Advertisement
E-Paper

‘নারীকে কামনার বস্তু ভাবা হয়, কিন্তু...’ কুসুম নিয়ে জয়ার ভাবনা, শশী হতে ভয় পেয়েছিলেন আবীর?

৯০ বছর আগের উপন্যাস এই যুগে কি প্রাসঙ্গিক? ছবির চিত্রনাট্য ১৫ বছর আগেই লেখা হয়েছিল সুমনের। তবে এখনও এই ছবি সমসাময়িক। প্রথম থেকেই দাবি পরিচালকের।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৫ ২০:৪৩
জয়া-আবীর ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র কুসুম-শশী।

জয়া-আবীর ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র কুসুম-শশী। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

দেখতে দেখতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র ৯০ বছর। এত বছর পরে এই উপন্যাস নতুন রূপে হাজির হচ্ছে বড় পর্দায়। প্রায় একশো বছরের পুরনো এক অজ গাঁয়ের মানুষের জীবনের নানা রূপ-রস-গন্ধ কতটা উঠে আসবে এই যুগের ছবিতে? সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালিত ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র মুক্তির প্রাক্কালে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় উঠে এল এমনই কিছু সময়োচিত প্রশ্ন। সভায় উপস্থিত ছবির পরিচালক সুমন এবং অভিনেতারা। ছিলেন প্রেসিডেন্সির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সুমিত চক্রবর্তী এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সন্দীপকুমার মণ্ডল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে লেখা এই উপন্যাস এখনও কি প্রাসঙ্গিক? ছবির চিত্রনাট্য ১৫ বছর আগেই লেখা হয়েছিল সুমনের। তবে এখনও যে এই ছবি সমসাময়িক, তা প্রথম থেকেই দাবি করেছেন পরিচালক। এ দিন প্রেসিডেন্সির সভায় সুমন জানান উপন্যাসটি নিয়ে তাঁর নিজস্ব ভাবনা, কল্পনার কথা। উপন্যাস পড়ার পরে সেই কাহিনি ঘিরে প্রত্যেকের নিজস্ব কল্পনার জগৎ তৈরি হতে থাকে। ছবিতে শশীর চরিত্রে আবীর চট্টোপাধ্যায়, কুসুম জয়া আহসান। উপন্যাস পড়ার পরে অন্য কাউকে কল্পনায় দেখা যেতেই পারে। একটি দৃশ্য হয়তো লেখক লিখেছেন একটি বা দু’টি পাতা জুড়ে। সেটাকেই নিজের কল্পনার সঙ্গে বেঁধে দৃশ্যের সৃষ্টি করে পর্দায় তুলে ধরেন পরিচালক।

তিনি জানান, চিত্রনাট্যে উপন্যাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু বিষয়ও। তবে মূল বিষয়গুলির উপস্থিতি রয়েছে। পরিচালক বলেন, “আমি চিত্রনাট্য নিয়েই কথা বললাম মূলত। উপন্যাস নিয়ে কথা অনেকেই বলেছেন। অনেক লেখালিখিও হয়েছে। ‘শরীর শরীর শরীর, তোমার মন নেই কুসুম’, এই সংলাপ নিয়েই কথা লেখা হয়েছে। এই সংলাপ কি শশীর, না কি মানিকের নিজের, তা কিন্তু উপন্যাসে স্পষ্ট ভাবে উঠে আসে না। কিন্তু চিত্রনাট্যে সেটা স্পষ্ট।”

ছবিতে কুসুমের চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান। হালকা সবুজ রঙের কুর্তি ও সাদা পাজামা। নামমাত্র প্রসাধন। এই বেশেই এ দিন হাজির তিনি। জয়াকে দেখে পড়ুয়াদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের রোল। জয়াও কি কুসুমের মতো? অভিনেত্রী বলেন, “বরাবর নারীকেই কামনা ও বাসনার বস্তু হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু কুসুমেরও নিজের কামনা বাসনা রয়েছে যা সে লুকোয় না। কুসুম একটা খোলা বইয়ের মতো। কুসুমের মন, শরীর ও আত্মা সব এক রকম। এখানেই শশীর সঙ্গে তাঁর পার্থক্য। কুসুম কিন্তু শশীর চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা রাখে। সে এতটাই খোলা মনের, সতেজ একটি চরিত্র।”

কথা বলতে বলতেই জয়ার স্বীকারোক্তি, তিনি নিজে কুসুমের মতো হয়ে উঠতে পারবেন না। তিনি বলেন, “কুসুমের মধ্যে কোনও জড়তা নেই। আমাদের সকলের মধ্যে একটা লক্ষ্মণরেখা থাকে। এটা কুসুমের মধ্যে নেই বলেই সে এত আধুনিক। আমি নিজেও কুসুমের মতো হতে পারব না। এই গ্রামবাংলার বাউলদের কথাই যদি বলা যায়, তাঁদের দেহ, মন, আত্মা সব মিলেমিশে একাকার। যাহা ভাঙে, তাহাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে।”

আলোচনা সভায় টিম ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’।

আলোচনা সভায় টিম ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’।

আগে বেশ কয়েক বার পড়েছেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। কিন্তু অভিনয়ের সময়ে চিত্রনাট্যের কথাই কেবল মাথায় রেখেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে একই বক্তব্য যাদব পণ্ডিত তথা ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের। আগে পড়া থাকলেও, চিত্রনাট্য হাতে পাওয়ার পরে আর উপন্যাস পড়ে দেখার চেষ্টা করেননি। বরং পরিচালকের চোখ দিয়ে ফুটে ওঠা চরিত্রকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন। এই প্রসঙ্গে শান্তিলাল মুখোপাধ্যায় বলেন, “উপন্যাসের কাছে আমাদের দায় নেই। কিন্তু পরিচালকের কাছে রয়েছে। পরিচালক যে ভাবে, যে টুকু বলেন চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে, সেটা মেনে অভিনয় করাই অভিনেতাদের কাজ।”

শশীর চরিত্রে অনেকগুলি রং রয়েছে। শশী হয়ে ওঠা সহজ নয়। তাই প্রথমে এই চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়ে খানিকটা ভয়ই পেয়েছিলেন তিনি, সরল স্বীকারোক্তি আবীর চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি মাইক হাতে নিতেই গুঞ্জন মহিলা অনুরাগীদের মধ্যে। এ দিন তাঁর পরনে তাঁর সাদা শার্ট ও ডেনিম প্যান্ট।

প্রথমেই আবীর জানান, ‘এ যুগের ছেলেমেয়েরা বই পড়ে না’, এই মন্তব্য যুগের পর যুগ ধরে চলে এসেছে। এই বক্তব্য স্রেফ একটি মিথ, যা আরও এক বার বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তিনি উপলব্ধি করলেন।

শশী এক দিকে যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, নাস্তিক। অন্য দিকে তার মধ্যে দ্বন্দ্বও রয়েছে। দ্বিধা আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে সে। তাই এই চরিত্র নিয়ে চিন্তায় ছিলেন অভিনেতা। আবীরের কথায়, “বাঙালিদের মধ্যে এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা রয়েছে। এই একই বৈশিষ্ট্য রয়েছে শশীর মধ্যেও।” ছবির নায়কের মন্তব্য শুনে পরিচালক বলে ওঠেন, “বহু যুগ আগে কিন্তু উইলিয়াম শেক্সপিয়র লিখে গিয়েছেন,‘টু বি অর নট টু বি’। অতএব এ সমস্যা শুধু বাঙালির নয় কিন্তু!”

আবীরের কথার মাঝেই ঢুকলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। পরনে তাঁর সাদা টিশার্ট ও ডেনিম প্যান্ট। দু’জনের মধ্যে হালকা রসিকতার বিনিময়। ছবিতেও তো শশী ও কুমুদের মধ্যে এমনই সমীকরণ। পরমব্রত এই ছবিতে অতিথি শিল্পী। কুমুদের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। প্রথমেই পরম জানান, বিশেষ একটি দৃশ্যের জন্য তিনি এই ছবিতে কাজ করতে রাজি হয়েছেন। তিনি বলেন, “একটি পালাগানের দৃশ্য রয়েছে। অভিনেতা হলেও কখনও যাত্রাপালায় যোগ দেওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। এই ছবিতে সেই সুযোগ হয়েছে। একই সঙ্গে গান, সংলাপ, অভিনয়— আমরা যে পদ্ধতিতে বা বৃত্তে অভিনয় করি, তার সঙ্গে এর কোনও যোগাযোগ নেই।”

বাস্তবে কি কুমুদের সঙ্গে মিল রয়েছে পরমব্রতের? অভিনেতা বলেন, “কুমুদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবেও কিছু যোগ খুঁজে পাই। বলছি না, কুমুদের মতো পায়ের তলায় সর্ষে রয়েছে আমারও। কুমুদ নিজেকে গুরুত্ব দেয় না। আমি সেই জায়গায় যেতে পেরেছি, বলব না। এই উপন্যাসের বাকি চরিত্রেরা কিন্তু নিজেদের খুব গুরুত্ব দেয়। কিন্তু কুমুদ তেমন নয়। সেখান থেকে নিজের জীবনযাপনের মিল পাই।”

ঠিক কোন কোন বিষয়ে অভিনেতা মিল খুঁজে পান, “আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বড় হলাম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলাম। সেখান থেকে আবার বাংলা ছোট পর্দায় ঢুকে প়ড়লাম। সেখান থেকে সব ছেড়ে বিদেশে পড়তে চলে গেলাম। ভেবেছিলাম থেকে যাব। কিন্তু ফিরে এলাম। মুম্বইয়ে কাজের সুযোগ এল, সকলে ভাবল আমি ওখানেই থেকে যাব। কিন্তু আবার কলকাতাতেই ফিরলাম। আবার কত বিষয়ে দুর্নাম হয়েছে। সুখ্যাতির সঙ্গে প্রচুর বিতর্কেও জড়িয়েছি। গোটা বিষয়টাই রঙিন। যত দিন পৃথিবীতে আছি, সব ক্ষেত্রের রসাস্বাদন করাই কুমুদের বড় গুণ। এখানেই একাত্ম হতে পেরেছি।”

কুমুদের পাশে বসে তার মতি। কালো টপ ও ট্রাউজ়ার। লম্বা কালো চুল খোলা। এই বেশে উপস্থিত হন মতি তথা সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “বাচ্চা মেয়ে মতি। কিন্তু সে খুবই রোম্যান্টিক। সে জানে না, শশীর তার প্রতি একটা ভাল লাগা রয়েছে। কিন্তু জীবনে একটা প্রেম করতে চায়। কিন্তু কী ভাবে প্রেমটা করতে হয় জানে না। ওর বয়স কম বলে কুসুমের সামান্য নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। কিন্তু মতি সে সব জানে না। ও খুবই সরল মিষ্টি একটা মানুষ।”

আলোচনা সভার সমাপ্তি হল ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্যে। তিনি নিজেও এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তনী। কিন্তু দর্শকাসনে ছাত্রের থেকে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি দেখে রসিকতা করেই গুরুগম্ভীর কণ্ঠে তিনি প্রশ্ন রাখেন, ছাত্রীর সংখ্যা বেশি হওয়ার দুই কারণ কি পরম ও আবীর? ফের পড়ুয়াদের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বরে ভরে যায় প্রেক্ষাগৃহ।

Jaya Ahsan Parambrata Chatterjee Abir Chatterjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy