার মাঝপথেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ফলে প্রতিযোগিতার ফলাফল কী হয়েছিল, তা আমাদের সকলেরই জানা। দ্রুতগামী খরগোশের সেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মনোভাবের জন্যই জিতে গেল শ্লথগতির কচ্ছপ।
করোনার আক্রমণে ইউরোপীয় দেশগুলিও এই ভাইরাসকে কচ্ছপের মতো গুরুত্ব দেয়নি। ফলে লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে। উন্নতমানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও হাজার হাজার প্রাণহানি ঘটছে ক্রমাগত।

কী ভাবে কমানো যেতে পারে মৃত্যু হার? একটা অন্যতম প্রধান উত্তর হল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। দেখা গিয়েছে, গড় আয়ু কম হওয়া সত্ত্বেও মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই মৃত্যুহার কমাতে পারছে। জাপানে একে বলা হয়েছে IKIGAI। অর্থাৎ, পরিমিত ঘুম, ফল ও শাকসব্জি খাওয়া, পরিবারে একসঙ্গে থাকা, নিয়মিত শরীরচর্চা, স্ট্রেস কম, ফাস্টফুডে আসক্তি না থাকা, মদ্যপান ও ধূমপান না করা।

মানবশরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক, অপ্রয়োজনীয় পদার্থ, জীবাণু ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মানবশরীরের মধ্যেই একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। সংবহনতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র, শ্বাসতন্ত্রের মতো এটিও একটি ‘সিস্টেম’। একে বলা ‘ইমিউন সিস্টেম’ বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা। মানব শরীরের বিভিন্ন ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা, যেমন, ম্যাক্রোফাজ, লিম্ফোসাইট, নিউট্রোফিল-এর মতো কোষ এবং এই কোষ নিঃসৃত কিছু নির্দিষ্ট জৈব যৌগ নিয়ে এই ‘ইমিউন সিস্টেম’ তৈরি হয়। থাকে কিছু অঙ্গও।

মানবশরীরে যে ক্ষতিকারক পদার্থ প্রবেশ করে তাকে আমরা ‘অ্যান্টিজেন’ বলে থাকি। মানবশরীরে থাকা বিভিন্ন লিম্ফোসাইট এই অ্যান্টিজেন-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তৈরি করে ‘অ্যান্টিবডি’। এই ‘অ্যান্টিবডি’ বা ইমিউনোগ্লোবিউলিন তৈরি হয় যকৃৎ বা লিভারে তৈরি হওয়া ‘গ্লোবিউলিন’ নামক সরল প্রোটিন সহযোগে।

তাহলে সহজ ভাবে বলতে গেলে মানবশরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থার মূল সৈনিক ‘অ্যান্টিবডি’ বা ‘ইমিউনোগ্লবিউলিন’ তৈরিতে প্রয়োজন প্রোটিন। সুতরাং, যার যত পোক্ত লিভার ও যে যত প্রোটিনজাত খাদ্য খাবেন, তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তত ভাল হবে। অর্থাৎ, পুষ্টির সঙ্গে জড়িত ‘ইমিউনিটি’ বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এ ছাড়া, ‘ইমিউন সিস্টেম’ কর্মক্ষম ও কার্যকরী থাকার পিছনে আরও দরকার ভিটামিন ও উৎসেচক। সে গুলি তৈরির উপকরণও খাদ্যের মধ্যে থাকা প্রয়োজন।

ভারতের এক বৃহত্তর অংশের মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। ‘লকডাউন’ সেই পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তুলেছে। লকডাউন-এর সময়ে সরকার রেশনে চাল, আটা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডাল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু প্রোটিন এবং ভিটামিন-এর অভাব থেকেই যাচ্ছে দেশের বৃহত্তর অংশের মানুষের মধ্যে। ফলে মানুষের সার্বিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। এর জেরে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে অনেকখানি।

প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ভিটামিন যথা, এ, ডি, ই, কে এবং সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম ইত্যাদি খনিজ শরীর প্রয়োজন মতো পাচ্ছে না। ফলে অপুষ্টিজনিত কারণে, এক দিকে যেমন অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে না, অর্থাৎ, রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে, কোষগুলির কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে বা কোষ বার্ধক্য দ্রুতগামী (aging) করছে। এই জন্য এ, ডি, ই, সি, সেলেনিয়াম, কপার ইত্যাদি পদার্থগুলিকে ‘অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট’ বলে যারা কোষকে সজীব, সতেজ রাখে।

খাদ্য ছাড়া আর যে বিষয়গুলির উপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার তার মধ্যে অন্যতম হল ন্যূনতম শারীরিক পরিশ্রম। এর ফলে কোষ ও অঙ্গে রক্ত চলাচল ও লসিকা রসের সঞ্চালন বেশি ঘটে। ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কারণ, এই লসিকাই শ্বেতরক্তকণিকা নামক অস্ত্রগুলি বহন করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পৌঁছে দেয়। এ ছাড়া মানসিক সচলতা বৃদ্ধি পায়, স্ট্রেস কমে। যথেষ্ট পরিমাণে ঘুমনোও ‘ইমিউন সিস্টেম’কে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। অপর দিকে, অধিক রাতে ঘুম, বা কম ঘুম ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হলে মদ্যপান একেবারেই কমিয়ে দেওয় বা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এতে লিভার অর্থাৎ যকৃতের কার্যকারিতা কমে যায়। ফলে গ্লোবিউলিন তৈরি বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে বাধাপ্রাপ্ত হয় পর্যাপ্ত পরিমাণ ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরির কাজ। ধূমপানও একেবারেই পরিত্যাগ করা উচিত। এতে শ্বাসনালীতে থাকা সিলিয়াগুলি শ্বাসবায়ুর বিষাক্ত পাদার্থ ফুসফুসে থাকা কয়েকটি প্রয়োজনীয় উৎসেচক যথা সারফেকট্যান্ট (যা ফুসফুসকে রক্ষা করে), ‘ইলাসটিন’, ‘অ্যাঞ্জিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম ২’ ইত্যাদির ক্ষতি করে ফুসফুসকে অসুস্থ করে তোলে। রক্তচাপের বৃদ্ধি ঘটায়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে দূরে সরাতে হবে তা হল স্ট্রেস বা মানসিক চাপ। এর বৃদ্ধিতে শরীরে কর্টিসল নামক স্টেরয়েড বেশি মাত্রায় ক্ষরিত হয় যা ‘ইমিউন সিস্টেম’কে যে ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে তা নয়, তার সঙ্গে রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, ‘ডায়াবিটিস’-এর আশঙ্কা তৈরি করে। রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে কোষে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদান ঢোকার বিষয়টি বাধাপ্রাপ্ত হয়। বিশেষ করে ভিটামিন সি-এর কার্যক্ষমতা এতে কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর সঙ্গে অবশ্যই উচিত জল পান করা। তাতে কোষ সতেজ থাকে।

করোনাকে প্রতিহত করতে অন্যান্য উপায়ের সঙ্গে যদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব না দেওয়া হয় তবে ইউরোপীয় দেশগুলির মতো আমাদেরও অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠবে। কারণ, তাঁদের গড় আয়ু বেশি হলেও তাদের মধ্যে প্রকৃতিজাত খাদ্যাভ্যাস নেই। ঘুমনোর পরিমাণ কম, অল্পেই ওষুধের প্রতি আকর্ষণ, অত্যধিক ধূমপান, মদ্যপান, অনিয়ন্ত্রিত ভোগবিলাসী জীবন, অত্যধিক মানসিক চাপ, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা যথা ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস জনিত রোগ করোনা আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুকে তরান্বিত করছে।

তাই আমাদের দেশে খাদ্যে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন এবং প্রাণিজ প্রোটিন খেতে হবে এর জন্য কিছু আর্থিক সাহায্য দরকার যাতে শাকসব্জি কিনতে পারে তার ব্যবস্থা করা।গ্রামের মানুষের, আদিবাসী সমাজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। তার কারণই হল তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাপন পদ্ধতি অনেক পরিশ্রমী, মানসিক চাপের মাত্রা কম, প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে সখ্যতা। যার ফল সুস্থতা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এমনও দেখা গিয়েছে, বড় অপারেশনের পরে বিনা অ্যান্টিবায়োটিক-এ তাঁরা সেরে উঠেছেন। সুতরাং, সার্বিক ভাবে পুষ্টিতে জোর দিলেই রোগ প্রতিরোধে ‘আত্মনির্ভর’ হতে পারবে ভারত। কেন্দ্র তথা রাজ্য সরকারের অবশ্যই উচিত সেই দিকে মনযোগ দেওয়া।

লেখক পুরুলিয়ার চিকিৎসক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

corona virus covid 19 nutrition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE