Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
একেই তবে বলে গণতন্ত্র
U.S Presidential Election 2020

এত কিছুর পরেও অর্ধেক আমেরিকার ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প

এই ভোটের বহিরঙ্গের অর্থ যদি এটা হয়, ভিতরের গভীর ও নিহিত অর্থটা কী, নতুন করে ভাবতে হবে।

ভোট-যন্ত্রণা: ব্যালট-গণনা মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা শুনে রাস্তায় জনবিক্ষোভ, নিউ ইয়র্ক, ৪ নভেম্বর। রয়টার্স

ভোট-যন্ত্রণা: ব্যালট-গণনা মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা শুনে রাস্তায় জনবিক্ষোভ, নিউ ইয়র্ক, ৪ নভেম্বর। রয়টার্স

সেমন্তী ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২০ ০১:০৮
Share: Save:

জেতাটা সহজ, হারা মোটেই সহজ নয়। ‘নট ফর মি’— আমার পক্ষে তো নয়ই। কত মিলিয়ন মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছেন, আর এক দল বাজে লোক এখন তাদের মতকে ধামাচাপা দিতে চাইছে। না, আমরা কিছুতেই তা হতে দেব না।— কার বাক্য উদ্ধৃত করছি, আর বলতে হবে কি?

ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের পর দিন বললেন এ কথা। ‘‘আমরা না জিতলেই বোঝা যাবে, ভোট রিগ করা হয়েছে।’’ এ সব বাক্য ঠিক গণতন্ত্র-মাফিক নয়, তবে তাতে কী-ই বা এসে যায়। ট্রাম্প যে গণতন্ত্রে থোড়াই কেয়ার করেন, সে কি আর নতুন কথা?

নতুন কথা কেবল এইটুকুই— আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগণনা কবে কখন শেষ হবে, হলে তার ফল কী দাঁড়াবে, এই সবের মধ্যে না ঢুকেই একটা সিদ্ধান্ত সম্ভব: ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘জিতে’ গিয়েছেন। ভোটের দিনেই উপরের এই সব কথা যে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট বলতে পারেন, যিনি বলতে পারেন, কোনও মতেই নিজের হার মেনে নেবেন না, হার হলে ধরে নেবেন সেটা ভুয়ো রেজ়াল্ট; যিনি বলতে পারেন, তাঁকে কেউ হোয়াইট হাউস থেকে বার করতে পারবে না; বলতে পারেন, সংবিধান যা-ই বলুক, বারো বছর টানা শাসন করবেনই; যিনি বলতে পারেন, সব ভোট মোটেই গুনতে দেবেন না; যাঁর কথার প্রতিবাদে প্রাচীন গণতান্ত্রিক দেশটিকে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাতে হয় ‘‘প্রতিটি ভোট গুনতে হবে’’ বলে— এমন নেতাকে আমেরিকার মানুষ উজাড় করে ভোট দিয়েছেন। যে রিপাবলিকান পার্টি এক দিন দেশকে আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো নেতা উপহার দিয়েছিল, আজ সেই দলের একমেবাদ্বিতীয়ম্ নেতা হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার হৃদয়ের অর্ধেকটা জিতে নিয়েছেন!

আক্ষরিক অর্থে অর্ধেকটা। দেশটা আজ সম্পূর্ণ দুই ভাগে বিভক্ত। একশো বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে এই বার, এবং এখনও অবধি সেই ভোটের প্রায় অর্ধাংশ (৪৮.২ শতাংশ) গিয়েছে ট্রাম্পের নামে। ক্ষমতাসীন নেতার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার যে সাধারণ প্রবণতা দেখা যায় গোটা দুনিয়ায়, যাকে বলে স্থিতাবস্থা-বিরোধিতা, তা মোটে কাজ করেনি। শতাব্দীর অঘটন অতিমারি কোভিড-১৯’এর ব্যর্থ মোকাবিলা, বিপুল প্রাণক্ষয়, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সংক্রমণ, সম্পূর্ণ ভুল নীতি— কিচ্ছু প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে যায়নি। অর্থনীতির ম্লানতা, চাকরির হাহাকার, কিছুই দাগ কাটতে পারেনি। বরং তাঁর সমর্থকরা সগর্বে বলেছেন অর্থনীতির অবস্থা এই পরিস্থিতিতেও যথেষ্ট ভাল, ট্রাম্প ঠিক দিকেই দাঁড় টানছেন। দেশ জুড়ে আগুন জ্বলছে— বর্ণবিদ্বেষের, জাতিবিদ্বেষের, অভিবাসী-বিদ্বেষের; কিন্তু অর্ধেক আমেরিকা মনে করছে, কালোরা আর অভিবাসীরা আছে বলেই এত ঝামেলা, ট্রাম্প থাকলে বরং তাদের দাবিয়ে রাখা যাবে, ‘আইনশৃঙ্খলা’ বজায় রাখা যাবে। আইনশৃঙ্খলার আচ্ছাদন পরিয়ে যে রাস্তায় লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে বিদ্বেষবিষকেই, তার ধারক ও বাহকরা ট্রাম্পের কোনও দোষ মানেননি। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির মামলা, গোটা পঁচিশেক নারী-নিগ্রহের অভিযোগ, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ, সব তাঁরা তুড়ি দিয়ে উড়িয়েছেন, ক্ষমাসুন্দর হেসে বলেছেন বয়েজ় উইল বি বয়েজ়, ও’রকম তো হয়েই থাকে— চিনকে কেমন মজা দেখাচ্ছে সেটাই বলো!

এই যাঁদের মনোভাব, গণতন্ত্র বস্তুটা নিয়ে যে তাঁদের মাথাব্যথা শূন্য, তাতে আর আশ্চর্য কী। তাঁদের প্রেসিডেন্ট কী ভাবে আমেরিকার গণতন্ত্রকে বিপন্ন করছেন, খামোকা এই সব সাতপাঁচ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তাঁরা দলে দলে বেরিয়ে এসে ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পকে। হ্যাঁ, হতে পারে যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভোট পাওয়ার রেকর্ড পকেটে পুরেছেন, জিতুন আর না-ই জিতুন। কিন্তু সে তো সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভোটদাতা এ বার বেরিয়ে পড়ে ভোট দিয়েছেন বলে। আসল ছবিটা হল, একই কারণে ট্রাম্পের ঝুলিও এ বার ভরে উঠেছে বিপুল ভোটে। ২০১৬ সালে যদি ৪৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতে থাকেন, এ বার তাঁর পক্ষে আরও দুই শতাংশেরও বেশি ভোট পড়েছে— যে কোনও ক্ষমতাসীন শাসকের পক্ষে বিশাল কৃতিত্ব! ট্রাম্পই এই খেলার আসল জয়ী। তাঁর দৌলতে সেনেট-তরীও রিপাবলিকান কূলে ভিড়তে পেরেছে।

এই ঐতিহাসিক দুঃখমুহূর্তে মধ্যবাদীরা, লিবারালরা, বামপন্থীরা অন্য নানা যুক্তিতে যদি দুঃখ ভুলে থাকতে চান, ভুলে থাকতে পারেন। ম্যাজিক সংখ্যা ২৭০ পেরিয়ে যেতেই পারেন বাইডেন। আদালতের রায় আসতে কত দিন, কত সপ্তাহ, তার ঠিক নেই, সেই রায়েও বাইডেন বেঁচে যেতেই পারেন। কিন্তু তিনি ও তাঁর পক্ষে যে বাকি অর্ধেক দেশবাসী— তাঁরা কি ভুলতে পারবেন যে, এমন ভয়ঙ্কর চার বছরের পরও ট্রাম্প তাঁদের সঙ্গে এই ভাবে মাথায় মাথায় টক্কর দিয়েছেন? ভুলতে কি পারবেন যে, ভোট-পণ্ডিতদের হিসেব বানচাল করে, দুই প্রার্থীর মধ্যে ৮.৪ শতাংশের দূরত্বের পূর্বাভাস মিথ্যে প্রমাণিত করে দিয়েছে আমেরিকান সমাজ?

কেবল জনভোটের শতাংশের হিসেবই বা কেন। আমেরিকায় ইলেক্টরাল প্রতিনিধিত্বের যে বন্দোবস্ত আছে, সেই ইলেক্টরাল সংখ্যার দিক দিয়েও ব্যাপারটা ভাবা জরুরি। ২০০০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই হিসেবটার দিকে চোখ রাখলে কী দেখি আমরা? ২০১৬ সালে ট্রাম্প ৩০৪, হিলারি ২২৭। ২০১২ সালে ওবামা ৩৩২, রমনি ২০৬। ২০০৮ সালে ওবামা ৩৩৫, ম্যাকেন ১৭৩। ২০০৪ সালে জর্জ ডবলিউ বুশ (জুনিয়র) ২৮৫, কেরি ২৬১। আর ২০০০ সালে বুশ (জুনিয়র) ২৭১, আল গোর ২৬৬। অর্থাৎ, এই বারে পেনসিলভ্যানিয়া ও বাকি দু’একটি স্টেট ট্রাম্পের পক্ষে গেলে বাইডেন ও ট্রাম্পের যে ছোট মার্জিন দাঁড়াবে, তার তুলনীয় দূরত্ব এর আগে ছিল একমাত্র ২০০০ সালে, দুই দশকেরও বেশি আগে— সে বারও কিন্তু বিষয়টা কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল, এবং কোর্টের মধ্যস্থতাতেই শেষ অবধি দান পাল্টিয়ে বুশ জিতে গিয়েছিলেন।

কে বলতে পারে, এ বারও তেমন হতে পারে, ছোট মার্জিনের এ-দিক ও-দিক পাল্টে যেতে পারে, কোর্টের দান পড়তে পারে ট্রাম্পের পক্ষে। সে বার কুনাট্যমঞ্চ ছিল ফ্লোরিডা, এ বার হয়তো হতে পারে পেনসিলভ্যানিয়া। আমেরিকানরা দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁদের পছন্দ-অপছন্দ, মূল্যবোধ। দেখিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের অর্ধাংশ এই দানব-শাসনই চান, আবার!

আর একটা কথাও আজ আর না মানলেই নয়। এই ভোট দেখিয়ে দিয়েছে, শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা সর্বাধিক সংখ্যায় ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। কথাটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। এর অর্থ এই নয় যে, অশ্বেতাঙ্গরা ট্রাম্পকে ভোট দেননি— বাস্তবিক, হিসপ্যানিকরা, কালোরা ২০১৬ সালের চেয়ে বেশি সংখ্যায় ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। এর অর্থ এটাও নয় যে, শ্বেতাঙ্গরা বাইডেনকে ভোট দেননি— বাইডেনের ভোট বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যাবে কত সাদা, কত কালো, কত অভিবাসী আছেন তার মধ্যে। কথাটা আসলে এই যে, প্রাথমিক বিশ্লেষণ বলে দিচ্ছে, সাদা আমেরিকানদের প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে তিন জন এ বার রিপাবলিকান পার্টিকে— না, ট্রাম্পকে— ভোট দিয়েছেন। গৌরবে দলবচন করার দরকার নেই। এই ভোট দলের নয়, এই ভোট ছিল ট্রাম্পের একার। তিনি নিজেই তা বার বার বলেছেন। বাইডেনও শুধু ট্রাম্পকে নিয়েই কথা বলেছেন। গোটা দেশের সমস্ত প্রচারেও থেকেছেন— তিনি, শুধু তিনি! সেই দিক থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন না বলে একে প্রেসিডেন্টের নামে গণভোট বা রেফারেন্ডাম বলা যায়। বলা যায়, গণতন্ত্রের নামে একাধিপত্যের তন্ত্র।

এই ভোটের বহিরঙ্গের অর্থ যদি এটা হয়, ভিতরের গভীর ও নিহিত অর্থটা কী, নতুন করে ভাবতে হবে। হয়তো এও ভাবতে হবে যে, ভাবার মতো আর কিছু আছে কি না। যে আমেরিকা ট্রাম্পকে চায়, গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখালে যার কিছুই এসে যায় না, তার অর্ধেকের মনে যে বর্ষার ভরা নদীর মতো কূল-ছাপানো বর্ণবিদ্বেষ আর অভিবাসী-বিদ্বেষ, তা আজ পরিষ্কার। এও পরিষ্কার যে, আমেরিকার মধ্যে একটা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এত দিন আমেরিকা যুদ্ধ করেছে এ দেশে ও দেশে। এ বার সে যুদ্ধে নেমেছে নিজের মাটিতেই, নিজের একাংশের সঙ্গে অন্য অংশের কুরুক্ষেত্র লেগে গিয়েছে আজ।

প্রসঙ্গত, বাইডেন তাঁর ভোট-প্রচারের শেষ লগ্নে জর্জিয়ায় বললেন ঐতিহাসিক ‘নিউ ডিল’-এর কথা, প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজ়ভেল্ট-এর কথা। জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট রুজ়ভেল্ট-এর নিউ ডিল ছিল সব যুদ্ধ-সংঘর্ষ থেকে বেরিয়ে আসার সন্ধান। হয়তো বাইডেনও সংঘর্ষ-পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে বিকল্প জাতীয় ঐক্য খুঁজতেই ও কথা তুলেছিলেন, কেননা ‘এভরিথিং এলস ইজ় অ্যাবাউট ওয়ার’।

আজ বাইডেন জয়ী হয়ে হোয়াইট হাউসে ঢুকতে পারুন আর না পারুন, তিনি ও তাঁর আমেরিকা ঠিক এই জায়গাটাতেই পরাজিত। অর্ধেক আমেরিকা আজ ‘যুদ্ধ’ চায়। বাইরের নয়, ভিতরের যুদ্ধ। এই ভোটের ফলাফলে তারই বার্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE