Advertisement
E-Paper

চিতাভস্ম কিনতে হুড়োহুড়ি

পুলিশের পদস্থ কর্মচারী এফ সি ড্যালির বক্তব্য: “কানাইলাল দত্তের চিতাভস্ম বলে কলকাতায় যা বিক্রি হয়েছিল, অনুমান করা হচ্ছে তা চিতাভস্মের প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে অন্তত পঞ্চাশ গুণ বেশি!”

বিপ্লবী: কানাইলাল দত্ত

বিপ্লবী: কানাইলাল দত্ত

শুভাশিস চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৯ ০০:৪৭
Share
Save

চট্টগ্রাম থেকে নয়নতারা দেবী এসেছেন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে, ছেলেকে শেষ বার দেখতে। চট্টগ্রামের গণতান্ত্রিক রক্ষীবাহিনীর সদস্য তাঁর পুত্র রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। সূর্য সেনের বিশ্বস্ত পার্ষদ। পুলিশের আইজি ক্রেগকে মারতে গিয়ে রামকৃষ্ণ ও কালীপদ চক্রবর্তী খুন করেছেন পুলিশ অফিসার তারিণী মুখোপাধ্যায়কে। রাতের অন্ধকারে চাঁদপুর রেল স্টেশনে এই ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁরা ধরা পড়ে গেলেন বাইশ মাইল দূরে মেহেরকালী স্টেশনে। ফাঁসির ঘোষণা হয়ে গেছে।

ছেলের সঙ্গে এক বার দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য নয়নতারা দেবীকে কলকাতায় নিয়ে এসেছেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। গত তিন মাসে প্রীতিলতা রামকৃষ্ণের সঙ্গে জেলে দেখা করে গিয়েছেন অন্তত চল্লিশ বার। মাসতুতো বোনের মিথ্যে পরিচয় দিয়ে। আজ নিয়ে এসেছেন মাকে: ‘আমি চট্টগ্রামে গিয়ে রামকৃষ্ণদা’র মা’কে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলাম। আলিপুর জেলে রামকৃষ্ণদা’র সাথে তাঁর মায়ের শেষ দেখা করিয়ে দিয়েছি। তাঁর মায়ের হৃদয়বিদারক কান্নার করুণ দৃশ্য দেখে আমিও না কেঁদে পারিনি।’ ১৯৩১-এর ৪ অগস্ট গুরুতর অসুস্থ রামকৃষ্ণকে রাত বারোটা নাগাদ অতি গোপনে ফাঁসি দেওয়া হয়।

“মা যদি এখানে এসে না কাঁদেন, তবেই আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি, নচেৎ নয়।”— ফাঁসির কয়েক দিন আগে হেমচন্দ্র কানুনগোকে জেলের গরাদের ও পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তা-ই হল। আলিপুর জেলে মা ও ছেলে মুখোমুখি। বুকের কান্না চোখের জলে ধুয়ে যাওয়ার সুযোগ পেল না। সত্যেন্দ্রর ফাঁসির আগে প্রার্থনা করার জন্য জেলে গিয়েছিলেন পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী। আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ও কানাইলাল দত্ত জেলের ভিতরে বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে খুন করেছিলেন। অভিযুক্ত দু’জনেরই ফাঁসির সাজা ঘোষণা হল। সত্যেন্দ্রর ফাঁসি হয় ১৯০৮-এর ২১ অথবা ২৩ নভেম্বর। তখন তাঁর বয়স ছাব্বিশ।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য, মানকুমার বসু ঠাকুর, কৃষ্ণগোপাল চৌধুরী, চিত্তরঞ্জন মুখোপাধ্যায়।

সত্যেন্দ্রনাথের শবদেহ জেলের বাইরে এল না। জেলখানার উঁচু পাঁচিলের ঘেরাটোপের মধ্যে দাহ করা হয়। এমনকি হেমচন্দ্র কানুনগোরা কোনও স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত সঙ্গে নিতে পারেননি। আসলে মাত্র দশ-বারো দিন আগের একটি ঘটনা পুলিশের পক্ষে বিড়ম্বনার হয়ে উঠেছিল; এই যাত্রায় তাই তারা কোনও ভুলের সুযোগ রাখতে চায়নি। ১০ নভেম্বর ১৯০৮ সত্যেন্দ্র-সঙ্গী কানাইলাল দত্তের ফাঁসি হয়। সে দিন তাঁর শবদেহ নিয়ে কলকাতা শহরের বুকে এক জনপ্লাবনের সাক্ষী থেকেছে পুলিশ। লক্ষ লক্ষ মানুষ। তারা একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে এক বারের জন্য হলেও শববাহী খাটটি ছুঁতে চায়। সর্বত্র ‘জয় কানাই’ ধ্বনিতে আন্দোলিত। কেওড়াতলা শ্মশানে দাহকার্যের পর কানাইলালের ‘চিতাভস্ম’ কেনার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হয়। আধ ছটাক চিতাভস্মের জন্য কোনও কোনও অত্যুৎসাহী পাঁচ টাকা পর্যন্ত দিয়েছিলেন। পুলিশের পদস্থ কর্মচারী এফ সি ড্যালির বক্তব্য: “কানাইলাল দত্তের চিতাভস্ম বলে কলকাতায় যা বিক্রি হয়েছিল, অনুমান করা হচ্ছে তা চিতাভস্মের প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে অন্তত পঞ্চাশ গুণ বেশি!”

ক্ষুদিরাম বসু প্রথম বাঙালি বিপ্লবী, ব্রিটিশের ফাঁসিকাঠে যাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ১৯০৮-এর ১১ অগস্ট তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। সেই থেকে ১৯৪৪-এর ২৪ অগস্ট পর্যন্ত মোট একচল্লিশ জন বাঙালি বিপ্লবীকে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াতে হয়েছে। ফাঁসি দেওয়া হয়েছে মজফফরপুর, আলিপুর, মেদিনীপুর, বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, ফরিদপুর, অম্বালা, বালেশ্বর, বরাবাঁকি, গোণ্ডা, মাদ্রাজ এবং দিল্লি জেলে। অনেকেরই পূর্ণপরিচয় জানা যায়নি, ছবিও অপ্রতুল। এঁদের মধ্যে সব থেকে বেশি বয়সে ফাঁসি হয়েছে মাস্টারদা সূর্য সেনের— চল্লিশ। বাকিদের বয়স সাতাশের ঊর্ধ্বে নয়— তবে এই পরিসংখ্যান নিয়ে চাপান-উতোর আছে। অন্তত ছয় জন বিপ্লবীর বয়স জানাই সম্ভব হয়নি।

১৯৩৪ এবং ১৯৪৩ সাল দু’টি বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সব থেকে দুর্ভাগ্যজনক বছর। দশ জন করে বিপ্লবী ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছেন এই বছর দু’টিতে। এর মধ্যে ১৯৪৩ সালের ইতিহাস এক কথায় নৃশংস, নারকীয়। এই বছরে যে দশ জনের ফাঁসি হয়েছিল তার মধ্যে নয় জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল একই দিনে, একই জেলে! নয় বাঙালি তরুণই পেশায় ছিলেন চতুর্থ মাদ্রাজ উপকূল রক্ষী বাহিনীর সেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে থেকে তাঁরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন সে দিন। ধরা পড়ে গেলেন। শুরু হল বিচারের নামে প্রহসন। নয় জনের অন্যতম দুর্গাদাস রায়চৌধুরী মৃত্যুর কয়েক দিন আগে জেলখানায় বসে লিখেছিলেন একটি ‘খোলা চিঠি’: “আমাদের কেন ফাঁসি হইতেছে তাহা জানিবার জন্য আপনারা আগ্রহান্বিত। ব্রিটিশ সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাই ইহার কারণ।…আমরা বাঙালি সৈনিক। দেশের স্বাধীনতার আহ্বানে আমাদের নয়টি জীবনদীপ নির্বাপিত হইতে চলিয়াছে।” ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একই দিনে এক সঙ্গে নয় জনের ফাঁসির ঘটনা আর কখনওই ঘটেনি। দুর্গাদাস ছাড়া বাকি যে আট জনের ফাঁসি হয়েছিল তাঁরা হলেন কালীপদ আইচ, চিত্তরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, নন্দকুমার দে, নিরঞ্জন বরুয়া, নীরেন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, মানকুমার বসু ঠাকুর, সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায় এবং ফণিভূষণ চক্রবর্তী। এঁদের মধ্যে মানকুমার ছিলেন প্রখ্যাত রসায়নবিদ প্রতুলচন্দ্র রক্ষিতের শ্যালক। ফাঁসির পাঁচ দিন আগে, ১৯৪৩-এর ২২ সেপ্টেম্বর, মানকুমার জামাইবাবুকে লিখেছেন: “আমার চলে যাওয়ার সেই চরম মুহূর্ত এসেছে। আমি আপনার কাছে আমার বন্ধনমুক্ত আত্মার জন্য শুধু আশীর্বাদ চাইবো।… আমার আত্মার শান্তির জন্য আমি আপনাদের সকলের প্রার্থনা কামনা করছি।” ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩ ভোরবেলায় এঁদের গলায় ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন ফাঁসুড়ে শিবু ডোম। পুরো নাম শিবলাল। তাঁর স্মৃতিচারণ: “সেদিন তেনারা খুব গান গাইছিলেন সবাই মিলে। যখন শেষ সময় এসে গেল, জোর গলায় বলতে লাগলেন জয় হিন্দ-জয় হিন্দ-জয় হিন্দ।” এই শিবলালই নয় বছর আগে, ১৯৩৪-এর ১২ জানুয়ারি, চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের গলায়।

রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গাইতে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলেন কৃষ্ণগোপাল চৌধুরী। মেদিনীপুর জেলে ১৯৩৪ সালের ৫ জুন তাঁর সঙ্গেই ফাঁসি হয়েছিল হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর। সূর্য সেনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। তার বদলা নিতে হবে। ৭ জানুয়ারি এঁরা দু’জন ইওরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করলেন। ধরাও পড়ে গেলেন। বিশৃঙ্খলার ভয়ে দণ্ড কার্যকর করতে দু’জনকে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে আনা হয়েছিল মেদিনীপুরে। সেখানে তখন বন্দি ছিলেন যুগান্তর দলের সদস্য সীতাংশু দত্ত রায়। তাঁর স্মৃতিচারণ: কৃষ্ণগোপাল ফাঁসির আগের কয়েক দিন জেলে সারা দিন একটা গান মাঝে মাঝেই গেয়ে উঠতেন— ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।’ অন্য রাজবন্দিদের ডেকে বলতেন— ‘‘এই গান গাইতে গাইতে ফাঁসির দিন বধ্যভূমিতে যাব। গান যখন আর শুনতে পাবেন না, বুঝতে পারবেন— সব শেষ।’’

রবীন্দ্রনাথের গানে আর কবিতায় অন্তরাত্মার মুক্তি খুঁজে পেয়েছিলেন আর এক ফাঁসির আসামি, বছর উনিশের প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য। ডগলাস-হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হলেও তাঁর মনে কোনও ভাবান্তর দেখেননি সহবন্দিরা। বিপ্লবী ভূপাল পাণ্ডা প্রদ্যোতের সেল থেকে শুনতে পেতেন তাঁর মধুমাখা কণ্ঠে রবীন্দ্রবাণী: ‘তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে/ তা বলে ভাবনা করা চলবে না/…আসবে পথে আঁধার নেমে,/ তাই বলে কি রইবি থেমে…।’ মৃত্যুর আগে মেদিনীপুর জেল থেকে বড় বৌদি বনকুসুম দেবীকে যে চিঠি লেখেন, তাতেও ছিল ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে উদ্ধৃতি। ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায় জানাচ্ছেন, ফাঁসির আগে প্রদ্যোৎ জেল থেকে পরপর দু’টি চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, ‘সম্ভবত জেলের কঠিন নিয়ম ভেদ করে সে চিঠি দু-খানি কবির হাতে পৌঁছায়নি।’

হুগলির গোপীনাথ সাহাকে খুব ভালবাসতেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, কাজি নজরুল ইসলাম। টেগার্ট সাহেবকে মারতে গিয়ে গোপীনাথ ভুল করে নিরপরাধ ডে সাহেবকে হত্যা করলেন। তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলে। ফাঁসির আগের রাতেও গোপীনাথ দিব্যি ঘুমোচ্ছিলেন। মৃত্যুভয় তাঁর নিশ্চিন্ত নিদ্রাকে স্পর্শও করতে পারেনি। ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত লিখেছেন: ‘ফাঁসির জন্য ডাকতে গেছে, দেখে গোপী ঘুমুচ্ছে। এক কথাতেই উঠে সঙ্গে চলল। কী সে পা ফেলার ভঙ্গী! বুক ফুলিয়ে ফাঁসির কাঠে দাঁড়াল, নিজেই যেন সাহায্য করতে চায় ফাঁসির রশিটা গলায় বাঁধতে, কিন্তু ওর হাত দুটো তখন পেছনে বাঁধা।’

ষোলো বছরের গোপীনাথের ফাঁসি হল ১৯২৪-এর ১ মার্চ। তাঁর শবদেহ বাইরে আনতে দেওয়া হবে না, জেলেই সৎকার করা হবে। প্রতিবাদে ছাত্র-যুবকেরা জেলের বাইরে পিকেটিং শুরু করল। আপসহীন চরমপন্থী সুভাষচন্দ্র বসু এই পিকেটিংয়ে যোগ দিলেন। তিনি যে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল তা পুলিশের অজানা ছিল না। এই ঘটনায় তাঁর নাম পুলিশের খাতায় পাকা হয়ে গেল।

কৃতজ্ঞতা: শুভেন্দু মজুমদার

Independence Day Special Independence Day Revolutionist Kanailal Dutta

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}