Advertisement
E-Paper

শাশুড়িমা এখন তারা, জামাইভোগ লুচি-মাংসও আজ অতীত

এই মানব সংসারে জামাইদের যেমন শ্রেণিবিভাগ আছে, তেমনই আছে শাশুড়িদেরও।

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৮ ১৯:০২
অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব

আসলে জামাইষষ্ঠীর পুরো পার্বণটাই তো শাশুড়ি নির্ভর। শাশুড়ি আছেন তো জামাইষষ্ঠী আছে। শাশুড়ি নেই তো জামাইও নেই, ষষ্ঠীও নেই। শ্বশুরেরা হলেন তাঁদের কনফিডেন্সের জায়গা। লেফট ব্যাক এবং রাইট ব্যাকের দায়িত্ব একলার কাঁধে নিয়ে তাঁরা যে কোনও সমস্যাকে আটকে দিতে পারেন। সমাধান করে দিতে পারেন। কিন্তু স্ট্রাইকার হয়ে গোল দিয়ে আসতে হয় শাশুড়িদেরই। এর ব্যতিক্রম যে নেই তা আমি বলছি না। তবে তার সংখ্যা খুবই কম। এই মানব সংসারে জামাইদের যেমন শ্রেণিবিভাগ আছে, তেমনই আছে শাশুড়িদেরও।

বিষয়টা আপনাদের একটু বিশদে বলি। প্রথমেই আসি আমার চোখে দেখা সিরিয়াল শাশুড়িদের কথায়। এই ক্যাটেগরির শাশুড়িরা টিভি সিরিয়ালের হাসি-কান্না-হীরা-পান্না অনুযায়ী সব কিছু বিচার করে থাকেন। তাই এঁরা নিজের জামাইকেও সিরিয়ালের এক জন অভিনেতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পছন্দ করেন। যেমন, আমার এক তরুণ দাড়িওয়ালা বন্ধুকে তার নতুন শাশুড়ি ‘তোমায় না, আজ ঠিক কপালকুণ্ডলার কাপালিকটার মতো দ্যাখাচ্ছে!’ বলে একগাল হেসেছিলেন। এর ঠিক পরেই আসি লিরিক্যাল শাশুড়িদের কথায়। এঁরা সবসময় মুখে-মুখে কিছু কবিতা আউড়ে থাকেন। হতেই পারে, সেই সময় পরিবেশ বা পরিস্থিতির সঙ্গে সেটা একেবারেই খাপ খাচ্ছে না। তবু তিনি বলেন। ধরা যাক, জামাইষষ্ঠীর দিন দুপুরে খেতে বসে বাড়ির নতুন জামাই সবে ঘি দিয়ে ভাত মাখছে, এমন সময় তিনি চাপা গলায় বলে উঠলেন, ‘দুর্ভিক্ষ শ্রাবস্তীপুরে যবে, জাগিয়া উঠিল হা হা রবে...’, শুনে জামাই তো বিষম-টিষম খেয়ে একশা।

বিষম খেলে তো মানুষ জল খায় আর সেই জলের অনুষঙ্গে মিনারাল শাশুড়ির কথায় আসি। শাশুড়ি তাঁর নতুন জামাইকে সুন্দর কাচের গ্লাসে টলটলে জল খেতে দিয়েছেন। দিয়ে বলছেন, ওটা তো সাধারণ জল নয়, মিনারাল ওয়াটার। দিনকাল যা পড়েছে, তাতে নাকি সবসময় মিনারাল ওয়াটারই খাওয়া উচিত। তার পর সেই একগ্লাস জলে কী কী মিনারাল আছে তা জামাইকে ধীরে ধীরে বলেছেন। এর পর, সে দিন তিনি জামাইকে যে পদগুলি খেতে দেবেন, তার কোনটিতে কী কী মিনারাল রয়েছে সেগুলোও একে একে মুখস্ত বলতে শুরু করেছেন। প্রিয় পাঠক, আপনি শুধু এই সিচুয়েশনে জামাইয়ের মুখের অবস্থাটা এক বার কল্পনা করুন!

এর পর আসি মেডিক্যাল শাশুড়ির প্রসঙ্গে। এঁরা জামাইবাবাজিকে কিছু খেতে দিলে সঙ্গে একটা ওষুধ খাবার পরামর্শও দিয়ে থাকেন। যেমন, ‘এ হে, আম খাওয়ার পরেই কফিটা খেলে...যদি অম্বল হয়ে যায় এক ডোজ নাক্সভমিকা খেয়ে নাও বাবা!’ অথবা মধ্যাহ্নভোজের শেষে জামাই হয়তো তৃপ্তিতে একটা কিং-সাইজ ঢেঁকুর তুলল, সঙ্গে সঙ্গে শাশুড়ি বললেন, ‘আয়ুর্বেদে বলেছে, গুরুভোজনের পর এককুচি আদা মুখে রাখলে সব হজম হয়ে যায় আর বদ বায়ুরও বিনাশ ঘটে!’

এ বার আপনাদের খুব কমন দু’ধরনের শাশুড়ির কথা বলব। এঁরা হলেন ইমোশনাল এবং ট্র্যাডিশনাল। ইমোশনাল শাশুড়িরা জামাইকে পাহাড়প্রমাণ খাবার দিয়ে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করেন। যেমন একটি নমুনা: ‘আজ যদি তোমার মা বেঁচে থাকতেন তবে তুমি অতটা মাটন কষা আর কেসর রাবড়ি পাতে ফেলে উঠে যেতে পারতে না বাবা! (নাক টেনে) আমি তো তোমায় এ জন্মে পেটে ধরিনি (চোখ মুছে)...আমার কথা তুমি রাখবে কেন বলো!’ এর পর আসি ট্র্যাডিশনাল শাশুড়িদের কথায়। এঁরা তাঁদের সমস্ত কাজকর্মের মধ্যেই একটা ট্র্যাডিশনাল টাচ মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। যেমন, ষষ্ঠীর দিন জামাইকে মাটিতে আসন পেতে বসানো, কাঁসার থালা-বাটিতে খেতে দেওয়া, শাক-শুক্তো-ঘণ্ট-অম্বল এমন সব প্রাচীন বনেদি পদ জামাইয়ের পাতে পরিবেশন করা এবং তার পছন্দ হোক ছাই না-হোক সেগুলো চেয়ে-চিনতে নেওয়ার অনুরোধ করা।

শাশুড়ি তালিকার সবশেষে আসা লজিক্যাল শাশুড়িরা আমার মতে সবচেয়ে ঠিকঠাক। তাঁরা জামাইয়ের রুচি জানেন, পছন্দ চেনেন এবং পেটের অবস্থা বোঝেন। এঁরা একপাতে সব কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্য জামাইষষ্ঠীর দিন বাবাজীবনের গলায় বাঁশ পুরে দ্যান না। ইংলিশ ফ্রাইটা সে যদি খেতে বসার অনেক আগেই স্যালাড আর মেয়োনিজ দিয়ে খেয়ে নিতে চায় কিংবা ভাতের পাতে না-খেয়ে দইটা যদি সে পরে ধীরেসুস্থে খাবে বলে, তা হলে এক বারের জন্যও ঘ্যানঘ্যান করেন না। আমার তো চিরকাল এমন লজিক্যাল শাশুড়িদেরই পছন্দ— ঠিক যেমন ছিলেন আমার নিজের শাশুড়িমা।

আমার শাশুড়িমার হাতে আমি সব মিলিয়ে বার চারেক জামাইষষ্ঠী খেয়েছি। মাত্র পঞ্চাশ পেরিয়েই তিনি তারা হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর হাতের রান্নার মতোই অভিনব ছিল তাঁর রুচি এবং সূক্ষ্ম রসবোধ। তাঁর হাতেই আমি জামাইভোগ ফুলকো লুচি দিয়ে জামাইভোগ খাসির কালিয়া খেয়েছি। কী হল! শুনে ভুরু কোঁচকালেন তো! তা হলে এটাও একটু বিশদে বলি। না, এই জামাইভোগ জিনিসটা কিন্তু কিষেনভোগের মতো কোনও আম নয় বা মোহনভোগের মতো কোনও হালুয়া-গোত্রের পদও নয়। জামাইভোগ কথাটি তৈরি হয়েছে জামাইয়ের খাবার উপযুক্ত— এই বিশেষ ভাবনা থেকে। জামাই যে হেতু স্পেশাল, তাই তার জন্যে স্পেশাল স্পেশাল খাবারদাবারের ব্যবস্থা হবে, এটাই তো খুব স্বাভাবিক। এই কারণে জামাইষষ্ঠীর হপ্তাখানেক আগে থেকে বাংলার আকাশে-বাতাসে শুধু জামাইভোগ কথাটির গুঞ্জন শুনতে পাওয়া যায়। জামাইভোগ আম, জামাইভোগ লিচু, জামাইভোগ ইলিশ, জামাইভোগ গলদাচিংড়ি, জামাইভোগ খাসি— এমন আরও কত কী!

জামাইষষ্ঠীর আগুন বাজারে দরাদরি চলে না। অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব

সাধারণ মাচার পটলের যা দাম, জামাইভোগ পটলের দাম তার থেকে কিলোতে অন্তত তিরিশ টাকা বেশি। হাতে নিয়ে মন দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। না, অন্য রকম কিছু তো মনে হচ্ছে না। একই তো সবকিছু। শুধু একটু বেশি লম্বাটে আর প্রত্যেকটা খুবই টাটকা। জামাইভোগ হিমসাগর চেহারায় যেমন পুরুষ্টু, তার রংও তেমনই কাঁচা সোনার মতো। অনেক নেড়েচেড়েও তাদের কারও গায়ে দাগ-ছোপ খুঁজে পাওয়া যায় না। জামাইভোগ লিচুরা সাইজে যেমন বড়, রঙেও তেমনই টুকটুকে। দেখেই বোঝা যায় এরা মিষ্টি না হয়ে যায় না। জামাইভোগ ইলিশেরা সবাই প্রায় বাংলাদেশের। ওজন কারওরই দেড় কিলোর নীচে নয়। ক্যালিফোর্নিয়ার সাহেবদের মতো লালচে-সাদাটে গা। পেট বরাবর ঘ্যাঁচাং করে বঁটি টানলে ভেতরটাও একই রকম সাদা। আহা রে! সাধের জামাইরা এই মাছভাজা তেল দিয়ে প্রথম পাতের ভাত খেয়ে কী আনন্দই না পাবে! বাজারের উঁচু টাটে লালচে ডুমের আলোর নীচে হাত-পা নাড়িয়ে বক্তব্য রাখা জামাইভোগ গলদা চিংড়ির এক-একটি দেড়শো গ্রামের ওপরে। গায়ের জেল্লাও দেখবার মতো। আমি বাজারে ঘুরে ঘুরে এদের দেখি আর ভারি অসহায় লাগে।

আসলে শাশুড়ির হাতের জামাইভোগ লুচি বলতে, আমি গাওয়া ঘিয়ে ভাজা সাড়ে তিন থেকে চার ইঞ্চি মাপের ধবধবে সাদা ফুলকো লুচিকে বোঝাচ্ছি, যার ওপর ও নীচ দুটো ভাগই সমান ভাবে ফুলে থাকত। এই লুচির গায়ে কোনও তেল-ঘি লেগে থাকত না। এদের বুকের মধ্যে একটি আধাআধি কাটা মাংসের আলু বা কাই-বিহীন ড্রাই মেটের দু’-তিনটে টুকরো খামচে তুলে মুখে ফেলার সময় তারা একটুও ভেঙে যেত না। মানে, ময়ামটি হত একদম ঠিকঠাক। জামাইভোগ খাসির কালিয়া হল বোনলেস রেওয়াজি খাসির একটি মাখোমাখো পদ, যার টুকরোগুলো জিভ স্পর্শ করলেই মাখনের মতো মিলিয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, আমার শাশুড়িমা একটি জামাইভোগ আলুভাজাও ভাজতেন, লুচির প্রসঙ্গে সেই স্মৃতি মনের কোণে হঠাৎ উঁকি দিয়ে গেল। সেই আলুভাজার ফালিগুলো ঠিক ঝিরিঝিরি আলুভাজার মতো সরু নয়। তার চেয়ে সামান্য লম্বা ও স্বাস্থ্যবান। তাঁর হাতের জামাইভোগ ফিশফ্রাই...মানে মোটা করে কাটা সিঙ্গল ক্রাম্প ভেটকি ফিলেকে...থাক আর বলতে ভাল লাগছে না। আসলে এগুলো আলোচনা করতে শুরু করলেই সেই সব ফেলে আসা দিনের সুঘ্রাণ নাকে ভেসে আসে, আর মনখারাপ হয়।

Bengali Festival Jamai Sasthi Special
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy