আজ ঋদ্ধির জন্মদিন। এই দিনটায় ওর ছোটবেলার বেশ কিছু কথা মনে পড়ে যায়। ও ছোটবেলা থেকেই খুব শান্ত বাচ্চা ছিল, একেবারেই দুষ্টু ছিল না। কিন্তু একটা বিষয় এখন শুনলে অনেকেরই অবাক লাগবে, ঋদ্ধি খুব কাঁদুনে বাচ্চা ছিল। রাস্তায় যানজট হলে কান্না জুড়ে দিত। অনেক লোকজন ওর সামনে চলে এলে ওর চোখে জল এসে যেত। তবে, আমাদের নাটকের দলের ছেলেমেয়েদের দেখলে ও কিছু বলত না। বাকিদের দেখলেই ও কেঁদে ফাটিয়ে দিতে। ঋদ্ধি বরাবরই মা-নেওটা। আমার কোল থেকে নামতেই চাইত না। মায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকত ছোটবেলায়। গাড়ি চড়ে যাওয়ার সময়ও মায়ের কোলটাই ওর আসন।
ছেলের জন্য একটা সময়ে আমার আর কৌশিকের চোখ থেকে ঘুম উড়ে গিয়েছিল। ও আসলে প্রায় ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকতে পারত। ঘুম কী জিনিস, জানত না ঋদ্ধি। আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত এটা চলেছিল। কিন্তু খাওয়া নিয়ে কখনও আমাদের বিরক্ত করেনি। ওকে গাল ভরে খাইয়ে দিলে খুব খুশি হত। আমিই হাতে করে খাইয়ে দিতাম। লক্ষ্মী বাচ্চা বলতে যা বোঝায়, তা-ই ছিল ঋদ্ধি। জিনিসপত্র ভাঙচুর করা বা পা তুলে দেখানোর অভ্যাস অনেক বাচ্চারই থাকে, আমার ছেলের কখনও এ সব ছিল না।
মায়ের সঙ্গে ঋদ্ধি।
ছোটবেলা থেকেই নাটকের দলের মধ্যে বড় হয়েছে। ও একটা সময় পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বেরোলেই কাঁদত। ওর জন্য আমারই বিয়েবাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার পর ওকে নিয়ে ভাল ছবি, নাটক দেখতে যাওয়া শুরু করি আমরা। এখন ও আমাদের ভাল ছবি বা নাটক দেখার পরামর্শ দেয়। পড়াশোনার মধ্যে থাকে ও। বিভিন্ন বিষয় ওর মতামতও স্পষ্ট রয়েছে। কিন্তু আজকের যুগে এই জন্য নানা নেতিবাচক মন্তব্য আসে ওর জন্য। যদিও আমি বা কৌশিক কেউই সমাজমাধ্যমকে গুরুত্ব দিই না। সব কিছুই খুব সস্তা হয়ে গিয়েছে। সকাল থেকে কী করছে, কে কী খাচ্ছে— সমাজমাধ্যম জুড়ে এখন এই সবই চলে। সেখানে কেউ অন্য রকম কথা বললেই তাকে সমালোচনা করা হয়। অল্প বয়সে কারও স্পষ্ট মতামত থাকতে পারে, এটা আমাদের দেশে মেনে নেওয়া হয় না। একটা নির্দিষ্ট বয়স পেরোলে তবেই যেন সেই কথাগুলো বলা যায়। এখানকার মানুষের ভাবনা হল, “আগে তোমার ৪৮ বছর বয়স হোক। তার পর তোমার জীবনবোধ তৈরি হবে।” সেই ছক ভাঙলেই সমস্যা হয়ে যায়। কিন্তু তার পরেও ঋদ্ধি নিজের মতামত রাখে। সেটাই তো ভাল। আজ ওকে পাকা বলা হয়। এক সময়ে পরমকে (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) পাকা বলা হত। এতে সত্যিই কিছু আসে যায় না।
ঋদ্ধি ছোট থাকতে একটাই প্রত্যাশা ছিল, কেউ যেন ওকে খারাপ না বলে। আজ ওকে লোকজন ‘পাকা’ বলে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ বলেনি ও খারাপ ছেলে। এই মান ও রেখেছে। আর ওর বুদ্ধিদীপ্ত সত্তা মানুষ দেখেছে। কিন্তু বাড়িতে আমাদের সঙ্গে ও খুবই মজা করে। খুবই ছেলেমানুষ ও। আমরা ওকে খুব খোলামেলা আবহে বড় করেছি। ও সেটার সদ্বব্যহার করেছে। ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও আমাদের কিছু বলে দেওয়ার নেই। ঋদ্ধি ও সুরঙ্গনা দু’জনেই খুব ভাল বন্ধু। ১০-১২ বছরের সম্পর্ক ওদের। কিন্তু আমি বা কৌশিক ওকে কখনও জোর দিইনি, “তোমাদের বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে। এ বার বিয়েটা করে ফেলো।” মাথায় সিঁদুর দেওয়াই যেন সব কিছু! ওরা মনে করলে নিশ্চয়ই বিয়ে করবে। অথবা এই ভাবেও থাকতে পারে। আমরা ওদের দু’জনকে নিয়েই খুব খুশি।
সপরিবার।
আজ জন্মদিনে সুরঙ্গনাও থাকবে, ঋদ্ধির বন্ধু রাজর্ষি, উজানও আসবে। ওদের নিয়েই সন্ধেবেলা কাটবে ওর। খুব হইচই ওর পছন্দ না। আর প্রতি বছর এই দিনটায় আমি নিজের হাতে ওর জন্য রান্না করি। কাঁসার থালায় ওকে পাঁচ রকমের খাবার সাজিয়ে দিই। প্রদীপ জ্বালাই। এই কারণেই প্রতি বছর এই দিনটায় আমি কাজ থেকে ছুটি নিই।