জীবন প্লাস্টিকময়। রান্নাঘরের তাক থেকে অফিসের ডেস্ক— সর্বত্র ছড়িয়ে প্লাস্টিক। শিশুর খেলনা, এমনকি, পেট ভরানোর খাবারও আসছে প্লাস্টিকে মুড়ে। পরিবেশ দূষণ, প্লাস্টিক বর্জন নিয়ে যতই আওয়াজ উঠুক, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে বিপ্লব হোক, বাজারে গিয়ে আলু-পটল-মাছ কিনে সেই প্লাস্টিক দেওয়ার বায়না করবেন আপনিই। রেস্তরাঁয় গিয়ে খাবার খাওয়ার বদলে বাড়িতে, অফিসে খাবার আনিয়ে নেবেন প্লাস্টিকের কৌটোয়। ভাববেন, সময় বাঁচল! কিন্তু গবেষণা বলছে, সময় আসলে বাঁচছে না। বরং সময়ের নিগড়ে বাঁধা দেহঘড়ির মূল্যবান ১৭ মিনিট খোয়া যাচ্ছে। প্লাস্টিকে থাকা রাসায়নিক ক্ষতি করছে ঘুমেরও। নষ্ট করছে রোগ প্রতিরোধ শক্তি। যা থেকে ঝুঁকি বাড়ছে ডায়াবিটিস, ক্যানসারেরও।
কিন্তু দৈনন্দিন ব্যবহারের প্লাস্টিক কী ভাবে ক্ষতি করছে শরীরের?
প্লাস্টিক নিয়ে সম্প্রতি গবেষণাটি করেছে নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। গত মার্চ মাসে ওই গবেষণালব্ধ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ‘এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল’ জার্নালে। গবেষকেরা বলছেন, মশলা, খাবার রাখার কৌটো, জলের বোতলে যে পিভিসি প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় এবং রেস্তরাঁর খাবার প্যাক করার কৌটো বা ট্রেতে যে ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, তাতে হাজারো ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে। এই রাসায়নিক মস্তিষ্কের অ্যাডিনোসিন ১ রিসেপ্টরকে সক্রিয় করে দেয়। তাতে দু’রকমের ক্ষতি হয়।
১। কোষের সঙ্কেতের ক্ষতি করে
মানুষের দেহ অজস্র কোষের সমাহার। ত্বক-চুল-অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুস্থ থাকে, যদি ভাল থাকে কোষ। দৈনিক যে খাবার খাচ্ছেন, তার পুষ্টি রক্তবাহিত হয়ে পৌঁছয় কোষে। আর কোষ চালিত করে শরীর। শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যেমন মাথা, হৃদ্পিণ্ড, লিভার, কিডনি, ফুসফুস, হাত-পা যে পরস্পরের সঙ্গে ছন্দোবন্ধ হয়ে কাজ করছে, তার মূল কারণ হল কোষের পাঠানো সঙ্কেত।
ধরা যাক, রাস্তায় জল জমেছে। সেটি যে লাফিয়ে পেরোতে হবে, সে কথা চোখ বলে মাথাকে। মস্তিষ্ক নির্দেশ দেয়, হাত-পা এবং অঙ্গসঞ্চালনের সঙ্গে যুক্ত সব ক’টি শারীরিক ক্ষেত্রকে। এই যে শরীরের ভিতরের ভাষাহীন যোগাযোগ প্রক্রিয়া, এটি হয় কোষের সঙ্কেত বা সেল সিগন্যালের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন:
পরিবেশ পরিস্থিতির সাপেক্ষে শরীরে প্রতি মুহূর্তে যে বদল ঘটতে থাকে, তা সম্ভব হয় কোষের সঙ্কেতের মাধ্যমে। এ ছাড়া রোগ হলে শরীর কী ভাবে তার মোকাবিলা করবে, শরীরের পেশি, তন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা কী ভাবে মেরামত হবে, স্নায়ুতন্ত্রের যে যোগাযোগ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জরুরি, সে সবই চালিত হয় কোষের সঙ্কেতের মাধ্যমে আর প্লাস্টিকজাত রাসায়নিক সেই প্রক্রিয়াকেই বিপর্যস্ত করে।
২। দেহ-ঘড়ির ছন্দ নষ্ট করে
ঘড়ি ধরে কাজ করতে বলার নেপথ্যে কারণ আছে। আমাদের শরীরেরও একটি নিজস্ব ঘড়ি আছে। এই যে সকাল হলেই ঘুম ভাঙে, রাত হলে ঘুম পায়, দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে খিদে পায়, একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিশ্রামের ইচ্ছে হয়, সেই সবই ওই ঘড়ির জন্য। যার নাম সার্কাডিয়ান ক্লক। বাংলায় ‘দেহ-ঘড়ি’ বলা যেতে পারে।
ওই দেহ-ঘড়ির কাঁটা কড়া রুটিনের নিগড়ে বাঁধা। দৈনন্দিন প্রতিটি কাজের সময় ভাগ করে, তার হিসাব রাখে ওই ঘড়ি। এ দিক ওদি ক হলেই তার প্রভাব পড়ে দিনের বাকি সময়ের কাজে। নরওয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বলছেন, ওই দেহ-ঘড়ির রুটিন থেকে ১৭ মিনিট নষ্ট করে দেয় প্লাস্টিকের রাসায়নিকের মাধ্যমে অসময়ে সক্রিয় হওয়া অ্যাডিনোসিন। যার ফলে ক্রমানুসারে নষ্ট হতে থাকে অন্যান্য কাজের জন্য নির্ধারিত সময়। নষ্ট হয় ঘুম।
মনে হতেই পারে, দৈনন্দিন ঘুম থেকে ১৭ মিনিট নষ্ট হওয়া কী আর এমন ব্যাপার! কিন্তু গবেষকেরা বলছেন, দেহঘড়ির ১৭ মিনিট নষ্ট হওয়ার প্রভাব শুধু ১৭ মিনিটে থেমে থাকে না। প্রতিটি কাজেই তার প্রভাব পড়তে পড়তে শেষ পর্যন্ত অনেকটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়।
গবেষকেরা বলছেন, এই যে বাঁধা রুটিনের ছন্দপতন, তার প্রভাব পড়ে শরীর এবং মনেও। যা থেকে ঘুমের সময় তো কমেই, পাশাপাশি, স্থূলত্ব, স্মৃতিভ্রম বা ডিমেনশিয়া, হার্টের রোগ-সহ নানা ধরনের রোগ ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় শরীরে।