প্রায় তিন দশক ধরে কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজ়িকে একার হাতে টেনে নিয়ে চলা সহজ নয়। আর সেখানে যদি নায়ককে একের পর এক রোমহর্ষক স্টান্ট এবং অ্যাকশন দৃশ্যে অভিনয় করতে হয়, তা হলে সেই চ্যালেঞ্জ আরও বহু গুণ বেড়ে যায়। ‘মিশন ইমপসিবল’ সিরিজ়ের অভিনেতা টম ক্রুজ় বছরের পর বছর ধরে সেটাই করে চলেছেন। শনিবার দেশে মুক্তি পেয়েছে সিরিজ়ের অষ্টম পর্ব ‘মিশন ইমপসিবল: দ্য ফাইনাল রেকনিং’। পাশাপাশি, ৬২ বছর বয়সি টমের ফিটনেসও নতুন করে অনুরাগীদের চর্চার কেন্দ্রে চলে এসেছে। অনুরাগীদের একাংশের মতে, অভিনেতার বয়স যেন দিনে দিনে কমছে। পর্দায় ‘ইথান হান্ট’ হয়ে উঠতে কী কী করতে হয় তাঁকে?
আরও পড়ুন:
ফিটনেসের নেপথ্যে
অতীতে একাধিক বার টম জানিয়েছেন, তিনি নিজেই নিজের স্টান্ট করতে পছন্দ করেন। বডি ডাবল নৈব নৈব চ! বুর্জ খলিফায় চড়া থেকে শুরু করে বিমান থেকে ঝুলে থাকা— এই ফ্যাঞ্চাইজ়ির জন্য কী না করেছেন টম। একাধিক বার ছোট-বড় চোট পেয়েছেন। এই ফ্যাঞ্চাইজ়িতে বড় মাপের চোটের সেই সংখ্যাই তিন। সেরে উঠেই আবার পরবর্তী চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। তবে এর জন্য সারা বছর নিজের ফিটনেসের ক্ষেত্রে কোনও রকম ফাঁকি রাখেননি টম। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘‘নিজে স্টান্ট করার জন্য প্রতি দিন প্রশিক্ষণ, নিয়মানুবর্তিতা এবং প্রস্তুতি প্রয়োজন।’’ গত বছর প্যারিস অলিম্পিক্সের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে রোমহর্ষক স্টান্ট পারফর্ম করে স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শককে চমকে দিয়েছিলেন টম।

‘মিশন ইমপসিবল’ সিরিজ়ের দ্বিতীয় ছবিতে (উপরে) এবং চতুর্থ ছবিতে (নীচে) টম ক্রুজ়। ছবি: সংগৃহীত।
শরীরচর্চায় ফাঁকি নয়
নিজেকে ফিট রাখতে টম ক্রুজ় বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করেন। সপ্তাহে ছ’দিন শরীরচর্চা করেন তিনি। এই প্রসঙ্গে টম বলেছেন, ‘‘বিষয়টা অনেকটা প্রতি দিন দাঁত মাজার মতো। সময় কম লাগলেও করতেই হবে। বাদ রাখা যাবে না।’’ ওয়েট ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি থাকে বিভিন্ন রকমের ফাংশনাল ট্রেনিং। তবে বয়স বাড়ছে বলে, সম্ভাব্য চোট-আঘাতের প্রতিও তিনি বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করেন। আলাদা করে কার্ডিয়োর উপরেও জোর দেন টম।
মিশন ইমপসিবল সিরিজ়ে একাধিক বার টমকে দৌড়তে দেখা গিয়েছে। পারফরম্যান্স ঠিক রাখতে নিজের শরীরচর্চার মধ্যেও তিনি দৌড় এবং সাইক্লিংকে রেখেছেন। পাশাপাশি হাইকিং, রক ক্লাইম্বিং এবং কায়াকিংও করে থাকেন টম। কার্ডিয়োর জন্য নিয়মিত সাঁতার কাটা, ট্রেড মিল এবং স্প্রিন্টিং করেন তিনি। রবিবার বিশ্রাম নেন।

শরীরচর্চার মধ্যে কার্ডিয়োকে প্রাধান্য দেন টম ক্রুজ়। ছবি: সংগৃহীত।
ডায়েটই শেষ কথা
শুধু শরীরচর্চা করলেই হবে না। সুঠাম শরীরের জন্য নিজেকে ডায়েটে বেঁধে ফেলতে হবে। সারা বছর কম ক্যালোরি যুক্ত খাবার খান টম। সূত্রের খবর, ‘টপ গান: মাভেরিক’-এর শুটিংয়ের সময় দিনে মাত্র ১২০০ ক্যালোরি গ্রহণ করতেন টম। অভিনেতা সাধারণত কম আঁচে সিদ্ধ বা গ্রিল করা খাবার খান। কারণ, উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করা খাবার ত্বকের বার্ধক্য এবং প্রদাহের কারণ হতে পারে। টমের খাবার কম কার্বোহাইড্রেট যুক্ত এবং সেখানে নুন থাকে না। তেল থাকলেও নামমাত্র। পুষ্টিবিদদের একাংশের মতে, তেল, নুন বা চিনি কম খেলে চেহারার ঔজ্জ্বল্য বাড়ে।
সারা দিনে টম মূলত তিন বার খাবার খান। কিন্তু তার বাইরে স্ন্যাক্সও চলে। তবে কোনও ফাস্টফুড নয়, মূলত বিভিন্ন ধরনের ফল দিয়ে তা সাজানো হয়। সঙ্গে থাকে পিনাট বাটার এবং খেজুর। এর পাশাপাশি তাঁকে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন সাপ্লিমেন্টও খেতে হয়।
বাংলা কী বলছে?
একটা সময় ছিল, যখন বলা হত মঞ্চে অভিনয়ের ক্ষেত্রে অভিনেতাকে সব সময়ে ফিট থাকতে হয়। কিন্তু অভিনেতা কৌশিক সেন মনে করিয়ে দিতে চাইছেন, এখন মঞ্চের পাশাপাশি ছবি এবং ধারাবাহিকের ক্ষেত্রেও একজন অভিনেতাকে ফিট থাকতে হয়। ধারাবাহিকে নিয়মিত একাধিক মধ্যবয়সি এবং বর্ষীয়ান অভিনেতারা শুটিং করেন। কৌশিকের যুক্তি, ‘‘ধারাবাহিকে দিনের একটা বড় সময় দাঁড়িয়ে শট দিতে হয়। দর্শক পর্দায় ভাবতেই পারেন যে চরিত্রটি দাঁড়িয়ে বা বসে রয়েছে। কিন্তু ওই একটি শট হয়তো একাধিক বার রি-টেক হয়েছে। তাই ফিট থাকতেই হয়।’’

প্যারিস অলিম্পিক্সের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে স্টান্ট করছেন টম ক্রুজ়। ছবি: সংগৃহীত।
২০১৭ সালে ‘স্বপ্নসন্ধানী’র ‘দ্রোহকাল’ নাটকের প্রথম শোয়ের আগের দিন মহড়ায় কৌশিকের স্ত্রী রেশমী সেনের পায়ের হাড় ছ’টি টুকরো হয়ে ভেঙে যায়। অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু রেশমী অভিনয় করার জেদ ধরেন এবং পরদিন পায়ে প্লাস্টার সমেত হুইলচেয়ারে বসে অভিনয় করেন। কৌশিক বলছিলেন, ‘‘তার পর সেরে ওঠার পরেও টানা ওই ভাবেই পায়ে স্ক্রু নিয়েই প্রতিটা শোয়ে অভিনয় করতে হয়েছে। ও এক জন ওড়িশি নৃত্যশিল্পী। তাই ফিটনেস না থাকলে ওই ভাবে অভিনয় করতে পারত না।’’ কৌশিকের ধারণা, টম ক্রুজ়ের ফিটনেসের নেপথ্যে পরিশ্রমের পাশাপাশি রয়েছে অদম্য মনোবল। উল্লেখ্য, কৌশিক, রেশমী এবং তাঁদের পুত্র ঋদ্ধির জন্য বাড়িতেই প্রশিক্ষক আসেন। তাঁর পরামর্শমতোই তিন জন শরীরচর্চা করেন।
বাস্তবে কি ‘পসিবল’?
বুঝতে হবে, এক জন তারকাকে শুরু থেকেই নিজের ফিটনেসের প্রতি খেয়াল রাখতে হয়। দীর্ঘ দিন ধরে অভ্যাস থাকলে, ষাটোর্ধ্ব জীবনেও টম ক্রুজ়ের মতো ফিটনেসের অধিকারী হওয়া সম্ভব বলেই জানালেন ফিটনেস প্রশিক্ষক অনুপ আচার্য। তিনি বললেন, ‘‘বয়স বাড়লে স্বাভাবিক ভাবেই শরীরের কর্মক্ষমতা কমে আসে। শরীরকে সচল রাখতে শরীরচর্চা, সুষম আহার, পর্যাপ্ত ঘুম, জল পান— এ রকম কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখলে সুঠাম দেহ তৈরি করা সম্ভব।’’ তবে এই প্রসঙ্গে, মনোবলের উপর আলাদা করে জোর দিতে চাইলেন অনুপ, তাঁর কথায়, ‘‘‘অবসর জীবন’— এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তার জন্য চাই মনোবল।’’
বর্ষীয়ানদের সাফল্য ডায়েটে
ফিটনেস বাড়াতে ডায়েট অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু পুষ্টিবিদ শ্রাবণী মুখোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিতে চাইছেন, ডায়েট মানে কম খাওয়া বা উপোস নয়! ডায়েটের অর্থ বয়স আন্দাজে সুষম আহার। তিনি বললেন, ‘‘বয়সের সঙ্গে আমাদের ফিটনেস কমে আসে। ৪০ বছরের পর শরীরের পুষ্টিগত চাহিদার সঙ্গে ৬০ বছর পরবর্তী চাহিদার পার্থক্য রয়েছে।’’ বয়সের সঙ্গে দেহে বিপাকহার কমে আসে। তাই নিয়মিত অল্প শরীরচর্চা মবিলিটি বজায় রাখে। শ্রাবণীর বিশ্বাস, ৬০ বছরে পা রেখে টম ক্রুজ় ফিটনেসে মনোনিবেশ করেননি। বরং তিনি শুরু থেকেই বয়স আন্দাজে ফিটনেসে মন দিয়েছেন। শ্রাবণীর কথায়, ‘‘টম ক্রুজ়কে দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই বয়সে অনেকেই এ রকম ফিট থাকেন। আসলে নিজেকে বুঝতে হবে, যে আমি কী ভাবে বাঁচতে চাইছি।’’

‘মিশন ইমপসিবল: দ্য ফাইনাল রেকনিং’ ছবির শুটিংয়ের ফাঁকে টম ক্রুজ় (বাঁ দিকে) এবং ছবির পরিচালক ক্রিস্টোফার ম্যাকুয়ারি। ছবি: সংগৃহীত।
শ্রাবণীর মতে, ইন্টারনেটে বা কোনও কিছু দেখে বিজ্ঞান না বুঝে ডায়েট শুরু করা উচিত নয়। তাতে ক্ষতি বেশি হয়। ৬০ বছরের পরে কী রকম হওয়া উচিত ডায়েট? দৈনিক খাবারের মধ্যে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, বিভিন্ন ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান থাকতেই হবে। শ্রাবণী বললেন, ‘‘৬০ শতাংশ ক্যালোরি যেন কার্বোহাইড্রেট থেকে আসে। বয়স বাড়লে দেহে ‘বিএমআর’ (বেসাল মেটাবলিক রেট) কমে আসে। তাই সরল কার্বোহাইড্রেটের পরিবর্তে জটিল কার্বোহাইড্রেট খাওয়া উচিত। যেমন, ময়দার পরিবর্তে ভুসি মেশানো আটা খাওয়া যেতে পারে।’’
বয়স্কদের ক্ষেত্রে দৈনিক ক্যালোরির ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রোটিন থেকে আসা উচিত বলেই জানালেন শ্রাবণী। বললেন, ‘‘খুব বেশি প্রোটিন এই বয়সে আবার খাওয়া যাবে না। কারণ মনে রাখতে হবে বিভিন্ন প্রত্যঙ্গেরও বয়স হয়েছে। তাই তাদের উপর খুব বেশি চাপ দেওয়া যাবে না।’’ এই প্রোটিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্রাণীজ প্রোটিন (যেমন মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি) এবং বাকিটা উদ্ভিজ্জ প্রোটিন (ডাল, ছোলা, সয়াবিন, মটর, রাজমা ইত্যাদি) হওয়া উচিত। শ্রাবণী বললেন, ‘‘আমার ধারণা, টম ক্রুজ়ও নিশ্চয়ই কোনও পুষ্টিবিদের পরামর্শ মেনেই খাবার খান। তাই ষাট বছরের পরে কেউ যদি মনে করেন সুস্থ জীবনযাপন করবেন, তা হলে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতেই পারেন।’’ কারণ, তার ফলে কী কী ওই ব্যক্তির খাওয়া উচিত এবং কী কী খাওয়া উচিত নয়, তা নিয়ে সুষ্ঠু ধারণা তৈরি হবে।
আরও পড়ুন:
কী কী সাবধানতা
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরে চোট-আঘাতের সম্ভাবনা বাড়ে। তাই হঠাৎ কোনও ডায়েট বা শরীরচর্চা শুরু করলে, হিতে বিপরীত হতে পারে। অনুপ বললেন, ‘‘টম ক্রুজ় বা মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে দেখে হঠাৎ অনুপ্রাণিত হয়ে বয়স্করা তাঁদের মতো হতে চাইলে বিপদ হতে পারে। এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি না করাই ভাল, যে ভবিষ্যতে ফিটনেসের পথই বন্ধ হয়ে যায়।’’
অনুপ জানালেন, ৬০ বছরের পর কোনও রকম শরীরচর্চা বা ডায়েট রুটিনে প্রবেশ করার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তিনি বললেন, ‘‘শরীর কতটা ধকল নিতে পারবে, সেটা তো প্রশিক্ষক সবচেয়ে ভাল বিচার করতে পারেন। তার তৈরি করা রুটিনে উপকারও পাওয়া যাবে, অথচ চোট পাওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে।’’ টম ক্রুজ় অনুপ্রেরণার জন্য ভাল উদাহরণ, কিন্তু অন্ধ অনুকরণের জন্য নয় বলেই জানালেন তিনি।