Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শাস্তি যদি চরম, তবে তা হবে কতটা মোলায়েম

প্রাণনাশের পদ্ধতি হরেক। কিন্তু কোন পন্থা কতটা গ্রহণযোগ্য? বিতর্ক চলছেই। লিখছেন পথিক গুহপ্রাণনাশের পদ্ধতি হরেক। কিন্তু কোন পন্থা কতটা গ্রহণযোগ্য? বিতর্ক চলছেই। লিখছেন পথিক গুহ

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৪ ২০:০০
Share: Save:

রুশ সাহিত্যিক আন্তন শেখভ এক গল্পে এনেছিলেন প্রসঙ্গটা। গল্পের নাম ‘বাজি’। কাহিনি এ রকম: এক ব্যাঙ্ক-মালিকের বাড়িতে বসেছে সান্ধ্য পানভোজনের আসর। উপস্থিত শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। তো সে মেহফিল যখন বেশ জমে উঠেছে, তখন কথায় কথায় উঠল এক বিতর্ক। ইস্যু: মৃত্যুদণ্ড। অপরাধের ওই সাজা কতখানি নৈতিক বা অনৈতিক। প্রাণ যখন ঈশ্বরের দান, তখন কোনও মানুষ তা কেড়ে নেওয়ার হুকুম দিতে পারেন কি না। হাজার হোক, জজ সাহেব তো আর ঈশ্বর নন। সুতরাং, সব রাষ্ট্রের উচিত তাদের পেনাল কোড থেকে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়া। এবং তার বদলে চরম শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাবাস চালু করা। তাতে মানুষের প্রাণ নেওয়ার পাপ কাজ থেকে অন্তত রেহাই।

অতিথিদের অনেকের রায় যখন এ রকম, তখন তর্কে যোগ দিলেন গৃহস্বামী। ব্যাঙ্ক-মালিক মনে করেন, চরম শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের চেয়ে মৃত্যুদণ্ড ভাল। যাবজ্জীবন একাকী কারাবাস অসহ্য যন্ত্রণার ব্যাপার। তিলে তিলে মৃত্যু। তার চেয়ে কাউকে একেবারে মেরে ফেলা ভাল। এ কারণে মৃত্যুদণ্ড রাষ্ট্রের পেনাল কোড থেকে মুছে ফেলা উচিত নয়।

ব্যাঙ্ক-মালিকের এই দাবিতে তর্কে যখন নতুন মাত্রা, তখন তাতে যোগ দিলেন অতিথিদের এক জন। এক তরুণ আইনজীবী। তাঁর যুক্তি: একেবারে মরে যাওয়ার চেয়ে যে কোনও ভাবে— হাজার কষ্টের মধ্যেও— প্রাণে বেঁচে থাকা ভাল। সুতরাং, মৃত্যুদণ্ড উঠিয়েই দেওয়া দরকার।

আইনজীবীর এই দাবিতে বিতর্ক যখন জমে উঠল, তখন তাতে বাড়তি ইন্ধন জোগালেন ব্যাঙ্ক-মালিক। এই মন্তব্য করে যে, বছরের পর বছর একাকী কারাবাস যে কী যন্ত্রণার, তা ভুক্তভোগী ভিন্ন কারও বোঝার ক্ষমতা নেই। আইনজীবী না বুঝেসুঝে কথা বলছেন। বহু কাল নয়, পাঁচটা বছর জেলের কুঠুরিতে একা থাকুন, তা হলেই তিনি বুঝবেন কেমন মরণ যন্ত্রণা তাতে।

সত্যিই বাড়ল বিতর্ক। আইনজীবী বললেন, নিজের বক্তব্য যে ঠিক, তা প্রমাণে পাঁচ বছর কেন, পনেরো বছর একাকী কারাবাসে যেতে তিনি প্রস্তুত। তাই নাকি? ব্যাঙ্ক-মালিক এ বার বাজি ধরলেন আইনজীবীর সঙ্গে। পনেরো বছর একাকী কারাবাস করতে পারলে তিনি আইনজীবীকে দেবেন দু’ মিলিয়ন রুবল। আর, যদি যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তিনি জেলের বাইরে বেরিয়ে আসেন একদিনও আগে, তা হলে তিনি পাবেন না এক কপর্দকও। বিচিত্র এই বাজিতে রাজি হলেন আইনজীবী। তিনি গেলেন অন্ধকার এক ঘরে।

শেখভের গল্পে পরিণতি বিচিত্র। এক দিকে শেয়ার বাজারে ধসের ফলে ব্যাঙ্ক-মালিক আমির থেকে গরিব। অন্য দিকে কুঠুরিতে বছরের পর বছর কাটাতে কাটাতে আইনজীবী উপলব্ধি করলেন গূঢ় এক সত্য। অর্থোপার্জন সুখের গ্যারান্টি নয়। তাই, কুড়ি লক্ষ রুবল পাওয়ার হাতছানি উপেক্ষা করে পনেরো বছর বন্দিজীবন শেষ হওয়ার দু’দিন আগে বেরিয়ে গেলেন কুঠুরি থেকে। কাউকে কিছু না জানিয়ে। দুর্ভাগ্য-পীড়িত ব্যাঙ্ক-মালিক কুড়ি লক্ষ রুবল হারানো থেকে রেহাই পেলেন বটে, কিন্তু বাজি জিতলেন কি তিনি?

শেখভের লেখা ছোটগল্পটি মনে পড়ল সম্প্রতি দু’টি খবরের সূত্রে। প্রথম খবর এই কলকাতার। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি এক আসামি। বন্দির নাম ফারহান ওরফে আফতাব মালিক। হ্যাঁ, ২০০২ সালে জওহরলাল নেহরু রোডে আমেরিকান সেন্টারের ওপর হামলার আসামি। বিচারে প্রথমে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছিল তাকে। ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি আফতাব ও সঙ্গীরা আমেরিকান সেন্টারে হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই মারা যান পাঁচ পুলিশকর্মী। আহত হন কুড়ি জন। আলিপুর জেলে বিশেষ আদালত আফতাবকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। গত ২১ মে সুপ্রিম কোর্ট সেই রায় খারিজ করে আফতাবের যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা ঘোষণা করেছে।

এই আফতাবকে ঘিরে খবরের মূলে তার আবদার। আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষকে সে জানিয়েছে, তার ভাল খাবার চাই। নচেৎ সে না খেয়ে থাকবে। কী রকম ভাল খাবার তার চাই? দুধ, মাখন, দই, কফি, জ্যাম, বিস্কুট, পনির, আচার বা টম্যাটো সস—সবই নামকরা কোম্পানির হওয়া চাই। কলা বা মুসাম্বি হওয়া চাই একেবারে ফ্রেশ। দাগি বা একটু পুরনো হলে চলবে না। মাছ কিংবা মাংসের পরিমাণ কতটা দিতে হবে তাকে দৈনিক, সে সবও জানিয়ে দিয়েছে এই বন্দি।

আফতাবের আর্জিতে আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষ বিব্রত। কারণ বন্দি হিসেবে তার স্ট্যাটাস পাল্টেছে। আগে সে ছিল মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামি। ও রকম বন্দির জন্য ভাল খাবার জেলের নিয়ম। কিন্তু যাবজ্জীবন কারাবাসের আসামির জন্য তেমন খাবার বরাদ্দ নয়। তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর নিয়ম অনুযায়ীই সে পাচ্ছিল ভাল খাবার। কিন্তু সাজা বদলে যাওয়ার পর— অর্থাৎ, ফাঁসির আসামি থেকে যাবজ্জীবন কারাবাসের বন্দি ঘোষিত হওয়ার পর— জেলের নিয়মেই তত ভাল খাবার আর তার প্রাপ্য নয়। এ দিকে আফতাব অনড় আগের মতো খাবারের দাবিতে। এই পরিস্থিতিতে কী করণীয়, তা বুঝতে পারছেন না আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষ।

বন্দি হিসেবে তার স্ট্যাটাস পাল্টালেও আগের মতো ভাল খাবারের দাবি জানিয়ে আফতাব নিজের অজান্তে তুলে দিয়েছে একটি প্রশ্ন। ফাঁসির আসামি কি অন্য বন্দির চেয়ে ভাল মানের খাবার পাওয়ার যোগ্য? জেলের চালু নিয়ম আনুযায়ী, ফাঁসির আসামি তা পাওয়ার যোগ্য। এই ব্যবস্থার সপক্ষে যুক্তি সহজে অনুমান করা যায়। যাকে মেরে ফেলা হবে অচিরে, তাকে জীবনের বাকি ক’টা দিন একটু দয়া দেখানো। এবং সেই সূত্রেই উঠে আসে দ্বিতীয়— এবং আরও বড় প্রশ্ন! মৃত্যুদণ্ড সাধারণ সাজা নয়। তা চরম অপরাধের চরম শাস্তি। এ বার, চরম অপরাধ যে করেছে, সে দয়া পেতে পারে কি?

এই দ্বিতীয় প্রশ্ন উঠেছে আর এক খবরের সূত্রে। এ খবর আমেরিকার। বলা ভাল, সেখানকার কিছু জেলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পরিপ্রেক্ষিতে।

চরম অপরাধের সাজা হিসেবে ফাঁসি আমেরিকায় চালু ছিল উনবিংশ শতাব্দীর অনেকটা জুড়ে। তার পর ফাঁসি গণ্য হয় নৃশংস পন্থা হিসেবে। বদলে চালু হয় ইলেকট্রিক শক দিয়ে বন্দিকে মারার পদ্ধতি। সেটিও নৃশংস গণ্য হওয়ায় ১৯২০-র দশকে চালু হয় গ্যাস চেম্বারে ঢ়ুকিয়ে মারার পন্থা। তার পর আসে ফায়ারিং স্কোয়াড ব্যবস্থা। ১৯৭২ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড অসাংবিধানিক। কারও প্রাণনাশের অধিকার রাষ্ট্রের থাকতে পারে না। ১৯৭৬ সালে সেই ঘোষণা বাতিল করে ফের চালু হয় মৃত্যুদণ্ড। পরের বছর থেকে শুরু হয় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নতুন পদ্ধতি। প্রাণঘাতী ইঞ্জেকশন। কড়া ডোজের রাসায়নিক প্রয়োগ। অপারেশনের সময় রোগীকে অজ্ঞান করে যে পদ্ধতি অবলম্বন করেন ডাক্তারবাবুরা, তারই চরম সংস্করণ। হালফিলের হিসেব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত আমেরিকায় ১২০০-র কিছু বেশি আসামিকে ও রকম ইঞ্জেকশন দিয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু এখন সেই পদ্ধতিও প্রশ্নের মুখে। প্রাণনাশের পদ্ধতি হিসেবে তা কতখানি গ্রহণযোগ্য, সে ব্যাপারে। ঘটনা অনেক, স্থানাভাবে মাত্র একটি এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে।

১৯৮৯ সালে জয় স্টুয়ার্ট নামে ২২ বছরের এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে অপহরণ, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় অপরাধী সাব্যস্ত হয় ২৮ বছর বয়সী ডেনিস ম্যাকগুইর। তাকে খুঁজে পেতে পুলিশের লাগে বহু বছর। আদালতে বিচারও চলে বহু কাল। ২০১১ সালে বিচারের রায় ডেনিসের মৃত্যুদণ্ড। সেই সাজা কার্যকর হয়েছে এ বছর ১৬ জানুয়ারি। তত দিনে ডেনিসের বয়স ৫৩। ওহাইয়ো প্রদেশের লুকাসভিল শহরের জেলে মারা গিয়েছে ডেনিস। প্রাণঘাতী ইঞ্জেকশনে। মৃত্যুর আগে নিজের ছেলেকে একটা ঘড়ি উপহার দেয় ডেনিস। ইঞ্জেকশনের ফলে কত ক্ষণে তার মৃত্যু হয়, তা যেন দেখে সে।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিন নির্দিষ্ট সময়ে জেলে উপস্থিত হল ডেনিসের মেয়ে, ছেলে এবং ছেলের বউ। কাচের ঘরের ও পাশ থেকে তারা দেখল সব। সকাল ১০টা ২৭ মিনিট। বিছানায় হাত-পা-কোমর বেঁধে শোয়ানো হল ডেনিসকে। এর পর তাকে দেওয়া হল দু’টি ইঞ্জেকশন। ১০ মিলিগ্রাম মিডাজোলাম এবং ৫০ মিলিগ্রাম হাইড্রোমরফোন। প্রথমটি স্নায়ু অবশ করার এবং দ্বিতীয়টি ব্যথা উপশমের রাসায়নিক। দু’য়ের মারাত্মক ফল চোখের সামনে দেখল ডেনিসের মেয়ে, ছেলে এবং ছেলের বউ। দেখল, প্রথমে একটু নিস্তেজ হলেও কয়েক মিনিট পরেই গলায় তীব্র ঘড় ঘড় আওয়াজ শুরু হল ডেনিসের। আর শুরু হল ছটফটানি। বিছানায় ছটফট করতে লাগল সে। যেন বাঁধন ছিঁড়ে উঠে বসার চেষ্টায়। এই ছটফটানি চলল বেশ কিছু ক্ষণ। তার দেহ স্থায়ী ভাবে নিস্তেজ হল ১০টা ৫৩ মিনিটে। অর্থাৎ, মরণ যন্ত্রণা চলল ২৬ মিনিট। এর আগে প্রাণঘাতী ইঞ্জেকশনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে কখনও এত বেশি সময় লাগেনি। ওই ঘটনা— এবং ও রকম আরও কিছু উদাহরণ— তুলেছে প্রশ্ন। ইঞ্জেকশন কি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার উন্নত উপায়?

অবশ্য, সেই সঙ্গে উঠেছে আরও এক বিতর্ক। শাস্তি যদি হবে চরম, তবে তা হবে কতখানি মোলায়েম?

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pathik guha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE