Advertisement
E-Paper

পড়ুয়ারা স্বাধীন ভাবে বাণিজ্যিক ছবি বানাতে পারেন? ‘দ্য অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ তুলল প্রশ্ন

ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা ফেডারেশনের টেকনিশিয়ানদের না নিলে কি সেই ছবি মুক্তি পাবে না? অর্থই কি তখন সেই সমস্যার একমাত্র সমাধান?

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৫ ১০:২১
স্বরূপ বিশ্বাস, জয়ব্রত দাস, পিয়া সেনগুপ্ত এককাট্টা হলে মুক্তি পাবে ‘দ্য অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’?

স্বরূপ বিশ্বাস, জয়ব্রত দাস, পিয়া সেনগুপ্ত এককাট্টা হলে মুক্তি পাবে ‘দ্য অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’? ছবি: ফেসবুক।

একটি ছবি অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। যেমন, ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পড়ুয়ারা আদৌ পূর্ণ দৈর্ঘ্যের বাণিজ্যিক ছবি বানাতে পারেন কি না। বানালে সেই ছবি কি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে পারে? সেন্সরের ছাড়পত্র এবং প্রেক্ষাগৃহে ছবিমুক্তির জন্য প্রযোজকের ছত্রছায়ার কতটা দরকার? এই ধরনের ছবি বানাতে ফেডারেশনের টেকনিশিয়ানদের কি নিতেই হবে? না নিলে সেই ছবির মুক্তিতে কি বাধা আসতে পারে?

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, অর্থের বিনিময়ে কি সমস্যার সমাধানসূত্র কেনা যায়?

সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্র জয়ব্রত দাসের ‘দ্য অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ ছবিটি এত প্রশ্নের জন্মদাতা। ২০২১ থেকে তিলে তিলে তৈরি হয়েছে ছবি। আনন্দবাজার ডট কম-কে পরিচালক জানিয়েছেন, পড়ুয়াদের পয়সায় তৈরি। তাই যখন যেমন অর্থ এসেছে, তাঁরা শুটিং সেরেছেন। এ ভাবে কাজ করতে করতে যখন শেষ হয়েছে, তখন সেটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি। সেই ছবি দেখে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পড়ুয়াদের মনে হয়েছে, ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিলাভের মতো।

এই ভাবনা থেকেই জয়ব্রত প্রযোজনা সংস্থা প্রমোদ ফিল্মসের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। পরিচালকের দাবি, এই প্রযোজনা সংস্থাও কিছু লগ্নি করেছিল। সেন্সর বোর্ড, ছবির টাইটেল কার্ড ও পোস্টারে প্রযোজক প্রতীক চক্রবর্তী বা তাঁর প্রযোজনা সংস্থার নাম। এই জায়গা থেকেই সমস্যার সূত্রপাত।

ফেডারেশনের প্রশ্ন, যখনই কোনও ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পড়ুয়ারা প্রযোজকের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ছবি বানান, তখন সেটি আর শুধুই পড়ুয়াদের থাকে না। তা হলে তাঁরা কেন টেকনিশিয়ানদের নেবেন না? তাঁদের কাজ এবং ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করবেন? এই জায়গা থেকেই আরও একটি প্রশ্ন উঠে এসেছে।

ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পড়ুয়ারা কি আদৌ পূর্ণ দৈর্ঘ্যের বাণিজ্যিক ছবি বানাতে পারেন? বানালে সেই ছবি কি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে পারে?

এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ্য, কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিংহের একটি রায়। সম্প্রতি, পরিচালকদের স্বাধীনতা এবং তাঁদের কাজে ফেডারেশনের অত্যধিক হস্তক্ষেপের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সেই সময়ে বিচারপতি জানিয়েছিলেন, পরিচালকের স্বাধীন ভাবে ছবি তৈরির অধিকার রয়েছে। তিনি ফেডারেশনের টেকনিশিয়ানদের কাজে না-ও নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ছবিমুক্তির সময়ে ফেডারেশন কোনও বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। এই কথাই শোনালেন ‘দ্য অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’-এর জয়ব্রত। তাঁর কথায়, “বিশ্বের তাবড় ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্রেরা ছবি বানিয়েছেন। সেই ছবি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে।”

এই প্রশ্ন আনন্দবাজার ডট কম করেছিল সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটের আর এক প্রাক্তনী চন্দ্রিল ভট্টাচার্যকে। তিনি ছাত্রাবস্থায় বানিয়েছিলেন ‘ওয়াই টু কে: অথবা সেক্স ক্রমে আসিতেছে’ ছবিটি। সেই ছবি ইউটিউবে মুক্তি পেয়েছিল। প্রেক্ষাগৃহে আসেনি। তার পরেও যথেষ্ট আলোড়ন ফেলেছিল। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন রজতাভ দত্ত, গার্গী রায়চৌধুরী, শ্রীলেখা মিত্র, শিলাজিৎ মজুমদার প্রমুখ। ‘অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ প্রসঙ্গ তুলতেই চন্দ্রিল বললেন, “ছাত্রাবস্থায় ইনস্টিটিউটের জন্য কোনও ছবি বানালে তাতে প্রতিষ্ঠানের অধিকার থাকে। আমরা তাকে বলি ডিপ্লোমা ফিল্ম। এই ধরনের ছবি সাধারণত প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় না।” পাশাপাশি এ-ও জানান, শিক্ষার্থীরা তাঁদের অর্থে কোনও ছবি বানাতে পারেন কি না বা সেই ছবির প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি ঘটাতে পারেন কি না, তাঁর জানা নেই। “আমার সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, পড়াশোনা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাজের বাইরে কোনও ছাত্র যদি এই ধরনের ছবি বানানোর সময় বার করতে পারেন, তাতে সমস্যা কোথায়?”

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য এবং শেখর দাশ।

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য এবং শেখর দাশ। ছবি: ফেসবুক।

চন্দ্রিলের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত মঞ্চ ও পর্দার আর এক পরিচালক শেখর দাশ। তিনি রূপকলা কেন্দ্র, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট, পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর কথায়, "আগে নিয়ম ছিল, ফিল্ম স্কুল থেকে উত্তীর্ণ ছাত্ররা কোনও সংগঠনের সদস্য না হলেও স্বাধীন ভাবে ছবি বানাতে পারবেন। এখন সেই নিয়মে বদল এসেছে কি না জানি না।" সেই জায়গা থেকে পরিচালকের মত, ছবি পড়ুয়ারা বানাতেই পারেন। তবে তার বাণিজ্যিকীকরণ করতে গেলে অবশ্যই টলিউডের নিয়ম মানতে হবে। সে ক্ষেত্রে ফেডারেশন, ইম্‌পার সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।

শেখর এ-ও জানান, পড়ুয়াদের ছবির সঙ্গে কোনও প্রযোজনা সংস্থার নাম যুক্ত হলে, প্রযোজক কোনও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলে, তাঁকেও নিয়ম মানতে হবে। তা হলে কি পড়ুয়াদের ছবি বানিয়ে চলচ্চিত্র উৎসবের অপেক্ষায় থাকতে হবে? ওঁদের সীমা ওই পর্যন্তই? মঞ্চ-পর্দার পরিচালকের দাবি, ‘‘প্রেক্ষাগৃহে না পাঠালে পরিচালক-পড়ুয়াদের চলচ্চিত্র উৎসবে ছবি দেখিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি মানেই টলিউডে কার্যকর নিয়মবিধি মানতে বাধ্য সবাই।’’

এই প্রসঙ্গে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন, ইম্‌পা সভাপতি পিয়া সেনগুপ্ত, ফেডারেশন সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস।

পিয়া কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর জিজ্ঞাসা, “জয়ব্রত সমানে বলছেন, ছবিটি পড়ুয়াদের অর্থে বানানো। তাই যদি হবে, তা হলে প্রযোজনা সংস্থার নাম এখানে জুড়ল কী করে? পরিচালকের দাবি, রুদ্রনীল ঘোষ, পায়েল সরকার, সৌরভ দাস, দর্শনা বণিক, ঋষভ বসুরা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন। অথচ, কষ্টেসৃষ্টে বানানো সেই ছবির প্রচার হচ্ছে রমরমিয়ে! বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্সে ছবিটি দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রযোজক অর্থলগ্নি না করলে এত খরচ হচ্ছে কোথা থেকে?” পিয়া আরও জানিয়েছেন, যখনই একটি ছবির সঙ্গে প্রযোজকের নাম জুড়ে যায়, তখনই সেটি ‘কমার্শিয়াল মুভি’। সে ক্ষেত্রে প্রেক্ষাগৃহে ছবি মুক্তি দিতে গেলে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই তা ঘটাতে হবে। তাঁর দাবি, ‘‘পরিচালক সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন, ‘দ্য অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পড়ুয়াদের ছবি বলে প্রচার করে। প্রযোজক ই‌ম্‌পার সদস্য। তিনি ছবিমুক্তির সমস্ত নিয়ম জেনেও বিভ্রান্ত করছেন, টেকনিশিয়ানদের নির্দিষ্ট পাওনা দেবেন না বলে!’’

একই কথা স্বরূপের। তিনি জানিয়েছেন, তাঁরা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অনেক ছাত্র-পরিচালককে ছবি তৈরির ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন। আগামী দিনেও করবেন। তাই পরিচালক নয়, তাঁর অভিযোগ প্রযোজকের বিরুদ্ধে। প্রযোজকের সঙ্গে সংগঠন বৈঠক করতে চায়। এ-ও দাবি তাঁর, ছবিমুক্তির আগে ছবি থেকে, সেন্সরের ছাড়পত্র থেকে প্রযোজকের নাম সরাতে হবে।

সমস্যার এখানেই কিন্তু শেষ নয়। অভিযোগ, বিষয়টি রফা করতে ইতিমধ্যেই একাধিক ব্যক্তি লক্ষাধিক টাকা চেয়েছেন পরিচালক জয়ব্রতের কাছে। টলিউডের অন্দরে এবং ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্রদের তাই প্রশ্ন, অর্থ দিলেই সব অনর্থ মিটে যাবে? জয়ব্রতের কাছে অবশ্য বিষয়টি এখনও ধোঁয়াশা। তিনি জানেন না, শেষ পর্যন্ত অর্থ দিয়ে সব কিছু মিটমাট করতে হবে কি না। ছবি আদৌ মুক্তি পাবে কি না। পিয়াকে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে সাফ জানিয়ে দেন, এ বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি। স্বরূপও টাকা নেওয়ার প্রসঙ্গ অস্বীকার করেছেন। তাঁর সপাট জবাব, “আজ পর্যন্ত কাজ না করে ফেডারেশন এক পয়সা কারও থেকে নেয়নি। কেউ যদি সংগঠনের অর্থের বদলে সমস্যা মেটানোর মতো ঘটনা সামনে আনতে পারেন, তা হলে সভাপতির পদ ছেড়ে দেব।”

‘দ্য অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ আদৌ মুক্তি পাবে? দফায় দফায় চলতে থাকা বৈঠক কি সমাধানসূত্র বার করতে পারবে? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা কি আর ভরসা করে পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি বানিয়ে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়ার কথা ভাববেন? সবটাই সময় বলবে।

Piya Sengupta Swarup Biswas Jayabrata Das chandril bhattacharya Pradipta Bhattacharyya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy