কোলেস্টেরলই যত নষ্টের গোড়া। এর কারণেই হার্টের রোগ, স্ট্রোক, লিভারের অসুখ— কী না হচ্ছে! অথচ এই কোলেস্টেরলকে হাতের মুঠোয় রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক থেকে পুষ্টিবিদেরা। কেউ বলছেন শুধু সব্জি খেয়ে থাকুন, কারও নিদান বাদাম ও বীজ খান, কেউ জোর দিচ্ছেন প্রোবায়োটিকের উপরে। অর্থাৎ, দই, গেঁজানো খাবার এই সব। অথচ সত্যিই কী খেলে কোলেস্টেরল বাড়বে না, তা ঠিকমতো জানা নেই কারও। প্রায় প্রতি দিনই এক এক রকম ডায়েটের নাম শোনা যাচ্ছে, যার বেশির ভাগটাই পরিচিতি পাচ্ছে বলিউড তারকাদের দৌলতে। ক্র্যাশ ডায়েট, কিটো ডায়েট, ইন্টারমিটেন্ট ডায়েট বা হালফিলের প্রোটিন ডায়েটের ধারায় গা ভাসাচ্ছেন কম বয়সিরা। তাতে কি আদৌ কোলেস্টেরল কমছে? অথচ জাঁকজমকের এই সব ডায়েটের আড়ালে বহু পুরনো এক ডায়েট প্রায় হারিয়েই গিয়েছে। যার নাম ‘পোর্টফোলিও ডায়েট’। কোলেস্টেরল কমিয়ে হার্টের অসুখের ঝুঁকি কমাতে এই ডায়েট নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল সেই ২০০০ সালেই। এখন আবার এই ডায়েট নিয়ে নতুন করে মাথা ঘামাচ্ছেন নানা দেশের গবেষকেরা।
পোর্টফোলিও একই গতের ডায়েট নয়। চার রকমের খাদ্যতালিকা নিয়ে ডায়েটটি তৈরি করেছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টোর ব্রিটিশ গবেষক ডেভিড জেনকিন্স। তিনি বলেছিলেন, এই ডায়েট মেনে খাওয়াদাওয়া করলে কোলেস্টেরল প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যাবে। স্বাভাবিক ভাবেই তাতে হার্টের অসুখ বা ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকিও কমবে।
মাছ-মাংস ভুলে যান, নিরামিষ ডায়েটেই কাবু হবে কোলেস্টেরল। ছবি: এআই সহায়তায় প্রণীত।
এখন কথা হল কী এই ডায়েট?
ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় ডায়েট নিয়ে খুব চর্চা হয়। ওই ডায়েট মানলে বার্ধক্যও পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব বলে দাবি করেন গবেষকেরা। ভূমধ্যসাগরীয় ডায়েট মানে ফলমূল, বীজ খেয়ে থাকা, তাতে মাছ-মাংসের জায়গা খুব কম। পোর্টফোলিও ডায়েট অনেকটা সে রকমই। তবে এই ডায়েট পুরোপুরি নিরামিষ। মাছ, মাংস বা ডিমের বদলে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন খাওয়ার উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে শাকসব্জি। মূলত চার রকম খাবার নিয়ে ডায়েটটি বানিয়েছেন ডেভিড— ১) সয়াবিন বা সয়া প্রোডাক্ট, ২) নানা ধরনের বাদাম ৩) একস্ট্রা ভার্জিন অয়েল এবং ৪) মরসুমি ফল ও সব্জি।
পোর্টফোলিও ডায়েটে বেশি করে ফাইবার, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও উদ্ভিতজাত প্রোটিন খেতে বলা হয়। তা কী রকম? সয়া প্রোডাক্টের মধ্যে সয়াবিন, সয়া মিল্ক, টোফু। একস্ট্রা ভার্জিন অয়েলের মধ্যে পড়ছে ভার্জিন অলিভ অয়েল, ক্যানোলা অয়েল ও অ্যাভোকাডো অয়েল। অর্থাৎ, রান্না এই তেল দিয়েই করতে হবে। ফাইবারের জন্য খেতে হবে নানা রকম সব্জি ও ফল। ফাইবারেরও আবার ধরন আছে। পোর্টফোলিও ডায়েটে ‘ভিসকস ফাইবার’ খেতে বলা হয়। এমন এক ধরনের ফাইবার যা অন্ত্রে গিয়ে চটচটে জেলের মতো উপাদান তৈরি করে। খারাপ কোলেস্টেরল এই জেলের গায়ে আটকে যায়। ফলে তা আর রক্তে জমা হতে পারে না। ভিসকস ফাইবার পাওয়া যাবে ওট্স, ঢেঁড়শ, বার্লি, বেগুন ও চিয়া বীজে।
শাকসব্জি, ফলমূল খেয়েই কমবে কোলেস্টেরল, ২০০০ সালে এমনই এক ডায়েটের কথা বলেন ব্রিটিশ গবেষক। ছবি: ফ্রিপিক।
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরাও ডেভিড জেনকিন্সের পোর্টফোলিও ডায়েট নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, এই ডায়েটে স্যাচুরেটেড ফ্যাট খেতে বারণ করা হয়। অর্থাৎ, যে ফ্যাট আসে রেড মিট, ও নানা ধরনের প্রক্রিয়াজাত মাংস থেকে। বদলে মোনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট আছে, এমন খাবার খেতে বলা হয়। মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট হল স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যা পাওয়া যায় অ্যাভোকাডো, চিয়া বীজ, তিসির বীজ, বাদাম, আখরোট, ক্যানোলা তেল, অলিভ অয়েল ইত্যাদিতে।
পোর্টফোলিও ডায়েটে আরও একটি উদ্ভিজ্জ উপাদানের উপর জোর দেওয়া হয় যার নাম ‘ফাইটোস্টেরল’। আমেরিকার পেনসিলভানিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা জানিয়েছেন, ডেভিড যে খাওয়াদাওয়ার তালিকা বানিয়েছিলেন, তাতে ‘ফাইটোস্টেরল’-এর উল্লেখ ছিল। এটি কোলেস্টেরলের মতোই দেখতে এক ধরনের উপাদান যা বাদাম, বীজ, শাকসব্জিতে থাকে। এর কাজ হল শরীরে ঢুকে কোলেস্টেরলকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা। কোলেস্টেরল যাতে কোনও ভাবেই রক্তবাহী ধমনীতে জমে বাধা তৈরি করতে না পারে, সে কাজই করে ফাইটোস্টেরল। তাই পোর্টফোলিও ডায়েট মানলে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাই থাকবে না।
পোর্টফোলিও ডায়েট কি মেনে চলা সম্ভব? ছবি: এআই সহায়তায় প্রণীত।
আবার কেন প্রকাশ্যে এল পোর্টফোলিও ডায়েট?
২০০৩ সালে গবেষক ডেভিড জেনকিন্স ও তাঁর সতীর্থরা পোর্টফোলিও ডায়েট নিয়ে ছোট্ট একটি ট্রায়াল চালিয়েছিলেন। ৪৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মহিলাকে নিয়ে পরীক্ষাটি চালানো হয়। তাঁদের দু’টি দলে ভাগ করে একটি দলকে কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট আছে এমন খাবার খাওয়ানো হয়, অন্য দলকে পুরোপুরি পোর্টফোলিও ডায়েটে রাখা হয়। এক মাস পরে দেখা যায়, যাঁরা পোর্টফোলিও ডায়েট মেনে চলেছিলেন, তাঁদের রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল প্রায় ২৯ শতাংশ কমে গিয়েছে। আর অন্য দলের ফলাফল মাত্র ৮ শতাংশ। তবে এই ট্রায়াল সীমিত পরিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল। অত জনপ্রিয়তা পায়নি সে সময়ে।
২০২৩ সালে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আন্দ্রে গ্লেন পোর্টফোলিও ডায়েট নিয়ে আরও বড় আকারে গবেষণা শুরু করেন। প্রায় ২ লক্ষ ১০ হাজার নার্স ও স্বাস্থ্য আধিকারিককে নিয়ে পরীক্ষা চালান। সে ক্ষেত্রেও দেখা যায়, যাঁরা নিয়ম মেনে পোর্টফোলিও ডায়েট শুরু করছেন, তাঁদের হার্টের অসুখ হওয়ার ঝুঁকি ১৪ শতাংশ কমে গিয়েছে। তবে গ্লেন এ-ও জানান, পোর্টফোলিও ডায়েট করলেই যে হৃদ্রোগ হবে না, তেমনটা নয়। যদি কেউ খাওয়াদাওয়া নিয়ম মেনে করেন, তা হলে সেই ভয়টা অনেক কমে যাবে। অন্তত বহু জনের ক্ষেত্রে তেমনই দেখা গিয়েছে। গ্লেনের গবেষণার পর থেকে ফের নতুন করে চর্চায় চলে এসেছে কোলেস্টেরল কমানোর এই ডায়েট।
পোর্টফোলিও ডায়েট কি মেনে চলা সম্ভব?
৫০ গ্রামের মতো উদ্ভিজ্জ প্রোটিন খেতে হবে সারা দিনে। ৪৫ গ্রামের মতো বাদাম ও বীজ খেতে হবে। তবে ওজন মেপে খাওয়া তো সম্ভব নয়। তাই সারা দিনের রুটিনে কতটা বাদাম খাবেন, কতটা সব্জি তা ঠিক করে নিতে হবে নিজের শরীরের ওজন ও শারীরিক অবস্থা বিচার করেই। যেমন, অ্যাভোকাডোর জায়গায় যদি কেউ সেদ্ধ বা ভাপানো ব্রোকলি এক কাপের মতো খান, তাতেও কাজ হবে। আলুর বদলে রাঙা আলু খাওয়া যেতে পারে। সাদা ভাতের বদলে আধ কাপের মতো ব্রাউন রাইস, সঙ্গে সেদ্ধ সব্জি খেলেও ভিসকস ফাইবার বা ফাইটোস্টেরলের চাহিদা পূরণ হবে। সঙ্গে নানা রকম ফলও খেতে হবে। যে দেশে যেমন ফল ও সব্জি পাওয়া যায়, সেই অনুযায়ী ডায়েটে সামান্য অদলবদল করাই যায়। অ্যাভোকাডো অয়েলের জায়গায় অলিভ অয়েলেই রান্না চলতে পারে। এখন স্বাস্থ্যের জন্য অনেকেই অলিভ অয়েলে সঁতে করা রান্না খান। কাজেই অক্ষরে অক্ষরে ডেভিডের ডায়েট না মানলেও, সেই ধাঁচের ডায়েট মেনে চলা অসম্ভব নয় বলেই মনে করছেন গবেষকেরা।