হাঁটু বা পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা-সহ ভিন্ন ধরনের পায়ের সমস্যায় এখন ভুক্তভোগী অনেকেই। সমস্যায় পড়ার আগে পর্যন্ত পা নিয়ে কেউই বেশি ভাবেন না। পরিচর্যার ক্ষেত্রেও দেহের অন্যান্য অংশের তুলনায় ব্রাত্য থাকে পা। মনে রাখতে হবে, গোটা শরীরের ভার বহনকারী এই অঙ্গের যত্ন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
পায়ে ব্যথার সমস্যা
কমবয়সিদের মধ্যে পায়ের ব্যথার সমস্যা কেন বাড়ছে? চিকিৎসক সুবীরকুমার মণ্ডল জানাচ্ছেন, হাড়, পেশি বা টিসু ক্ষতিগ্রস্ত হলে যন্ত্রণা হয়। তবে এই কারণগুলি ছাড়াও বেশ কিছু কারণে পায়ে ব্যথা হতে পারে। তার মধ্যে রয়েছে— ডায়াবিটিস, আর্থ্রাইটিস বা অবসাদ।
ডায়াবিটিস
ডায়াবিটিস রোগীদের পায়ের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। দীর্ঘ দিন ধরে রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকায় পায়ের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যাকে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি বলা হয়। ডা. মণ্ডল বললেন, “ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে পা ফোলা, ব্যথা, ফাটা, পায়ের পাতা ক্রমশ অবশ হয়ে যাওয়া বা কাঁটা ফোটার মতো অনুভূতি হয়। আগে থেকে সচেতন না হলে পায়ে ব্লিস্টার বা জলপূর্ণ ঘা পর্যন্ত হতে পারে।” বেশ কিছু নিয়ম মানলে এই সমস্যা থেকে খানিক মুক্তি মেলে—
- নিয়মিত ঈষদুষ্ণ জলে পা ডুবিয়ে রাখা।
- পায়ে ছত্রাকঘটিত সংক্রমণ যাতে না হয়, সে দিকে নজর রাখা।
- ডায়াবেটিক রোগীদের জন্যবিশেষ জুতো ব্যবহার করারপরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।
আর্থ্রাইটিস
আর্থ্রাইটিস কথার অর্থ প্রদাহ। এটি মূলত দু’ধরনের— রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এক ধরনের অটোইমিউন ডিজ়িজ়। মূলত কমবয়সি মহিলাদের (বয়স ৩০-৫০) ক্ষেত্রে এই সমস্যা দেখা যায়। ঘুম থেকে ওঠার পর দেহের বিভিন্ন গাঁট বা জয়েন্টে প্রবল ব্যথা হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে ব্যথা কমতে থাকে। সাধারণত হাঁটু, কোমর, হিপ জয়েন্ট এবং পায়ের আঙুলে বেশি ব্যথা হয়। এ ক্ষেত্রে শুয়ে বসে থাকলে ব্যথা বাড়ে। তাই কাজের মধ্যে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। পঞ্চাশোর্ধ্বদের মধ্যে অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস বেশি দেখা যায়। বয়স বাড়লে অস্থিসন্ধির কার্টিলেজ ক্ষয় হতে শুরু করে। এই কার্টিলেজ আসলে দুটো হাড়ের মাঝে থাকা ক্যাপ বা টুপি। কার্টিলেজের ক্ষয় হলে হাড় উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। হাড়ে যেহেতু স্নায়ুগুলি মুক্ত অবস্থায় থাকে এবং সংবেদনশীল হওয়ায়, হাঁটাচলা করার সময়ে হাড়গুলি কাছাকাছি এসে প্রদাহ তৈরি করে। ফলে ব্যথা অনুভূত হয়। এই দুই ধরনের আর্থ্রাইটিস থেকে মুক্তি পেতে ডায়েট মেনে চলা, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নিয়মিত হাঁটাহাঁটি, শারীরচর্চা জরুরি।
প্লান্টার ফাসাইটিস
অনেক সময় ঘুম থেকে ওঠার পরে মাটিতে পা ফেলতে গেলে গোড়ালিতে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হয়, বহুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলেও এই ধরনের সমস্যা দেখা যায়। ডা. মণ্ডলের কথায়, “আমাদের পায়ের তলায় হাড় এবং পেশির মাঝে পাতলা পর্দা থাকে, যাকে ফাসা বলে। এটির নমনীয়তা নষ্ট হয়ে গেলে, গোড়ালিতে টান পড়ে, ফলে প্রদাহ তৈরি হয়। এই ঘটনাকেপ্লান্টার ফাসাইটিস বলা হয়।” ওজন নিয়ন্ত্রণ করা, ব্যথা হলে গোড়ালিতে বরফ সেঁক দেওয়া এবং ভাল জুতো পরা জরুরি।
কী ভাবে নেবেন পায়ের যত্ন
ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট সোনালি সেনগুপ্ত বললেন, “রোজ ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই বেশ কিছুক্ষণ পা স্ট্রেচ করুন। পায়ের পাতায় ধীরে ধীরে মাসাজ করলে আরাম পাওয়া যায়। একটি টেনিস বল পায়ের পাতার তলায় রেখে গোড়ালি থেকে আঙুল পর্যন্ত ঘোরান। শুধু সকালে নয়, দিনের যে কোনও সময়ে এই ব্যায়ামটি করা যায়। বলটি ঘোরানোর সময়ে পায়ের পাতায় এবং গোড়ালি দিয়ে হালকা করে চাপ দিলে ব্যথার উপশম হয়।” পায়ের প্রতিটি সমস্যার আলাদা চিকিৎসা রয়েছে। সোনালি কিছু সাধারণ নিয়মেরউল্লেখ করলেন যাতে ব্যথারউপশম হয়:
- কম বয়স থেকেই নিয়মিত হাঁটাহাঁটি, বিভিন্ন ধরনের শারীরচর্চা কিংবা সাইকেল চালানোর মতো অভ্যাসের মধ্যে থাকলে পায়ে ব্যথার সমস্যায় ভুগতে হবে না।
- পায়ের তলায় বা গোড়ালিতে ব্যথা হলে উষ্ণ গরম জলে সৈন্ধব লবণ মিশিয়ে ১০-১৫ মিনিট পা ডুবিয়ে রাখলে আরাম মেলে।
- গোড়ালির উপরে হাঁটা অভ্যাস করলে এই সমস্যা থেকে খানিক মুক্তি মেলে।
- হাঁটুতে ব্যথা হলে চেয়ারে বসে এক বার করে ১৮০ ডিগ্রিতে শূন্যে তুলে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে, আবার নীচে নামিয়ে আনতে হবে। এই ভাবে ১০ বার করে ৪-৫টি সেট করলে হাঁটুর ব্যথা কমবে।
- যাঁরা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ বা রান্নাবান্না করেন, তাঁদের পায়ে বিশেষত হাঁটুতে ব্যথার সমস্যা দেখা যায়। এক ভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে ফাঁক পেলে একটু বসে নিন। একটা ছোট টুল রেখে তাতে পা তুলে বসতেও পারেন।
নিয়মিত হালকা গরম জলে পা চুবিয়ে রাখা, রাতে শোয়ার আগে ময়শ্চরাইজ়ার মাসাজ করা, অয়েল মাসাজ... পায়ের জন্য ভাল। কমবয়সিরা অনেক সময়েই ভুল জুতো পরার জন্য পায়ের সমস্যায় ভোগেন। একদম ফ্ল্যাট বা অতিরিক্ত হিল, দুটোতেই আপত্তি চিকিৎসকদের। বেশি হাঁটাহাঁটির কাজ যাঁদের, তাঁদের জন্য স্নিকার্স আদর্শ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)