Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

যাহার শেষ নাই

কথাটি দিগ্বিজয়ী খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে যতখানি সত্য, সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও ততখানিই। সত্য, ইউসেইন বোল্টদের জীবনে সাফল্য যত ঘন ঘন আসে, সাধারণ মানুষদের সেই সৌভাগ্য হয় না।

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ইতিহাসের যে দরবারে ইউসেইন বোল্টের আসন সংরক্ষিত হইল, ইতিমধ্যেই সেই কক্ষ আলো করিয়া রহিয়াছেন ডন ব্র্যাডম্যান ও মাইকেল শুমাখারের ন্যায় খেলোয়াড়রা। যে সাফল্য তাঁহাদের খেলোয়াড় জীবনের সর্বাঙ্গে ছাপ ফেলিয়াছে, পেশাদার জীবনের শেষ খেলায় তাহার সন্ধান এই খেলোয়াড়রা পান নাই। ক্রিকেটের প্রচলিত গল্প, শেষ ইনিংসে ব্র্যাডম্যান নাকি আবেগতাড়িত হইয়া পড়ায় বল দেখিতে পান নাই। গল্পটিতে কয় আনা সত্য, সে বিচার বাদ রাখিলেও বলা চলে, ২০১৭ সালের পেশাদারিত্ব আবেগকে ততখানি জায়গা ছাড়িবে না যাহাতে ইউসেইন বোল্ট তাঁহার জীবনের শেষ দৌ়ড়টি তৃতীয় স্থানে শেষ করিবেন। সেই দৌড়ে জাস্টিন গ্যাটলিন-এর পেশির নিকট তিনি হারিয়াছেন। প্রশ্ন হইল, শেষ খেলায় ব্যর্থতাকে কী ভাবে দেখা উচিত? ব্র্যাডম্যান বা সচিন তেন্ডুলকর শেষ ইনিংসে শতরান করিলে, অথবা ইউসেইন বোল্ট আরও একটি নূতন রেকর্ড স্থাপন করিয়া শেষ দৌড়টি জিতিলে তাহা রূপকথার পরিসমাপ্তি হইত। কিন্তু, বাস্তব কদাচিৎ রূপকথা হইয়া উঠে। ভক্তদের মনে অনপনেয় খেদ থাকিয়া যাইতেই পারে— তাঁহাদের হৃদয়সম্রাটের রেকর্ড নিটোল হইল না। কিন্তু, খেলোয়াড়রা জানেন, সব খেলায় জেতা যায় না। তাহাতে একটি চিনচিনে দুঃখবোধ থাকিতে পারে, কিন্তু তাহার অধিক নহে। কারণ, যাঁহারা আপন প্রতিভা ও নিষ্ঠার জোরে মাঠ শাসন করেন, তাঁহারা জানেন, একটি সাফল্য বা একটি ব্যর্থতায় তাঁহাদের বিচার হয় না। শুধু শেষ পৃষ্ঠা পড়িয়া মত দেওয়ার অভ্যাস ইতিহাসের নাই।

কথাটি দিগ্বিজয়ী খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে যতখানি সত্য, সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও ততখানিই। সত্য, ইউসেইন বোল্টদের জীবনে সাফল্য যত ঘন ঘন আসে, সাধারণ মানুষদের সেই সৌভাগ্য হয় না। তাঁহাদের ব্যর্থতা, বড় জোর খুব বেশি মার না খাওয়া লইয়াই বাঁচিতে হয়। অতএব, একটি পরীক্ষায় ধরাশায়ী হওয়া, অথবা একটি প্রেমে তুমুল প্রত্যাখ্যান তাঁহাদের নিকট বেশ জোরদার ধাক্কা। আরও এক বার নিজেকে প্রমাণ না করিতে পারিবার, পরিপার্শ্বের চোখে ছোট হইয়া যাইবার গ্লানি। সেই ‘ব্যর্থতা’কেই জীবনের অন্তিম স্টেশন ভাবিয়া লইবার প্রবণতা ক্রমে বাড়িতেছে। ইউসেইন বোল্টদের নিকট ব্যর্থতাকে অতিক্রম করিবার একটি জরুরি পাঠ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আছে। জীবনের শেষ দৌড়ে হারিয়া যাওয়া, অথবা জীবনের শেষ ইনিংসে শূন্য রানে প্যাভিলিয়নে ফেরা— এই ‘ব্যর্থতা’কে শুধরাইয়া লইবার কোনও উপায় তাঁহাদের নাই। কিন্তু, ত‌াঁহারা জানেন, এই ব্যর্থতার আগেও জীবন ছিল, পরেও থাকিবে। সেই জীবনটিকে বাঁচিয়া লওয়া অনেক বেশি জরুরি। সময়ের দূরত্ব হইতে দেখিলে সাফল্য ও ব্যর্থতা, উভয়ের মাপই চোখে কম ঠেকে। কৈশোরে যে প্রেম ভাঙিয়া গেলে জীবন অর্থহীন ঠেকে, প্রৌঢ়ত্বের দূরত্ব হইতে সেই প্রেম এবং তাহার ভাঙিয়া যাওয়ার যন্ত্রণা, দুইই হাস্যকর বোধ হয়। নিজেদের এই সময়ের দূরত্বটি দেওয়া নিজের প্রতি প্রত্যেকটি মানুষের কর্তব্য। অবসন্ন হইয়া যাঁহারা ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ গোত্রের অন্ধকারকে বাছিয়া লইতেছেন, তাঁহারা ইউসেইন বোল্টের দিকে চাহিয়া শিখিয়া লইতে পারেন, শেষ বলিয়া কিছু নাই। শেষ ব্যর্থতাও, অতএব, নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE