Advertisement
E-Paper

ভোটের ধারা তা হলে পাল্টাচ্ছে

২০১৯ সালের আগে পর্যন্ত বিজেপি এবং কংগ্রেসের সম্মিলিত ভোট মোটামুটি ঘোরাফেরা করেছে ঠিক ৫০ শতাংশের আশেপাশে।

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৯ ০০:০৩

ভারতের রাজনীতিতে এই লোকসভা ভোটের আগে জাতীয় দলের তকমা ছিল সাতটি দলের। এ ছাড়াও রয়েছে ৩৬টি রাজ্য-স্বীকৃত দল, ৩২৯টি আঞ্চলিক দল, আর ২,০৪৪টি রেজিস্টার্ড অস্বীকৃত দল। বিশাল দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় বৈচিত্রে ভরা বিভিন্নতা লালিত হয়, ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিচিত্রতা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রশ্রয় পায় এই সমস্ত রাজনৈতিক দলের মধ্য দিয়ে। তাই, স্বাভাবিক ভাবেই, বিজেপি ও কংগ্রেস ছাড়া বাকি দলগুলির সম্মিলিত সমর্থনের ভিত্তিও বেশ বড়ই।

দেশের চার অকংগ্রেসি, অবিজেপি প্রধানমন্ত্রী, ভিপি সিংহ, চন্দ্রশেখর, দেবগৌড়া এবং গুজরালের সম্মিলিত শাসনকাল মাত্র ১,২২২ দিন। বাকি সময়কালের পুরোটাই শাসন করেছেন কোনও না কোনও কংগ্রেসি বা বিজেপি প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ঠিক কতটা জনসমর্থন ছিল এই দুই দলের?

১৯৮৪ থেকে নির্বাচনী ফল ঘেঁটে দেখা যেতে পারে, কারণ ওই বছরেই প্রথম নির্বাচনী রাজনীতিতে আসে বিজেপি। তার পরের নির্বাচনে ১৯৮৯ সালে সূত্রপাত হয় জোট রাজনীতির। ১৯৮৪ থেকে লোকসভা নির্বাচন হয়েছে দশটা। এর মধ্যে ১৯৮৪ আর ১৯৯১-এর নির্বাচনে যথাক্রমে ইন্দিরা গাঁধী আর রাজীব গাঁধীর হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে জনমত উপচে পড়েছে কংগ্রেসের বাক্সে। তবু, এই দুই নির্বাচনে কংগ্রেস ও বিজেপির ভোট-শতাংশ একযোগে ছিল ৫৬-র কাছাকাছি। এই দুই বার ছাড়া, ২০১৯ সালের আগে পর্যন্ত বিজেপি এবং কংগ্রেসের সম্মিলিত ভোট মোটামুটি ঘোরাফেরা করেছে ঠিক ৫০ শতাংশের আশেপাশে। বড়জোর ২ শতাংশ এদিক-ওদিক। গড়ে ৫০.১২%। এর অর্থ হল, দেশের ঠিক অর্ধেক ভোটদাতা ভোট দিয়েছে বিজেপি আর কংগ্রেসের বাইরে তৃতীয় কোনও দলকে।

আসন-সংখ্যা যে ভোট শতাংশের সঙ্গে সরলরেখায় বাড়ে না, সে আমরা জানি। বিশেষ করে বহুদলীয় গণতন্ত্রে অঙ্কটা ভয়ঙ্কর রকমের জটিল। ঠিক সে কারণেই অর্ধেক পরিমাণ ভোট কিন্তু গড়ে ৩০৫টি আসন দিয়ে এসেছে বিজেপি এবং কংগ্রেসকে, সম্মিলিত ভাবে। বিজেপি এবং কংগ্রেসের মোট আসন সবচেয়ে কম হয়েছিল ১৯৮৯-তে, যখন ২৮২টি আসন পেয়েছিল এই দুই দল মিলে। আর ২০১৪তে প্রবল মোদী হাওয়ায় এদের মিলিত আসন হয় সব চাইতে বেশি, ৩২৬টি। মজার কথা হল, এই দুই দল মিলে ভোট শতাংশ সবচেয়ে কম বা বেশি কিন্তু এই দুই নির্বাচনে হয়নি। ২০০৯ সালে একেবারে কম হয় দুই দলের ভোটের যোগফল, যা আবার সবচেয়ে বেশি হয় ১৯৯৯ সালে। অন্য দলগুলি (যাদের অনেকে আবার বিজেপি ও কংগ্রেসের শরিক) অর্ধেক ভোট আর গড়ে ২৩৮টি আসন নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিল তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।

এমন একটা রাজনৈতিক আবহে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ২০১৯ কিন্তু সেই নির্বাচনী কালচারে একটা বড়সড় ধাক্কা। রাশিবিজ্ঞানের ভাষায় আমি একে বলব ‘চেঞ্জ পয়েন্ট’, এক পরিবর্তনের বিন্দু। বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখা যাক।

এই নির্বাচনে বিজেপি একাই পেয়েছে ৩০৩টি আসন, আগের বারের থেকে ২১টি বেশি। আর কংগ্রেস ৫২টি, ২০১৪-র চাইতে ৮টি বেশি। মোটের উপর সম্মিলিত ভাবে ৩৫৫টি আসন পেয়েছে বিজেপি এবং কংগ্রেস মিলে, যা ১৯৮৪ এবং ১৯৯১ বাদে গত সাড়ে তিন দশকের গড়ের চাইতে ৫০টি বেশি। যা মোট আসন-সংখ্যা ৫৪৩-এর ৯%-এরও বেশি। ভোটের শতাংশে বিজেপি ৩৭.৪, কংগ্রেস ১৯.৫, যোগ করলে ৫৭%, যা আগে হয়নি কখনও। ১৯৮৪ আর ১৯৯১-এর ব্যতিক্রমী নির্বাচনেও নয়।

আপাত ভাবে একে বিজেপির বিপুল উত্থানের সঙ্গে এক করে দেখা যেতেই পারে। আমি কিন্তু অতটা সরলীকরণ করতে চাই না। বিজেপির এই উত্থানটা কেবল কংগ্রেসের ঘর ভেঙে হয়নি। এত দিন ধরে বিজেপি ও কংগ্রেসের মোট সমর্থন ভিত্তি প্রায় ধ্রুবক থাকার অর্থ, এই দুই দল ছাড়া অন্য দলগুলির সমর্থন-ভিত্তি মোটামুটি অটুট ছিল বছরের পর বছর। সেই ভিতে ধস নেমেছে এ বার।

স্পষ্টতই প্রভাব কমছে অন্য দলগুলির, যাদের প্রায় সবারই প্রভাব অঞ্চল-বিশেষে সীমাবদ্ধ। আপাতদৃষ্টিতে কেরলে কংগ্রেসের সাফল্য ও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অভূতপূর্ব হাওয়ায় তৃণমূলের আসন কমে যাওয়াটা এর কারণ। কিন্তু কেরলে বামেদের এই ধরনের বিপর্যয় হয়েছে ২০০৯-এও। পশ্চিমবঙ্গেও কংগ্রেস বেশ কিছু আসন পেয়েছে এক দশক আগেও। তাই সার্বিক ভাবে এটা অবিজেপি ও অকংগ্রেসি শক্তির প্রভাব হ্রাস। দেশ জুড়ে।

এমনিতে যে-কোনও নির্বাচনে জনসমর্থন এক দল থেকে অন্য দলে সরে যাওয়াটা নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রবাহ। বিশেষ করে দেশের বিপুল সংখ্যক জনতাই তো ‘ফ্লোটিং ভোটার’, যাঁদের সমর্থনের ভিত্তি ভীষণ ঝুরঝুরে। এঁদের মধ্যে কিছু হয়তো মানসিক ভাবে একেবারেই স্বতন্ত্র, প্রতিটা নির্বাচনে বিভিন্ন দল এবং প্রার্থীর ওজন তুলাযন্ত্রে মেপেই ভোট দেন। কিছু আবার কোনও না কোনও দলের হালকা সমর্থক। কিন্তু খুব সহজেই এঁরা বদলান এঁদের সমর্থনের অভিমুখ। এ ছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রবল আধিপত্যের যুগে অল্পবয়স্ক ভোটাররা, এবং সেই সঙ্গে শহুরে মধ্যবিত্ত মানসিকতার অনেকেরই রাজনৈতিক সমর্থনের ভিত্তি দৃঢ় নয়। এঁরা খুব সহজেই ইভিএম-এর বোতাম বদলান। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষিতে এই ফ্লোটিং ভোটারদের অনুপাত হিসেব করা হয়েছে প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ। আমাদের দেশে কোনও রাজনৈতিক দলের গত তিন দশকে সমস্ত নির্বাচন মিলিয়ে পাওয়া সবচেয়ে কম ভোট শতাংশকে সেই দলের পক্ষে ‘কমিটেড’ ভোট ধরা যেতে পারে। যেমন ২০১৪-তে কংগ্রেস পেয়েছিল ১৯.৫ শতাংশ। সমস্ত দলের ‘কমিটেড’ ভোট যোগ করলে হয় ৫০%-এর কাছাকাছি। তাই দেশের প্রায় অর্ধেক ভোটারই হয়তো ‘ফ্লোটিং’, যাঁরা ভেসে চলেন ‘হাওয়া’-য়।

এর অর্থ? এঁদের সমর্থন সহজেই সরে যেতে পারে এক দল থেকে অন্য দলে। আর সে জন্যেই তো নির্বাচনে ভোটারের মন পেতে প্রচারের এত ঘটা। তবে এত দিন প্রায় আধাআধি জনতা ভোট দিচ্ছিলেন তৃতীয় পক্ষকে। এ বারের ভোটে স্পষ্টতই তৃতীয় পক্ষকে সমর্থন করা ‘ফ্লোটিং ভোটার’-দেরও বড় অংশ ভোট দিয়েছেন দুই বড় দলের একটিকে।

ভারতের ভোটাররা কি তবে ক্রমশ একাত্ম হচ্ছেন সর্বভারতীয় দলগুলির ছাতার তলায়? সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র-গবেষকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, অনেকেই অঞ্চল-ভিত্তিক দলগুলির সুস্পষ্ট অস্তিত্বের পক্ষে। অনেকে আবার মনে করেন, ভালই তো, এর ফলে বৈচিত্র ঘুচিয়ে ভারত যেন ক্রমে ‘একাত্ম’ হচ্ছে, অন্তত রাজনৈতিক সোপান ধরে।

তাত্ত্বিক আলোচনা চলতেই পারে। এক ‘ধর্মরাজ্য’ই ভাল, না কি, খণ্ড, ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ভারতই অভিপ্রেত, সে তর্কও চলতে পারে। কিন্তু গণতন্ত্র এখনও চমক দেয়, এটাই কথা।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত

লোকসভা নির্বাচন ২০১৯ Lok Sabha Election 2019 Congress BJP
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy