রাজা-রানি: সুনীল চৌধুরী-বীণা দাশগুপ্ত। ‘ব্রজের বাঁশরী’ পালা। ছবি সৌজন্য: সুনীল চৌধুরী
সে কালে যাত্রাদলে কয়েক জন থাকতেন, যাঁদের কাজ ছিল গাঁ-গঞ্জ ঘুরে সুদর্শন ছেলে জোগাড় করা। সখীদের দলে নাচার জন্য ফর্সা-নরমসরম ছেলের তখন খুব কদর, বয়স কম আর গলা সুরেলা হলে তো কথাই নেই। দেশভাগের পর বরিশাল থেকে বর্ধমানের উদ্বাস্তু ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল বছর দশেকের সতীশচন্দ্র নন্দী, ক্যাম্পে যাত্রার লোকেদের নজরে পড়ল সে। পেটের ভাত জোটানোর চিন্তায় ফর্সা ছেলে নামল সখীর ভূমিকায়। ক্রমে নায়িকা ‘সতীশ রানি’, আরও পরে বিখ্যাত নট্ট কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। অশীতিপর সতীশচন্দ্র গড়গড়িয়ে বলে যান পুরনো কথা।
পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকে পয়লা বৈশাখ মানেই চিৎপুরে মহাযজ্ঞ। পালার বায়না করতে দূর গ্রাম থেকে আগের দিনই চলে আসতেন নায়েকরা। যে দলের যত নাম, তার পালার বুকিং পেতে তত প্রতিযোগিতা। তারিখ পাওয়া নিয়ে গ্রামে-গ্রামে সম্মানের লড়াই। নট্ট কোম্পানির খ্যাতি তখন তুঙ্গে, ‘গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম’ পালা হিট।
মাখনবাবু পরের পালা ঘোষণা করেছেন, ‘কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ’। বুকিং হবে শুধু অক্ষয়তৃতীয়ায়, বাড়ির রাধাগোবিন্দের বিগ্রহ পুজো পাওয়ার পরে। আগের দিনই চলে এলেন নায়েকরা। গদিঘরে হুড়োহুড়ি, পুলিশ ডাকতে হয়েছিল ভিড়ের চোটে।
আরও পড়ুন: প্রবাসে সাহিত্যের বশে
সতীশবাবু বলছিলেন, ‘‘তখন যাত্রার নায়ক-নায়িকাদের বলা হত ‘রাজা-রানি।’ বুকিংয়ের সময় নায়েকরা জিজ্ঞাসা করতেন, ‘আপনাদের অপেরায় এ বার রাজা কে?’ গ্রামে সপ্তাহখানেক আগে থেকে ব্যান্ডপার্টি প্রচার চালাত। টিনের চোঙা হাতে পালার নাম-স্থান-কাল ঘোষণা করতে-করতে হাঁটতেন এক জন। যে গ্রামে যাত্রা, তার প্রায় প্রতি বাড়িতে তিন-চার দিন আগে থেকে আত্মীয়দের আসা শুরু হত। টিকিট কেটে তাঁদের যাত্রা দেখানোর ব্যবস্থা করতে হত গৃহকর্তাকে।’’
আরও পড়ুন: নববর্ষের শুভেচ্ছাই বাঙালিকে বাঁচিয়ে রেখেছে
বহু গ্রামে যাত্রা-অভিনেতাদের থাকার স্থায়ী জায়গা করা ছিল। আলাদা একটা পুকুরে মাছ চাষও হত। সারা বছর তা অন্য কারও ধরা বা খাওয়া বারণ। যাত্রাপার্টির জন্য বরাদ্দ ছিল ৪-৫ কেজির সেই মাছ। পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা সম্মেলন-এর যুগ্ম সম্পাদক রূপকুমার ঘোষ জানালেন, এখন চিৎপুরে প্রায় সব দলের বায়নাই হয় রথের দিন। পয়লা বৈশাখে শুধু নতুন পালার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় কাগজে।
আরও পড়ুন: বাঙালি হয়ে ওঠার গোড়ার কথা
সত্তর-আশির দশকে একটা কথার চল ছিল—‘ষষ্ঠী টু জষ্ঠি’। পয়লা বৈশাখ বা অক্ষয়তৃতীয়ায় বায়না, রথ থেকে শুরু মহড়া। আর দুর্গাষষ্ঠী থেকে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত টানা শো। যাত্রা-দুনিয়ার প্রবীণ লেখক সুনীল চৌধুরী গল্প করছিলেন, গ্রামে ও আশপাশে দশ কিলোমিটারের মধ্যে কবে যাত্রা হবে তা দেখে ছেলে-মেয়ের বিয়ে ঠিক হত, যাত্রা থাকলে কেউ বিয়েবাড়ি আসবে না। যে গ্রামে যাত্রা সেখানে সে দিনই মেয়ে দেখা, বাড়ি-জমি বিক্রির মতো কাজ ফেলা হত। রথ দেখা, কলাও বেচা!
আরও পড়ুন: বিবেকানন্দের হিন্দুত্ব না বুঝিয়ে মানুষকে তাঁর কথা সরল ভাবেই বোঝানো যেত
প্রবীণ অভিনেত্রী অঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন বর্ধমানে ‘গরিব বাড়ির বউ’ পালার গল্প। ভিড়ের চাপে তিন বার মঞ্চ ভেঙে গেল! গরুর গাড়ি, পালকিতে করেও শো করতে গিয়েছেন প্রত্যন্ত গ্রামে। একবার নৌকায় সুন্দরবন এলাকায় গিয়েছেন। নদীতীরে এক হাঁটু কাদা, ‘স্বাস্থ্যবান’ নায়ককে পাঁজাকোলা করে নামাতে গিয়ে গাঁয়ের এক জন হঠাৎ ধপাস করে তাঁকে কাদায় ফেলে দিয়ে বলল, ‘‘বাব্বা! হিরো বড্ড ভারী!’’ ‘গরিব বাড়ির বউ’ পালায় অঞ্জনা দজ্জাল ননদ, অভিনয় চলাকালীন বহু মানুষ চটি ছুড়ে মারতেন। সকালে আবার তাঁরাই এসে ক্ষমা চেয়ে যেতেন!
যাত্রাভিনেতা ত্রিদিব ঘোষ এক বার বাঁকুড়ায় ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন, তাঁকে চিনতে পেরে ক্ষমা চেয়ে চলে গিয়েছিল ডাকাতেরা। বছর পঁচিশ আগে তাঁকে নায়ক করা নিয়েই চিৎপুরের দুই যাত্রা সংস্থার লড়াই গড়িয়েছিল আদালতে। মামলায় জয়ীদের আদালত নির্দেশ দিল, দু’লক্ষ টাকার ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি দিতে হবে ৭ দিনের মধ্যে। এমনই এক পয়লা বৈশাখের সকালে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে নতুন পালা ঘোষণা করল তারা। জানাল, ত্রিদিববাবু তাদের সঙ্গেই রয়েছেন। বেলা বাড়তেই লাইন, এক দিনের মধ্যে দু’লাখ টাকা উঠে এল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy