খুব অল্প সময়ের মধ্যে হঠাৎ যদি অনেকটা পরিশ্রম করা হয়, তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই আসে ক্লান্তি, সঙ্গে পেশিতে ব্যথাও হতে পারে। যাঁরা নিয়মিত শারীরচর্চা করেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও আচমকা হাই-ইন্টেনসিটি ওয়ার্কআউট করলে এই ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, শরীরে এনার্জি তৈরি করতে যতটা অক্সিজেন দরকার, তা না থাকলে অক্সিজেন ছাড়াই এনার্জি তৈরি করতে বাধ্য হয় শরীর। আর তখনই তৈরি হয় ল্যাকটিক অ্যাসিড। এই অতিরিক্ত ল্যাকটিক অ্যাসিড পেশিতে সঞ্চিত হয়েই ব্যথার উৎপত্তি হয়।
নেপথ্যের কারণ কী?
অক্সিজেন ছাড়া গ্লুকোজ় তৈরি করতে গিয়ে যে ল্যাকটিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয়, তা ল্যাকটেট এবং হাইড্রোজেন আয়নে ভেঙে গিয়ে পেশির পিএইচ ব্যালান্স কমিয়ে দেয়। আর তার ফলেই ব্যথা শুরু হয়।
পেশিতে ল্যাকটিক অ্যাসিড জমাট বাঁধার পরে তা ফের কিডনি ও লিভারের মাধ্যমে রক্তে মিশেও যায়। কিন্তু কারও কিডনি বা লিভারে সমস্যা থাকলে এই প্রক্রিয়াটি হতে সময় লাগে। তাই এই ধরনের ব্যথা দেখা দিলে কিডনি বা লিভারে কোনও সমস্যা আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া দরকার।
আগাম প্রস্তুতি না নিয়েই হঠাৎ কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের ফলে এই সমস্যা দেখা দেয়। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, “হাই-ইন্টেনসিটি এক্সারসাইজ়ের ফলেই যে এমনটা হবে, এর কোনও মানে নেই। তবে হঠাৎ অতিরিক্ত পরিশ্রম পেশির স্নায়ুকে উত্তেজিত করার ফলে পেশিতে ব্যথার উৎপত্তি হয়। যে কারণে ভারী ব্যাগ হাতে তুললে বা হঠাৎ অনেক ধাপ সিঁড়ি ভাঙলে হাতের ও পায়ের পেশিতে ব্যথা হয়। আবার অনেক সময়ে সেপসিস বা ইনফেকশনের মাত্রা বেড়ে গেলেও ল্যাকটিক অ্যাসিড জমা হতে পারে। হাসপাতালে ভর্তি থাকলে রোগী তো আর শারীরিক পরিশ্রম করেন না। তাঁদের দেহে ল্যাকটিক অ্যাসিড জমা হয় সেপসিসের কারণে। আমরা অনেক সময়ে রোগীর দেহে ল্যাকটিক অ্যাসিডের মাত্রা মেপে বিচারকরি তাঁর শরীরে ইনফেকশনকতটা ভয়াবহ।”
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না। অনেকে আবার দীর্ঘ দিনের অনভ্যাসের পরে হঠাৎ ব্যায়াম শুরু করেন। শরীরকে সইয়ে না নিয়েই ব্যায়াম করা কিংবা ট্রেকে যাওয়ার মতো ঘটনা পেশির উপরে চাপ সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে কিডনি বা লিভার ফাংশন দুর্বল হয়ে গেলেও এই সমস্যা গভীরতর হয়ে ওঠে।
অন্য মতে
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে দেখা গিয়েছে, শুধু পেশিতে ল্যাকটিক অ্যাসিড সঞ্চিত হওয়াই যে ব্যথার মূল উৎস, এমনটা না-ও হতেপারে। ল্যাকটিক অ্যাসিড মাসলের গায়ে বেশিক্ষণ জমলেও ব্যথাহওয়ার কথা নয় বলেই মনেকরেন চিকিৎসকদের একাংশ।তাঁদের মতে, হঠাৎ অতিরিক্তপরিশ্রম পেশিতে মাইক্রোটিয়ারসৃষ্টি করে। ব্যথা তৈরি হয় তার থেকেই। পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিলে সেই মাইক্রোটিয়ার ধীরেধীরে সেরে ওঠে এবং নিজে থেকেই সেই ব্যথাও কমে যায়।
সমাধান ও ব্যথার উপশম
- হাই-ইন্টেনসিটি এক্সারসাইজ় করার আগে ঠিকমতো ওয়ার্ম-আপ করে শরীরকে প্রস্তুত করা দরকার।
- জোর করে কিছু করতে না যাওয়াই ভাল। যদি সাধ্যের বাইরে গিয়ে ওজন তুলতে বা পরিশ্রম করতে বাধ্য হন, তবে তা যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্রাম নিয়ে করাই ভাল।
- হাই-ইন্টেনসিটি এক্সারসাইজ়ের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে গতি এবং ওজন বাড়াতে হবে। হঠাৎ করে অনেকটা স্ট্রেচ করবেন না।
- পেশিতে ব্যথা শুরু হলে সেঁক, মালিশ ইত্যাদিতে সাময়িক উপশম হতে পারে।
- শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে হবে। প্রচুর পরিমাণে জল বা ফলের রস খেলে উপকার মিলবে। আজকাল বিভিন্ন জিমে নানা ধরনের স্পোর্টস ড্রিঙ্ক রাখা থাকে। সেগুলিও এ সব ক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে। হাতের কাছে কিছু না থাকলে গ্লুকোজ়, অর্থাৎ নুন-চিনির জলেও কাজ হবে। সেই সঙ্গে দরকার ব্যালান্সড ডায়েট।
- যদি বয়সজনিত বা অন্যান্য কারণে লিভার ও কিডনির কার্যক্ষমতাহ্রাস পায়, তা হলে তার চিকিৎসা দরকার। না হলে পেশিতে জমেথাকা ল্যাকটিক অ্যাসিডকে রক্তে ফিরিয়ে দেওয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে।
শেষ কথা
শারীরচর্চা, ট্রেকিং বা সাধারণ ভারী কাজ, কোনওটিই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া হঠাৎ করতে না যাওয়াই ভাল। নিজের শরীর ও তার ক্ষমতা বুঝেই পরিশ্রম করুন। পেশিতে ল্যাকটিক অ্যাসিড জমার সমস্যা খুব গুরুতর নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা নিজে থেকে ঠিক হয়ে যায়। তবে বমি, মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলে অবশ্যই চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)