Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

নিঃসীম অবিশ্বাস নিয়ে পাশাপাশি

ইজরায়েলি ও প্যালেস্টিনীয়, দুটি অঞ্চলেই মাসখানেক থেকে, বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে, বহু ঘটনা দেখে মনে হয়েছে, সমস্যার মূলে আছে দুটো জিনিস: পারস্পরিক ঘৃণা ও অবিশ্বাস।ইজরায়েলি ও প্যালেস্টিনীয়, দুটি অঞ্চলেই মাসখানেক থেকে, বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে, বহু ঘটনা দেখে মনে হয়েছে, সমস্যার মূলে আছে দুটো জিনিস: পারস্পরিক ঘৃণা ও অবিশ্বাস।

আর একটি দেহ। গাজায় ইজরায়েলি হানার পরে। ২০ জুলাই। ছবি: এএফপি

আর একটি দেহ। গাজায় ইজরায়েলি হানার পরে। ২০ জুলাই। ছবি: এএফপি

দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৪ ০০:২৫
Share: Save:

এ লেখা যখন তৈরি হচ্ছে, তখন সামনে নিউজ চ্যানেলের পর্দায় পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধের ধোঁয়া ভাসছে। জুলাইয়ের ১৬ তারিখ পর্যন্ত গাজার ১৬৫৩টি নিশানায় আঘাত হেনেছে ইজরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র। প্রাণ গেছে ২১৪ জনের। বুধবার ইজরায়েলি গানবোট থেকে ছোড়া শেলের আঘাতে প্রাণ গেছে গাজার সমুদ্রতটে খেলতে থাকা চার প্যালেস্টিনীয় বালকের। অন্য দিকে, সে দেশের মিসাইল প্রতিরোধী আয়রন ডোম-এর আড়াল ছিন্নভিন্ন করতে চেয়েছে হামাসের কমজোরি রকেটের ১২৪১টি আক্রমণ। রিং-এর বাইরে বিশ্বশান্তির রক্ষাকর্তারা প্রায় নিঃশব্দ দর্শক। ইজরায়েল প্রস্তুত ভূমিপথে সম্ভাব্য সরাসরি আক্রমণ শানানোর জন্য।

সংখ্যাগুলো একটু-আধটু এদিক-ওদিক করে নিলে এ ছবিটা কিন্তু গত অনেক বছর ধরে ঘটে যাওয়া এই রকম বহু ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘর্ষের ছবির সঙ্গে মিলে যায়। নকশাটা একই। দুটো প্রতিবেশী জাতি কিছু কাল চুপচাপ থাকে আর তার পর হঠাৎ করে মৃত্যু উগরে দেবার চেষ্টা করে একে অন্যের বুকে। এক জনের শক্তি বেশি, আত্মরক্ষার ক্ষমতাও বেশি। ক্ষতি তার কম হয়। অন্য জন দুর্বলতর প্রতিপক্ষ, মারটা সে-ই খায় বেশি, কিন্তু তাতে তার ভেতরের আগুনটা নেভে না, যেমন নেভে না শক্তিশালী পক্ষের রক্ততৃষ্ণাও। এক বার মারবার পর আবারও সে মরণ মার দেয়। পুনরাবৃত্তির চাকা ঘুরতে থাকে অবিরাম।

গত কয়েক দশকে যে ক’টা উল্লেখযোগ্য যুদ্ধবিগ্রহ ঘটেছে পশ্চিম এশিয়ায়, তার মূলটা ঘাঁটলে চোখে পড়বে, সেগুলো ঘটে গেছে অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ এবং স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠিটির দখল নেওয়ার উদ্দেশ্যে। এইখানেই ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের মধ্যে চলা ক্রমাগত লড়াইয়ের তফাত। কিছু কাল আগে কর্মসূত্রে ইজরায়েলি ও প্যালেস্টিনীয়, দুটি অঞ্চলেই মাসখানেক ধরে থেকে, বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে, বহু ঘটনা স্বচক্ষে দেখে মনে হয়েছে, এ সমস্যার মূলে আছে দুটো জিনিস: অবিমিশ্র পারস্পরিক ঘৃণা ও অবিশ্বাস।

একটা উদাহরণ দিই। আমাদের মূল কাজটা ছিল প্যালেস্টাইন-কেন্দ্রিক। গাজা স্ট্রিপে ভূমধ্যসাগরের পাশে ওঁদের কর্তাব্যক্তিদের একটা কন্টেনারের তৈরি বাড়িতে আমাদের কোয়ার্টার্স ছিল। পাশে একটা হাঁসের পোলট্রি। এক দিন গভীর রাতে তাদের ডাকে অস্থির হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে চোখ বাড়াতে মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি বয়ে গিয়েছিল। দুজন কালো পোশাকধারী মানুষ অস্ত্রশস্ত্রে সেজে নিঃশব্দে পাক দিয়ে চলেছে বাড়িটাকে ঘিরে। ঘণ্টা কয়েক পরে ফের এক বার জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। অতন্দ্র মানুষটি এক ভাবে ঘুরে চলেছে। পর দিন কাজ শুরু করবার আগে ব্যাপারটা কর্তাব্যক্তিটিকে জানাতে, ব্যাপারটা আমরা যে টের পেয়েছি, তাতে তিনি একটু অবাক হলেন। তার পর জানালেন, ওতে ভয়ের কিছু নেই। আমাদের নিরাপত্তার জন্যই তাঁরা এ ব্যবস্থাটা করেছেন। বলা যায় না, বিদেশি অতিথিদের ওপরে প্রতিবেশী দেশটি যদি কোনও হামলা চালায়...

সে সময় দু’দেশে শান্তির অধ্যায় চলছে। সেই প্রতিবেশী দেশটিও আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র, তাদের এয়ারপোর্ট দিয়ে তাদেরই দেওয়া ভিসা নিয়ে আমরা যে এসেছি, সে কথাতেও কোনও কাজ হল না। তাঁর একটাই কথা: এদের বিশ্বাস নেই। যত দিন সে দেশে ছিলাম, একা কোথাও যাওয়ার সুযোগ মেলেনি। সব সময়েই ছায়ার মতো সঙ্গে সঙ্গে অনুসরণ করে গেছেন সদাসতর্ক অস্ত্রধারী প্রহরী। এক বার একটু স্বাধীনতার লোভে তাঁকে ফাঁকি দিয়ে গাজার একটা বাজারের মধ্যে গিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম। সেখানে প্রবল ভিড়ভাট্টা। তারই মধ্যে একটা ছোট দোকানে ঢুকে কিছু কেনাকাটা করে নেওয়ার চেষ্টা ছিল। ঠিক দশ মিনিট সময় লেগেছিল তাঁর সদলবলে আমাকে খুঁজে নিতে। রক্ষীটির চোখে নিঃসীম আতঙ্কের ছাপ দেখেছিলাম সে দিন। জানিয়েছিলেন, তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে আমায় অপহরণ করা হয়ে গেছে।

মুদ্রার বিপরীত দিকের ছবিটা চোখে পড়েছিল আর এক দিনের ঘটনায়। শক্তিশালী প্রতিবেশীও কী ভয়াবহ আতঙ্কে ভোগে তার কমজোরি শত্রুটিকে নিয়ে, দেখেছিলাম ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে। এক দিন সকালবেলা রামাল্লা ছাড়িয়ে একটা ছোট জনপদ দিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ আমাদের প্যালেস্টিনীয় ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে রাস্তার এক পাশে ইঞ্জিন বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেল। এয়ারকন্ডিশনার বন্ধ হয়ে গরম ঠেকছিল। কাচ নামাতে যেতে বাধা দিয়ে সে বলে, করবেন না, বিপদ হবে।

খানিক বাদে দেখি রাস্তা দিয়ে একটা কনভয় আসছে। দুটো অস্ত্রশস্ত্রে সাজানো সাঁজোয়া গাড়ি তাদের মাঝখানে একটা স্কুলবাসকে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলেছে। বাসের মাথাতেও একটা মেশিনগান বসানো। তার মধ্যে নিঃশব্দে বসে আছে অনেক ছোট ছোট ইহুদি ছেলেমেয়ে। প্যালেস্টাইন নিয়ন্ত্রিত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের মধ্যে যে ইহুদি সেটলমেন্টগুলো আছে, তার একটা সেটলমেন্টের বাচ্চারা অন্য সেটলমেন্টের স্কুলে চলেছে পড়তে। মাঝখানে প্যালেস্টিনীয় পথ ধরে যাওয়ার সময় প্রতিদিনই তারা সাঁজোয়া গাড়ির নিরাপত্তায় যাওয়া-আসা করে। ড্রাইভারের থেকে জানা গেল, এই সময় কোনও প্যালেস্টিনীয় গাড়ি কাছাকাছি থাকলে, তার পথের এক পাশে দরজা-জানালা বন্ধ করে, ইঞ্জিন থামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাটাই দস্তুর। অন্যথায় স্কুলবাসের পাহারাদার ইহুদি সেনারা আগে গুলি চালিয়ে তার পর প্রশ্ন করবার কথা ভাববে। অবিশ্বাস ও তার থেকে গড়ে ওঠা আতঙ্ক কোন পর্যায়ে গেলে এমনটা হয় ভেবে গা শিউরে উঠেছিল গাড়ির পলকা নিরাপত্তার ভেতরে বসে। এ গাড়ির নম্বর যে প্যালেস্টাইনের!

এবং অবিমিশ্র ঘৃণা। সে ঘৃণার আগুন দেখেছিলাম নিসরিন নামের একটা মুসলমান মেয়ের চোখে। জেরুসালেমে মেয়েটি আমাদের গাইডের কাজ করছিল। সেখানে চলার পথে একটা মনিহারি দোকানে কিছু জিনিস কিনতে ইচ্ছে গেল। দোকানে ঢোকবার সময় দেখি সে কিছুতেই ঢুকতে রাজি নয়। বেরোবার সময় একটা ছোট ব্রুচ কিনে এনে তার হাতে দিতে সে সেটা ফিরিয়ে দিল আমায়। তার চোখে আগুন ছিল। চাপা গলায় বলল, “এটা আমাদের বাড়ি ছিল স্যর। ১৯৬৭-তে ইজরায়েল এই এলাকাটার দখল নেয়। সবাই মরে গেল স্যর। আমি অরফানেজে গেলাম। অন্যের ভিক্ষেয় বড় হয়েছি। আর আজ আমার নিজের বাড়িতে দাঁড়ানো ওদের দোকান থেকে আপনি আমায়...”

হাতের ব্রুচটা হাতেই থেকে গিয়েছিল আমার। এ ঘৃণার শেকড় জাতটার একেবারে চেতনার গভীরে প্রোথিত। তার থেকে তার নিজেরও মুক্তি নেই, তার প্রতিপক্ষেরও নয়।

ঘৃণা ও লাঞ্ছনার বিপরীত ছবিটার সাক্ষী হয়েছিলাম আর এক দিন, জেরিকো থেকে ডেড সি ঘুরে গাজা ফেরবার পথে। একটি প্যালেস্টিনীয় ছেলে গাড়িতে লিফট চেয়েছিল এসে। সে-ও গাজায় ফিরছে। আমাদের সঙ্গেই চলে যেতে চায়। সম্ভবত বিদেশি দেখে একটু নিরাপত্তার লোভেই সঙ্গে নিয়েছিল আমাদের। আপত্তির কোনও কারণ ছিল না। গাড়িতে জায়গা আছে অনেক। কিন্তু তাকে নিয়ে ইজরায়েলি ভূখণ্ড পেরিয়ে গাজায় ঢুকতে গিয়ে বিপত্তি হল। ছেলেটার কাগজপত্র সবই ছিল। ভারতীয় পাসপোর্ট দেখে আমাদের গাড়িসুদ্ধ দিব্যি ছেড়ে দিলেও, ছেলেটার কাগজ দেখেই তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল ইজরায়েলি অভিবাসন দফতরের লোকেরা। আমাদের প্যালেস্টিনীয় ড্রাইভার এক মুহূর্ত দেরি করার সাহস দেখাল না আর। তিরবেগে গাড়ি নিয়ে যখন প্যালেস্টাইনের নিরাপত্তার মধ্যে এসে ঢুকছি, তখন পেছন ফিরে দেখেছিলাম, সৈনিকের পোশাক পরা দুটো কমবয়সি ছেলেমেয়ে সে ছেলেটাকে মাটিতে ফেলে নির্দয়ভাবে পেটাচ্ছে। তাদের মুখে কোনও কথা ছিল না। শুধু যন্ত্রের মতো আঘাত করে চলেছিল মানুষটার শরীরে। তার শেষ পরিণতি কী হয়েছিল জানি না।

রামাল্লাতে একটা নৈশভোজের আসরে এক জন প্যালেস্তেনীয়কে এক বার জিজ্ঞাসা করে বসেছিলাম, “আপনারা নিজেদের মধ্যে গণ্ডগোল মিটিয়ে নেন না কেন?” ভদ্রলোক কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তার পর বললেন, “আপনারা দুই প্রতিবেশী দেশ কেন এত দিনে নিজেদের মধ্যেকার সমস্যাটা মিটিয়ে নিতে পারলেন না, সেটা এক বার ভাবুন, তা হলেই আপনার প্রশ্নটার জবাব পেয়ে যাবেন।”

মুখের সামনে সে মন্তব্যের আয়না ধরে রেখে দেখেছিলাম, কথাটা ভুল নয়। গত প্রায় ষাট বছর ধরে বারংবার যে পারস্পরিক সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে আমরা দু’টি দেশ চলেছি, তার মূলেও তো সেই একই অবিশ্বাস আর ঘৃণা। কোথাও যেন একটা গভীর মিল রয়েছে প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল আর ভারত-পাকিস্তানের ক্রমাগত দ্বন্দ্বের ইতিহাসে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debojyoti bhattacharya probondho gaza israel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE