Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
internet

একুশে পৌঁছে সবে সাবালক হল নতুন শতাব্দী, সামনে লম্বা রাস্তা

লিখছিলাম ২১ শতাব্দীর একুশে পদার্পণ নিয়ে। ২১ তো একটা বিশেষ সংখ্যা। তাই ভাবলাম একটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক।

উজ্জ্বল সিন্‌হা
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২১ ১২:২৬
Share: Save:

সাবালক হয়ে উঠছে একবিংশ শতাব্দী। কুড়ি পার করে একুশে পা রেখেছে সে। আমরা যারা এই কিছুদিন আগেই বিভিন্ন কোম্পানির জন্য ‘ভিশন ২০০০’ নামক বুদ্ধিহীন এক ইস্তাহার লিখে, একটা মোক্ষম কাজ করলাম বটে, ভাবতে ভাবতে সুড়ুৎ করে অলিপাবের চনমনে আড্ডায় সেঁধিয়ে যেতাম, তারা একটু ধন্দে পড়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে, সত্যিই কেটে গেল এতটা সময়!

পিছু ফিরে তাকালে মনে হচ্ছে, এই তো সেদিনের কথা যখন চারিদিকে গেল-গেল রব উঠেছিল Y2K জুজুর ভয়ে। মনে হয়েছিল, দূরদৃষ্টিহীন কোডারদের ভুলের মাশুল গুনতে হবে আপামর বিশ্বকে। সব সফটঅয়্যারে সালতামামি যাবে গুলিয়ে। আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে বছর গোনার হিসেবনিকেশ। ১৯৯৯ এর পর আসবে ২০০০ সাল আর নির্বোধ কম্পিউটার ভাববে ৯৯ পর ১০০ নয়। আমরা ফেরত গিয়েছি গোড়ায়। মানে ‘০০’ তে!

সে ভয় অবশ্য কেটে গেল ২০০০ সালের শুরুতেই। যখন দেখলাম সবই চলছে সেই আগের মতো। আর ইনস্যুরেন্স কোম্পানির খাতায় আমার বয়েস একদম সঠিক!

কুড়ি বছর পার করে একুশে পা দিয়ে এখন যখন পিছনপানে তাকিয়ে দেখছি, এটা বুঝতে মোটেই অসুবিধা হচ্ছে না যে, ডিজিটাল শতাব্দীর নাগরিক হিসাবে আমরা তখন ছিলাম নিতান্তই নাদান। ইন্টারনেট তখন পাশের পাড়ার বিদূষী মেয়েটির মতো। হাপিত্যেশ করে অনেক অপেক্ষার পর ক্বচিৎ দেখা মিলবে তার আর চলেও যাবে যখন তখন। আগাম জানান না দিয়ে। গুগ্‌ল সবে হামাগুড়ি দিচ্ছে আর আমজনতার কাছে অ্যামাজন তখন ভূগোলের বইয়ে পড়া এক রহস্যময় নদী। ফেসবুক আত্মপ্রকাশ করতে তখনও সাত বছর বাকি। মোবাইল ফোন এসে গিয়েছে বাজারে বছর চারেক। কিন্তু সেটা এখনকার মতো সকলের হাতের মোয়া নয়। খুব দামি পরিষেবা। মুষ্টিমেয় কিছু ভাগ্যবানের জন্য। জয় গোস্বামী তখন তরুণ কবি আর বামফ্রন্টের পতনের জন্য আরও একযুগ অপেক্ষা করতে হবে।

সে সময় নতুন একটা শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি ভেবে শ্লাঘা হত। জীবনের অর্ধেক একটা শতাব্দীতে অতিবাহিত করে বাকিটা নতুন এক শতাব্দীতে কাটাব ভাবতে ভাল লাগত। মনে হত, উই মাস্ট বি দ্য চোজেন ওয়ান!

লিখছিলাম ২১ শতাব্দীর একুশে পদার্পণ নিয়ে। ২১ তো একটা বিশেষ সংখ্যা। তাই ভাবলাম একটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক। ২১ বছর বয়স হলে দুনিয়ার সব দেশে আপনি সাবালক বলে গণ্য হবেন। নিজের যে কোনও আইনি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার শুধুমাত্র আপনারই। একুশের আগেও আপনি সাবালক হতে পারেন বিভিন্ন দেশে। কিন্তু ২১ পার করার পরেও আপনি নাবালক থেকে গেলেন, এমন দেশ সম্ভবত নেই। মায়ানমার বা ইরানে আপনি পনেরোতেই সাবালক। পাকিস্তানে শুধু নারী সাবালক ১৬ বছর বয়সে। পুরুষকে অপেক্ষা করতে হয় আরও কয়েকটা বছর। এখানে বলে রাখা যাক যে, রাষ্ট্রের চোখে সাবালক হবার সঙ্গে ভোট দেওয়ার, বিবাহের, জুয়া খেলার, গাড়ি চালানোর বা মদ্যপান করার সম্পর্ক নেই। অনেক দেশেই এসব সাবালক হওয়ার আগেই করা যায়। এমনকি, দেশের হয়ে যুদ্ধেও যাওয়া যায়! একবিংশ শতাব্দী সাবালক হচ্ছে। আর এমন একটা সময়ে পৃথিবীর বহু দেশের নাবালক সৈনিক বিদেশেবিভুঁইয়ে প্রাণ দিচ্ছেন, এটা আমাদের সার্বজনীন লজ্জা।

ঘটনাচক্রে যে দিন আনন্দবাজার ডিজিটালে আমার এই নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে, সে দিন ২১ শতকের ২১তম বছরের ২১তম দিন।

একুশে ফেরা যাক। প্রথমে দু’টি অদরকারি তথ্য। এক, লুডো খেলতে বসে যদি কখনও ছক্কায় কতগুলো বিন্দু আছে গুণে দেখার ইচ্ছে হয়, তাহলে আগাম জেনে রাখুন— সংখ্যাটা হছে ২১। আর ২০১১ সাল অবধি টেবিল টেনিসে জিততে গেলে লাগত ২১ পয়েন্ট।

গুগ্‌ল ঘেঁটে জানা যাচ্ছে ডানকান ম্যাকডুগাল বলে এক চিকিৎসকের কথা। আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের এই চিকিৎসক ১৯০৭ সালে সাড়া ফেলে দেন নিজের এক অদ্ভুত নিরীক্ষার কথা জার্নালে প্রকাশ করে। ১৯০১ সাল থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে তিনি ছয’জন মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর ওজন মেপেছিলেন তাঁদের মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে এবং তাঁদের শবদেহের মৃত্যুর ঠিক পরে পরেই। ম্যাকডুগাল বলেন, প্রথমে নেওয়া ওজনের থেকে দ্বিতীয়বার নেওয়া ওজন বাদ দিলে যা পড়ে থাকে, সেটাই হল আত্মার ওজন। সেটা কত আন্দাজ করার জন্য কোনও পুরস্কার নেই— ২১ গ্রাম। বিজ্ঞানী, গুণিজন বা চিকিৎসক মহলে এই নিরীক্ষা খুব একটা কল্কে না পেলেও আমজনতার মনে একটা ধারণা জন্মে যায় যে, আত্মার সত্যি ওজন আছে এবং তা ২১ গ্রাম!

মৃত্যুর কথা যখন লিখছিই, তখন একটু যমালয় বা নরকের কথাও বলা থাক। মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি কিংবা ভাগবতে প্রাথমিক ভাবে নরকের সংখ্যা ২১। সে সব নরকের নাম নথিবদ্ধ করা থাকল এখানে। যদি কারও আগাম পছন্দ করার ইচ্ছে হয়! তামিস্র, অন্ধতামিস্র, রৌরব, মহারৌরব, কুম্ভীপাক, কালসূত্র, অসিপত্রবন, শূকরমুখ, অন্ধকূপ, কৃমিভোজন, সন্দংশ, তপ্তশূর্শ্মি, বজ্রকন্টকশাল্মলী, বৈতরণী, পূরোদ, প্রাণরোধ, বিশসন, লালাভক্ষ, সারমেয়াদন, অবীচী এবং অরঃপান। স্থানভেদে নামের ভিন্নতা আছে এবং পরবর্তীকালে প্রাচীন সাহিত্যে কোথাও কোথাও নরকের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু মূল নরকের সংখ্যা সেই ২১। এবার বাইবেল। বিশারদরা (আমার দৌড় সেই গুগ্‌ল অবধি। সুতরাং ভুল হলে যাবতীয় দায় তার) ২১ সংখ্যাটাকে ভাল চোখে দেখছেন না এখানে। তাঁদের ব্যাখ্যায় মহা ধড়িবাজ বিদ্রোহ আর পাপাচারের প্রতীক হল ২১ সংখ্যাটি। বাইবেল অনুসারে মিশরীয় নিয়ন্ত্রণের নাগপাশ কাটিয়ে উঠতে ইজরায়েলিরা অনেকগুলি বিদ্রোহ করেন। ঠিক কতগুলি? ২১।

আরও আছে। গণেশ চতুর্থীর পুজোর সময় বক্রতুণ্ড মহাকায়কে একবিংশ অর্থাৎ ২১টি শাক নিবেদন করা পুরানো রীতি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শৃঙ্খল ভাঙার জন্য ২৩ মার্চ ২০২০ প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। অনুরোধ করেন গৃহবন্দি হয়ে থাকতে। ২১ দিনের জন্য। আমেরিকায় ২১তম সংশোধনের মাধ্যমে পূর্ববর্তী জাতীয় ভাবে মদ নিষিদ্ধ করার সংশোধনীটিকে অগ্রাহ্য করার মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হয়। গড়পড়তা মানুষ ২১ বছরের পর আর শারীরিক ভাবে বাড়ে না। ফিব্বনাচ্চি সিরিজের ৮ নম্বর সংখ্যা হল ২১। ১৬৬৩ সাল থেকে ১৮১৬ সাল অবধি বিলেতে চলত ব্রিটিশ গিনি মুদ্রা। প্রতিটি গিনি মানে ২১ শিলিং। পুরনো চলতি প্রবাদ ‘নতুন অভ্যাস তৈরি হতে ২১ দিন লাগে’।

আরও একটি বিশেষ তথ্য। ২১তম অনুচ্ছেদটি ভারতীয় সংবিধানের মূল কথা। এর দ্বারা আমরা জীবনের অধিকার পাই। আইনি পদ্ধতি ব্যাতিরেকে কেউ জীবন অথবা ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হবেন না, এই মর্মে অঙ্গীকার করেছে রাষ্ট্র তার প্রতিটি নাগরিকের উদ্দেশে।

এবার এক বিশেষ একুশ। এই একুশ আমাদের হৃদয়ে, প্রতিটি ধমনী, তন্ত্রী এবং শিরায় শিরায়। আমরা, মানে যারা বাংলায় স্বপ্ন দেখি। রেগে গেলে বাংলায় গাল দিই। আমরা, যাদের জীবনের প্রথম প্রেম বাংলা ভাষার সঙ্গে। বাংলার সঙ্গে।

ঘটনার সূত্রে যেতে পিছিয়ে যেতে হবে সাত দশকেরও বেশি। কিছুদিন আগেই দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা পেয়েছে এই উপমহাদেশ। দেশকে তিন টুকরো করে তৈরি হয়েছে দুটো নতুন দেশ। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রমনার ময়দান। ১৯৪৮ সাল। ২১ মার্চ। জিন্না ঘোষণা করলেন, একমাত্র উর্দুই হবে নতুন সেই রাষ্ট্রের ভাষা। উত্তাল ছাত্র আর জনতার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে শুরু হল বাংলা ভাষার জন্য এক ঐতিহাসিক আন্দোলন। বাঙালি নিজের মাতৃভাষার ইজ্জত আর আব্রু রক্ষার জন্য সংগ্রাম শুরু করল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। কলাভবনের সামনে নিরস্ত্র ছাত্র আর সশস্ত্র পুলিসের সংঘর্ষে প্রাণ গেল ৮ জনের। পৃথিবী পেল তার প্রথম ভাষা শহিদদের। ফলস্বরূপ ১৯৫৬ সালে বাংলা স্বীকৃতি পেল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে। ভাষা আন্দোলনকে সম্মান জানিয়ে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর স্বীকৃতি দিল।

পরিশেষে দুটি চরিত্রের কথা। ওপার বাংলার প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আর এপার বাংলার কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। দু’জনেই বিদায় নিয়েছিলেন ২১ বছর বয়সে। জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী প্রীতিলতা আর খেটে খাওয়া অগণিত মানুষের কবি সুকান্ত আমাদের জানিয়ে গিয়েছেন, ২১ বছর বড় একটা কম সময় নয়। ২১ মানে শৈশবকে ফেলে এগিয়ে যাওয়া। ২১ মানে একলা চলার সাহস আর শক্তি। ২১ মানে সাবালক হয়ে ওঠা।

একুশে পৌঁছে নতুন শতাব্দী সাবালক হল সবে। সামনে লম্বা রাস্তা।

(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE