Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus Lockdown

একটা গান বা কবিতা অসহায় মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে পারে না

আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার সামনে ছিটকে পড়ল দলা দলা রক্ত। আমি দেখলাম ছ’টা মিসড কল।

ট্রেনটা রাক্ষসের মতো পিষে দিয়ে গেল মানুষগুলোকে। ফাইল চিত্র।

ট্রেনটা রাক্ষসের মতো পিষে দিয়ে গেল মানুষগুলোকে। ফাইল চিত্র।

দেবজ্যোতি মিশ্র
শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২০ ১৬:৫১
Share: Save:

ফোন-১

ফোনটা কি সত্যিই বাজছে নাকি ঘুমের ঘোরে কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছি। একটা ঘোরের মধ্যে ফোনটা ধরলাম।

ফোনের ওপারে সৈকতের গলা। ওর গলা কাঁপছে। দেবুদা খবরটা শুনেছো... ষোলো জন মারা গিয়েছে। ষোলো জন পরিযায়ী শ্রমিক। ওরা বাড়ি ফিরছিল, ওরা বাঁচতে চেয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিল রেললাইনে।

-কী বলছিস কী!

-হ্যাঁ দেবুদা সত্যি। আজকে অওরঙ্গাবাদের ঘটনা। আমি নড়েচড়ে বসলাম। মনে হল, ওই ষোলো জন অসহায় মানুষ ফোনের মধ্যে দিয়ে আমার দিকে হেঁটে আসছে। ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ পিছিয়ে যেতে লাগল সৈকতের গলাটা। মনে হল একটা ঝাঁকুনি, আমি কি ওই ট্রেনের মধ্যে রয়েছি! এবং ট্রেনটা রাক্ষসের মতো পিষে দিয়ে গেল মানুষগুলোকে। আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার সামনে ছিটকে পড়ল দলা দলা রক্ত। আমি দেখলাম ছ’টা মিসড কল।

ফোন-২

যাদবপুর থেকে ফোন করেছে কৌশিক ঘোষ। যাদবপুরে ছাত্র-যুবদের উদ্যোগে আমাদের রান্নাঘর চলছে। খাবার মেনু তৈরি করতে হবে। আজকে অনেক বেশি মানুষ হয়ে গিয়েছে শ্রীকলোনি নবনগর নাকতলা অঞ্চলে। প্রতি দিন অনেক অনেক নতুন মুখ অনেক অনেক বিপন্ন মানুষ এসে দাঁড়াচ্ছেন লাইনে। এক দিকে এই মানুষগুলোর খাবারের জোগাড়, অন্য দিকে মাথার ভেতর তখনও ঘুরছে ওই ষোলো জনের মুখ। ষোলো জন অসহায় মানুষ একসঙ্গে রেললাইনে আত্মহত্যা করে! একে কি আত্মহত্যা বলা যায়? এ তো হত্যা! অ্যাক্সিডেন্ট বলে দিলেই হবে? কিছুই বুঝতে পারছি না। মাথাটা যন্ত্রনায় ফেটে যাচ্ছে। আমরা কি বেঁচে আছি, নাকি ওই ষোলো জনের মতো আমরাও আর বেঁচে নেই। আসলে আমরা শুধু বাঁচার কথা ভাবছি। বাঁচার অভিনয় করছি। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা পিঁজরাপোল। মনে হল গিলোটিনে মাথা ঢুকিয়ে দিচ্ছে কেউ। একসঙ্গে ষোলো জন গরিব মানুষ পোকামাকড়ের মতো মরে গেল। হায় রাষ্ট্র! কি আদর্শ ছিল মানুষগুলোর, কোন আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ ভাবে একসঙ্গে আত্মহত্যা করবে? কিছু শ্রমিক, তারা বাড়ি ফিরছিল। তারা ক্লান্ত হয়ে ওই ট্রেন লাইনের উপরে নগ্ন পাথরের উপর শুয়ে পড়বে, এটা কোনও কথা হতে পারে? পর পর ষোলো জন মানুষের উপর দিয়ে ট্রেন চলে যাবে, এ রকম মর্মান্তিক ঘটনা দেখেও আমরা চুপ থাকবো? ওরা নয়, আসলে রাষ্ট্র ঘুমিয়ে পড়েছে। আরও একটা ফোন বাজছে, ফোনের মধ্যে দিয়ে ফোন।

প্রতিদিন অনেক অনেক নতুন মুখ অনেক অনেক বিপন্ন মানুষ এসে দাঁড়াচ্ছেন যাদবপুরের এই লাইনে। নিজস্ব চিত্র।

ফোন-৩

‘দেবুদা আজকের মেনুটা চেঞ্জ করতে হবে।’ আমি বললাম, কেন? আসলে অনেক অনেক লোক এসে জড়ো হচ্ছেন প্রতি দিন। আমি সত্যিই দেখেছি গত কাল অনেক নতুন মুখ খাবারের সন্ধানে পথে নেমেছেন। আজ নাকতলা রামগড় অঞ্চলে এমন কিছু মুখের সঙ্গে পরিচয় হল যাঁরা আজ থেকে এক মাস আগে ভাবতেই পারেননি এ ভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করতে হবে। কী অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। ভেঙে পড়া অর্থনীতি যেন একটা কুপনের জন্য, একটু খাবারের জন্য হাহাকার করছে। খিদের সামনে তাদের আকুতি সত্যিই চোখে দেখা যায় না। বিশেষত, আমি ওদের চোখগুলোকে কী করে ভুলে যাব? সেই সত্তর ঊর্ধ্ব ভদ্রলোক কিংবা লাঠি হাতে প্রায় নুয়ে পড়া বয়স্ক ভদ্রমহিলা, কি করুণ তাঁদের চাহনি। কাছে এসে খাবারের প্যাকেট চাইতে রীতিমতো কুণ্ঠা। অথচ বাড়িতে হাঁড়ি চড়েনি। অনেকেরই চোখে জল। ছেলে গিয়ে মদের দোকানে লাইনে দাঁড়িয়েছে, পেটে খাবার নেই। ছি ছি সরকার, মদের দোকান খুলে দিল! মাঝে মাঝে ক্ষোভে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে। এই যে সরকারের তরফে এত টাকা, এত চাল আসছে, কিন্তু সে সব যাচ্ছে কোথায়! প্রশ্ন জাগে, কেন সাধারণ মানুষ না খেতে পেয়ে মরবে? ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। প্রতি দিন অল্প অল্প করে ওদের হাসিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। প্রবল ভাবে বেঁচে থাকার কাছে সব কিছু হেরে যাচ্ছে আদতেই। এ লড়াই বেঁচে থাকার লড়াই। আমার মাথার ভেতর সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায়। আচ্ছা, ওরা কি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিল! নাকি দেশ ঘুমিয়ে পড়েছিল, সরকার তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে? ট্রেন চালিয়ে দিলে তো! অ্যাক্সিডেন্ট নয়, আত্মহত্যা নয়, এ পৈশাচিক নরহত্যা। মনে হচ্ছে এখনই মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। মর্মান্তিক, মর্মান্তিক এবং মর্মান্তিক। এর চেয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগ কি কঠিন ছিল? খিদের সামনে স্বাধীনতাও ম্লান হয়ে যায়। খিদের যন্ত্রণা কোথাও গিয়ে ছাপিয়ে যায় সব কিছুকে...।

তখনই আমার মনে হল, কিছু দিন আগেই

সলঝেনিৎসিন-এর একটা বিখ্যাত লাইন পড়েছিলাম—

"your belly is a rascal

it never remembers

when you fed it yesterday"

আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হল,

খিদের পেটে খিদে

খাদের ভেতর জঠর

ভিক্ষে পাত্র হাত

চোখের গর্তে পাথর

পাথর ভাঙে মানুষ

আদিম রক্ত গায়

হারামির মত খিদে

ফের এসে খেতে চায়!

ফোন-৪

আমার মাথার ভেতর তখন শ্রীকলোনির রান্নাঘর। ও দিকে মোবাইল স্ক্রিনে বার বার ভেসে উঠছে ট্রেনলাইনে কাটা পড়া ষোলো জন মানুষের মুখ। এরই মধ্যে রিনাদি, মানে আমাদের অপর্ণা সেনের ফোন, ‘‘যাদবপুরে তোরা বেশ কাজ করছিস দেবু। যদি আমার দশটা বছর বয়স কম থাকত, কোমরে আঁচল বেঁধে নেমে পড়তাম তোদের সঙ্গে। কিছুই করতে পারছি না দেবু। মানিককে দিয়ে একটা চেক পাঠালাম।’’ সকালে চেকটা দেখেই তাজ্জব বনে গেলাম। এক লক্ষ টাকা! রিনাদি, তোমাকে কুর্ণিশ। কথা দিচ্ছি, প্রতিটি টাকা খরচ হবে মানুষের জন্য। যাদবপুর আমাকে এই অন্ধকারের মধ্যেও আলো দেখাল। যাদবপুরের যুব শক্তি আমাকে মনে করিয়ে দিল সেই দিনগুলোর কথা। রিলিফ নিয়ে বাবা বেরিয়েছেন, সঙ্গে শান্তি বর্ধন। আমার মনে পড়ে গেল সলিল চৌধুরী এবং আমি, আমরা একসঙ্গে রাস্তায় মার্চ করছি, শান্তি মিছিলে গান গাইছি। লকডাউন লকডাউন লকডাউন, এই অস্থির সময়ে চারিধারে গান গান আর গান। এত গান, এত কবিতা, এত মহৎ বাণী কেন? কোনও কিছুই তো কিছু করতে পারেনি!

শুধু লোভ লোভ আর লোভ। শুধু মুনাফা মুনাফা আর মুনাফা। হয়তো করোনা এক দিন বিদায় নেবে। কিন্তু এই তড়িৎ গতিতে বেড়ে চলা লোভের হাত থেকে মুক্তি কোথায়?

প্রশ্ন জাগে, আমরা কি সত্যকারের বিষাদ ভুলে যাওয়ার জন্য গান গাইছি? কিন্তু আজ আমার গান গাইবার মতো কোনও গান নেই। আমি বেশ বুঝতে পারি, আদতে আমাদের গানবাজনা করে কিছুই হয় না। একটা গান, একটা কবিতা অসহায় মানুষের মুখে দু-মুঠো অন্ন তুলে দিতে পারে না। এই অতিমারিকে আটকে দিতে পারে না। পারে না আর একটু মানবিক করে তুলতে। এরই মাঝে হোয়াটসঅ্যাপে দেখলাম শুভা মুদগাল অনবদ্য ভাবে উদ্যোগী হয়েছেন। আমার মনে হল, আমরা যারা মধ্যবিত্ত তাদের জীবনে সে অর্থে উদ্বৃত্ত কিছু থাকে না। তবুও যেটুকু পারি উজাড় করে দিতে এক বারের জন্যও আমার বুক কাঁপে না। মনে হয়, এই মুহূর্তে আগামিকাল কী হবে ভাবব না, আগামিকালের ভয়ে মরব না। তার চেয়ে যদি কিছু টাকা সাহায্য করতে পারি, সেটা অনেক বেশি কাজের। কিছু মানুষ তো খেতে পাবে। সেই খাওয়ার টাকা দরকার। সব কাজ বন্ধ। এই ভারতবর্ষে আমার মিউজিশিয়ান বন্ধুদের সংসার চালানোর জন্য টাকা দরকার। এ সব ভাবলেই চোখে জল আসে।

আরও পড়ুন: হাতে কাজ নেই, পেটে ভাত নেই, বিনোদনের দুনিয়ায় চোখের জলও নেই: রুদ্রনীল ঘোষ

প্রশ্ন জাগে কেন সাধারণ মানুষ না খেতে পেয়ে মরবে? ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। ছবি- রয়টার্স।


ফোন-৫

আগামিকাল পঁচিশে বৈশাখ। হিউস্টন থেকে ফোন। গোটা ইউএসএ অপেক্ষায় রয়েছে আমার ডিজিটাল মিউজিকাল শোয়ের। ঘরে বসেই শুটিং। সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছি, গান গাইছি। রবীন্দ্রনাথের গান। হায় রবীন্দ্রনাথ! তোমাকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার শেষ চেষ্টা। আমি চুপ করে বসে আছি। কাজ শেষ হচ্ছে না কিছুতেই। রাত গভীর হয়ে আসছে। 'প্রার্থনা' ছাড়া আর কী বা হতে পারে এই অনুষ্ঠানের নাম। আমার মনে হল আমার মাথার কাছে রবীন্দ্রনাথ। আরও এক বার বুঝতে পারি এই কঠিন সময়ে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে আমাদের। হঠাৎ মনে পড়ে যায়, সাল ১৯১৪, বিশ্বযুদ্ধের সময়। বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ। হতাশায় ডুবে গিয়েছেন। সেখান থেকে হঠাৎ দেখা হল একটা আলোর সঙ্গে একটা গানের। আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। আমি দেখলাম এই তো নিরাময়। আমি দেখলাম আগুনের পরশমণির সঙ্গে মিশে গিয়েছে অ্যাভেমেরিয়া। মিলানের ক্যাথিড্রাল থেকে ভেসে আসছে প্রার্থনা। জোহান সিবাস্টিয়ান বাখ গাইছেন সেই গান।

ফোন-৬

এত অন্ধকারের মধ্যেও কিছু জিনিস মনকে শান্তি দেয়। ভারতবর্ষ এবং বিদেশ থেকে বন্ধুরা যাদবপুরে আমাদের কর্মকাণ্ডের জন্য টাকা পাঠাচ্ছেন, খোঁজ রাখছেন প্রতিনিয়ত। এটাও তো একটা পজিটিভ ব্যপার। রান্নাঘরে মালপত্র নামিয়ে গাড়িতে উঠতে যাব। সামনের বাড়ি থেকে একটি কিশোরী উজ্জ্বল মুখ নিয়ে বলল, একটু চা খেয়ে যাবেন না? মনে হল, এত আদরের ডাক শুনিনি বহু দিন। আমি বললাম, চল। কোথায় তোমাদের বাড়ি? ও পুকুরপাড়ের একটি বাড়ি দেখাল। আমি সিঁড়ি দিয়ে ওর সঙ্গে ওপরে উঠছি। ফোন বাজছে, এবং বেজেই যাচ্ছে। ধরা হল না। দোতলা পেরিয়ে তিন তলা, সিঁড়ির ধার বরাবর চাল তেল আলুর বস্তা। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। ফোন তখনও বেজে চলেছে নিচু স্বরে। সিঁড়ির থেকে ঘরে ঢোকার মুখে এক সত্তরোর্ধ্ব ভদ্রমহিলা। ঘষা কাচের মধ্য দিয়ে দেখলাম এক উজ্জ্বল দৃষ্টি। সে দৃষ্টিতে ছিল এক প্রখর দীপ্তি আর স্নেহ। বুকের ভেতর ডাক উঠলো মা, মাগো...

আরও পড়ুন: করোনা-কালে হিট ছবির প্রিমিয়ার কি হবে মাল্টিপ্লেক্সে নাকি ড্রয়িংরুমে?

যাদবপুরের রান্নাঘরে তিনি বহু দিন ধরে সবাইকে রান্না করে খাওয়াচ্ছেন। উজ্জীবিত চোখ যেন বলল, যত দিন প্রাণে বায়ু আছে, বাবা জেনে রেখো আমি আমার লড়াই চালিয়ে যাব। মানুষকে অভুক্ত থাকতে দেব না। তুমি তো আমার ছেলে, পাশে থেকো। এই যুদ্ধটা আমাদের জিততেই হবে।

আমি তাঁর চোখে দেখতে পেলাম আমার ভারতবর্ষকে। আমি বুঝতে পারলাম এখনও আশা আছে।

মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াতে ভুলে যায়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Lockdown Migrant Workers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE