ছ’কিলোমিটার যেতে ন’হাজার টাকা, দরে না পোষালে দুই অসুস্থ শিশুকে সোজা নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়া— বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের দুর্ব্যবহার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমন নয় যে এত কাল অ্যাম্বুল্যান্স চালক ও মালিকরা সমাজসেবী ছিলেন। এখন মহামারির কবলে-পড়া মানুষকে অসহায়, বিপন্ন দেখে এঁদের দাঁত তীক্ষ্ণ, নখ ধারালো হয়ে উঠেছে। লাগামছাড়া লোভ, অভদ্রতা, এমনকি নানা অপরাধের সঙ্গে এঁদের একাংশের যোগসাজশের কাহিনি অজানা নয়। যদিও জেনেও না জানার ভান করেন অনেকে। টাকা পাচার, দুষ্কৃতীদের বহন করা থেকে শুরু করে লাশ পাচার, ভারতে গত দু’দশকে সংবাদমাধ্যমেই এসেছে এমন কয়েকশো অপরাধে অ্যাম্বুল্যান্স ব্যবহারের সংবাদ। সব মালিক বা চালক অপরাধচক্রে নিশ্চয়ই জড়িত নন, কিন্তু দুঃসাহসের বহর দেখে মনে হয়, ওঁরা বেপরোয়া, শাস্তির ভয় ওঁদের নেই। পার্ক সার্কাসের শিশু হাসপাতাল থেকে কলেজ স্ট্রিটের কোভিড হাসপাতাল, অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া ন’হাজার টাকা, অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে এগারোশো টাকা দাবি করেন যাঁরা, তাঁদের ভয়ডর বলে কিছু নেই।
একের পর এক অমানবিক ঘটনা ঘটছে। মন্দিরতলা থেকে পঞ্চসায়রের এক বেসরকারি হাসপাতাল সাড়ে তিন কিলোমিটার যেতে অ্যাম্বুল্যান্স দর হেঁকেছে পাঁচ হাজার টাকা। কেষ্টপুর থেকে আইডি হাসপাতাল আট হাজার টাকা। এত বেশি কেন? দুটো পিপিই কিট, স্যানিটাইজ়েশন, ডিজেল... এ গল্পের শেষ নেই। এত সুরক্ষার দাম চোকানোর পরেও অ্যাম্বুল্যান্স চালক ও তাঁর সহকারীর কাছে রোগী অস্পৃশ্য! করোনা-সংক্রমণ থাক বা না থাক। বনগাঁ হাসপাতালের ঘটনায় দেখা গেল, বৃদ্ধ রোগীর স্ট্রেচার ভেতর থেকে বাইরে টেনে নামানোর ভার পড়ল সঙ্গিনী বৃদ্ধার উপর। অ্যাম্বুল্যান্স চালক ও তাঁর শাগরেদ রোগী ছুঁলেন না ।
চালক, তাঁর সহকারী আর মালিকরাই শুধু অপরাধী নন, আড়ালে আছে আপনার-আমার উদাসীনতা, প্রশ্ন করার অনীহা। সরকারি ব্যবস্থায় সব জেলাতে মাতৃযান বা একশো দুই অ্যাম্বুল্যান্সগুলোর একটা অংশ এখন সম্ভাব্য ও নিশ্চিত কোভিড রোগী নিয়ে ছুটছে। পিপিই কিট-পরা চালকরা, তাঁদের সঙ্গীদের একটা অংশ রোগী ওঠাতে নামাতেও রোগীর বাড়ির লোককে সাহায্য করছেন। ওঁরা পারছেন, বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স পারবে না কেন? রোগীর টাকায় পিপিই কিট-ও পরব, রোগীও ছোঁব না, বেসরকারি চালকরা এমন আচরণ করে পার পাবেন কেন? বারাসত হাসপাতাল থেকে কোভিড থেকে সেরে-ওঠা বৃদ্ধকে অশোকনগরের বাড়ির অনেক আগে মাঝরাস্তায় অন্ধকারে জলকাদায় ফেলে পালালেন যে চালক, তিনি অপরাধী। তাঁর শাস্তি কবে হবে?
শাস্তি হয় না বলেই এঁরা এত নির্ভয়। প্রত্যেকটা সরকারি হাসপাতালের বাইরে যে প্রাইভেট মারুতি ভ্যান আর অ্যাম্বুল্যান্সগুলো দাঁড়িয়ে থাকে, তারা বছরভর রোগী সরবরাহ করছে বেসরকারি হাসপাতালে। কেস-প্রতি নগদ-বিদায়! অথবা মাসোহারা ! লাগাম টানার কেউ নেই।
অবশ্য সব সরকারি অ্যাম্বুল্যান্সও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। গর্ভবতী মহিলারা মাতৃযানের তিনটে মেমো পান। নিখরচায় বাড়ি থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, প্রসবের জন্য হাসপাতাল যাওয়া ও প্রসবের পর বাড়ি ফেরা যায় এই তিন সরকারি কাগজে। এমনই এক মাতৃযান অক্সিজেনের নল নাকে গুঁজে বসিরহাট থেকে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছে এক হতদরিদ্র আসন্নপ্রসবাকে। রোগিণীর বাড়ির পুরুষটিকে অ্যাম্বুল্যান্স চালকের হাতে কিছু গুঁজে দিতে দেখে সন্দেহ হয় কর্তব্যরত চিকিৎসকের। প্রশ্ন করে জানা যায়, রোগিণীকে অক্সিজেন দিতে ‘মাত্র’ পাঁচশো টাকা চেয়েছেন তিনি। রোগিণীর অবস্থা দেখে সন্দেহ হয় চিকিৎসকের। চেপে ধরাতে বোঝা গেল, সিলিন্ডার ছিল, অক্সিজেন ছিল না। ফাঁকা সিলিন্ডারের নলটি ছিল নাকে গোঁজা ! চালককে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করা হয়, প্রশাসনও ব্যবস্থা করে দ্রুত। এই প্রতারকদের শাস্তি দেওয়া খুব কঠিন কিন্তু নয়।
মুখ্যমন্ত্রী সরকারের মুখ, স্বাস্থ্যব্যবস্থারও। কর্পোরেট হাসপাতালের অর্থলোলুপতা নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক বার উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবার দুর্নীতি বন্ধ করতে মুখ্যমন্ত্রীর বেশি সময় লাগার কথা নয়। স্বাস্থ্য দফতর প্রবল চাপে আছে, অজানা নয়। তবু এই সঙ্কটকালে সেবার নামে এই প্রতারণা বন্ধ করতে হবে, এখনই। অ্যাম্বুল্যান্স চক্রের লাগামছাড়া টাকার লোভ ও দুর্ব্যবহার থেকে অসহায় রোগীদের বাঁচাতেই হবে।
সাড়ে চার মাস ধরে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন সরকারি ডাক্তার, নার্স-সহ সব শ্রেণির স্বাস্থ্যকর্মী, স্বাস্থ্যপ্রশাসকরা, কোভিড যোদ্ধারা। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত রোগীদের নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স চক্রের এই দুর্নীতি আমাদের বুকে বাজছে বড়।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, আর জি কর হাসপাতাল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy