Advertisement
E-Paper

‘ধর্ষক’ এসআইয়ের শরণাপন্ন হন আত্মঘাতী চিকিৎসকের বাড়িওয়ালা? ধৃত পুত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে আঙুল তরুণীর দিকেই

মহারাষ্ট্রের সাতারায় একটি সরকারি হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হন এমবিবিএস পাশ করা এক ঝকঝকে তরুণী। চুক্তিভিত্তিক চাকরি করতে করতে তিনি এমডি-র প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল সব। কী ঘটেছিল?

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:০৩
Maharashtra Woman Doctor Death

হোটেলের ঘর থেকে উদ্ধার চিকিৎসকের হাতের তালুতে মেলে সুইসাইড নোট। তাই দেখে গ্রেফতার করা হয়েছে এসআই এবং ইঞ্জিনিয়ারকে। —ফাইল চিত্র।

হোটেল থেকে মহিলা চিকিৎসকের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার এবং তাঁর হাতের তালুতে লেখা দু’জনের নাম ঘিরে গত দু’দিন ধরে মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মহল তোলপাড়। মৃত চিকিৎসক কাজ করতেন সরকারি হাসপাতালে। হাতের তালুতে যে দু’জনকে নিজের পরিণতির জন্য তিনি দায়ী করেছেন, তাঁদের এক জন আবার পুলিশকর্মী। তাই শোরগোল তীব্র হয়। ইতিমধ্যে দুই অভিযুক্তকেই গ্রেফতার করেছে মহারাষ্ট্র পুলিশ। অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের ভিত্তিতে উঠে আসছে নানা তথ্য। ২৬ বছরের ‘ধর্ষিতা’ চিকিৎসকের আত্মহত্যা মামলায় এ পর্যন্ত কী কী জানা গেল?

মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার ফলটনের একটি সরকারি হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হন ২৬ বছরের এমবিবিএস পাশ করা এক ঝকঝকে তরুণী। চুক্তিভিত্তিক ওই চাকরি করতে করতে তিনি এমডি (ডক্টর অফ মেডিসিন)-র প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বীড জেলার বাসিন্দা ওই চিকিৎসক কাজের সূত্রে সাতারা জেলায় বাড়িভাড়া করে থাকতেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার চিকিৎসকের ঝুলন্ত দেহ মেলে সাতারার একটি হোটেলে। ভাড়াবাড়িতে কেন ছিলেন না তিনি? উঠছে প্রশ্ন।

বাড়িওয়ালার পুত্রের সঙ্গে প্রেম?

ভাড়াবাড়ির মালিকের পুত্র, পেশায় সফ্‌টঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের বিরুদ্ধে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করেছিলেন আত্মঘাতী চিকিৎসক। ঠিক কী কারণে তাঁকে মানসিক নির্যাতন করতেন অভিযুক্ত, তা স্পষ্ট নয়। তবে শুক্রবার ছেলের গ্রেফতারির পর পরিবারের দাবি, তরুণী চিকিৎসকের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার ‘ফল’ ভুগতে হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারকে।

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছিল, শনিবার সাতারা থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূর থেকে পাকড়াও করা হয়েছে সফ্‌টঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে। আপাতত চার দিনের পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন অভিযুক্ত। কিন্তু রবিবার ধৃতের পরিবার দাবি করেছে, কোথাও পালিয়ে যেতে চাননি ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বাড়িতেই ছিলেন। তদন্তে সহযোগিতা করার জন্যই আত্মসমর্পণ করেছেন। বোনের দাবি, দাদার সঙ্গে ভাড়াটে তরুণীর ঘনিষ্ঠতা ছিল। এবং সেটা চিকিৎসকের জোরাজুরিতেই। তাঁর দাবি, ভাড়াটে হলেও চিকিৎসককে বাড়ির মেয়ের মতোই দেখতেন তাঁর বাবা-মা। তিনিও ভালবাসতেন। কিন্তু সপ্তাহ কয়েক হল ওই সম্পর্কে চিড় ধরে। পরে খানিক মিটমাটও হয়ে গিয়েছিল। বাড়িওয়ালার মেয়ের কথায়, ‘‘দাদার ডেঙ্গি ধরা পড়ার পরে ওর দেখভাল করেছিল ডাক্তার দিদি। সব কিছু তখন ঠিকঠাক ছিল। এমনকি, মৃত্যুর আগের দিনও দাদাকে কয়েক বার ফোন করেছিল ও। সেই সমস্ত প্রমাণ আমরা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।’’

ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ের প্রস্তাব চিকিৎসকের?

হাতের তালুতে যাঁর বিরুদ্ধে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করে গিয়েছেন, তাঁকেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন সাতারার মহিলা চিকিৎসক। ধৃত ইঞ্জিনিয়ারের পরিবারের দাবি এমনটাই। পুলিশের এক আধিকারিকও জানিয়েছেন, মৃতা চিকিৎসক এবং ধৃত ইঞ্জিনিয়ারের হোয়াট্‌সঅ্যাপ চ্যাট থেকে স্পষ্ট যে, তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল। ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে ভাড়া থাকার সুবাদে চিকিৎসকের সঙ্গে তাঁর ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি দু’বার তাঁদের মন কষাকষি হয়। গত জানুয়ারি মাসে দেড়শো বার তাঁরা এক অপরকে ফোন করেন। জানা যাচ্ছে, ঠিক ওই সময়েই অপর অভিযুক্ত, বরখাস্ত এবং ধৃত এসআই এই দু’জনের মধ্যে এসে পড়েন। কী ভাবে?

‘ধর্ষক’ এবং ‘ধর্ষিতা’ প্রতিবেশী

যে এসআইয়ের বিরুদ্ধে শেষ পাঁচ মাসে চার বার ধর্ষণের কথা হাতের তালুতে লিখে আত্মঘাতী হয়েছেন মহিলা চিকিৎসক, আদতে তাঁরা প্রতিবেশী। জানা যাচ্ছে, বীড জেলায় একই এলাকায় তাঁদের বাড়ি। পুলিশকর্মীটি বর্ধিষ্ণু পরিবারের। অন্য দিকে, চিকিৎসকের বাবা পেশায় কৃষক। কাকা শিক্ষক। কাকা জানিয়েছেন, ভাইঝিকে এমবিবিএস পড়াতে প্রচুর টাকা দেনা করেছেন দাদা। এখনও লাখ তিনেক টাকা ঋণ রয়েছে তাঁদের। তবে ভাইঝি চাকরির পাশাপাশি এমডি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এতেই তাঁরা আশ্বস্ত এবং খুশি ছিলেন।

এসআই-র সাহায্য চান ইঞ্জিনিয়ার?

ইঞ্জিনিয়ার পুত্রের সঙ্গে ভাড়াটে তথা চিকিৎসকের ‘সম্পর্ক’ এবং ‘মন কষাকষি’তে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন বাড়িমালিক। জানা যাচ্ছে, তিনিই প্রথম ওই এসআই-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে সাহায্য চান। কী রকম সাহায্য? বাড়িমালিকের কন্যার কথায়, ‘‘ওই ডাক্তার আমার দাদাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আমার দাদা রাজি হয়নি। ওই ডাক্তারকে নিয়ে ওর মনে এমন কোনও অনুভূতি ছিল না। ও জানিয়েছিল, ডাক্তারকে বোনের চোখে দেখে।’’ তরুণীর দাবি, আত্মহত্যার আগে চিকিৎসক নিজের হাতের তালুতে তাঁর দাদার নাম লিখেছেন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার রাগ এবং অভিমানে। পাশাপাশি তাঁর দাবি, গত কয়েক দিন ধরে তাঁরা দাদাকে মানসিক অশান্তির মধ্যে রেখেছিলেন চিকিৎসক। তরুণীর প্রশ্ন, ‘‘আমার দাদা যদি ওকে মানসিক হেনস্থা করে থাকে, তা হলে ‘দিওয়ালি’-র সময় কী ভাবে বাড়ির লোকের সঙ্গে এত আনন্দ করল ওই ডাক্তার?’’ ধৃত ইঞ্জিনিয়ারের ভাই তথা বাড়িওয়ালার কনিষ্ঠ পুত্রের দাবি, ‘‘দাদা আমাকে বলেছিল, ডাক্তার দিদি ওকে ভয় দেখাচ্ছে আত্মহত্যা করবে বলে।’’

পাঁচ মাসে চার বার ধর্ষণের অভিযোগ

ফলটন সিটি পুলিশ থানার এসআই-র নাম হাতের তালুতে লিখে আত্মহত্যা করেছেন চিকিৎসক। অভিযোগ করেছেন, পাঁচ মাসে তাঁকে চার বার ধর্ষণ করেছেন ওই পুলিশকর্মী। সেই পুলিশকর্মী শনিবার সন্ধ্যায় গ্রেফতার হয়েছেন। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ধৃত পুলিশকর্মী মৃতা চিকিৎসকের গ্রামের বাড়ি একই পাড়ায়। তাঁরা পূর্ব পরিচিত। কিন্তু চলতি বছরেই ওই এসআই-সহ আরও তিন জনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছিলেন চিকিৎসক। অভিযোগের প্রেক্ষিতে কি তদন্ত হয়েছিল? জবাব মেলেনি।

মৃত্যুর আগে অভিযোগ

আত্মহত্যার আগেও এসআই-সহ কয়েক জন পুলিশ আধিকারিকের বিরুদ্ধে মানসিক চাপ সৃষ্টি করা, হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করেছিলেন মহিলা চিকিৎসক। পুলিশ সূত্রেই সে কথা জানা গিয়েছে। মেডিক্যাল অফিসারের দাবি ছিল, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বিকৃত করা, ভুয়ো ফিট সার্টিফিকেট ইত্যাদি তৈরি করে দেওয়ার জন্য পুলিশের একাংশ তাঁর উপর জোর খাটাতেন। কিন্তু ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত হয়েছে, এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি। পাল্টা পুলিশের তরফে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়। সেই অভিযোগের তদন্তের জন্য দুই সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। তখন চার পাতার একটি অভিযোগপত্র লিখেছিলেন চিকিৎসক। তাতে এক সাংসদের আপ্তসহায়কের নাম করে একটি অভিযোগের কথা বলেন। আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে জানান, সাংসদের দুই প্রতিনিধি হাসপাতালে ঢুকে তাঁকে ধমকের সুরে বলেছিলেন, সাংসদ তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন। কেন পুলিশের কথামতো ডাক্তারি শংসাপত্র দেওয়া হচ্ছে না, এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয় তাঁকে। তিনি যখন এ নিয়ে পুলিশে লিখিত অভিযোগ করেন, তখন ওই এসআই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকে তাঁকে শাসানি দিয়ে গিয়েছিলেন।

পুলিশের পাল্টা অভিযোগ

পুলিশের নাম জড়ানো নিয়ে পাল্টা তারা দাবি করেছে, সরকারি কাজে অসহযোগিতা করতেন ওই মহিলা চিকিৎসক। ‘ফিট সার্টিফিকেট’ দিতে টালবাহানা করতেন। সাতারা জেলার এক পদস্থ পুলিশ আধিকারিক জানান, রাতে কোনও গ্রেফতারির ঘটনা ঘটলে ধৃতকে মেডিক্যাল পরীক্ষা করতে অনিচ্ছাপ্রকাশ করতেন ওই চিকিৎসক। নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া প্রায়শই ধৃতেরা ‘ফিট’ নন বলে জানিয়ে দিতেন। যার ফলে পুলিশ হাসপাতালে নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করতে বাধ্য হয়। পুলিশ ওই চিকিৎসককে বলেছিল, এই সমস্ত কাজের জন্য ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা পরিষেবা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাধ্য। কিন্তু তার পরেও উনি অসহযোগিতা করেছেন। বাধ্য হয়ে তাঁরা স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই মহিলা চিকিৎসকের বদলি চান। সাতারার সিভিল সার্জন যুবরাজ কার্পে বলেন, ‘‘ওই চিকিৎসককে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে মেডিক্যাল অফিসারদের সর্বদা উপস্থিত থাকতে হবে।’’

চিকিৎসককে সাবধান

মহিলা চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সাতারা সিভিল সার্জনের কাছে পুলিশের অভিযোগ জমা পড়ার পর, বিষয়টি তদন্তের জন্য দুই সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ২০২৫ সালের অগস্টে কমিটির কাছে চার পৃষ্ঠার বিস্তারিত লিখিত বিবৃতিতে পুলিশের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ পুনর্ব্যক্ত করেন চিকিৎসক। তিনি অভিযোগ করেন, পুলিশের বিরুদ্ধে হুমকি ও হয়রানির কথা সাতারা জেলার মেডিক্যাল সুপারিন্টেনডেন্ট অংশুমান ধুমাল-সহ সিনিয়র চিকিৎসকদের জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা এই সমস্ত কথায় গুরুত্বই দেননি। আত্মঘাতী চিকিৎসক লিখেছিলেন, তাঁর ‘বীড সংযোগের কারণে’ (এসআই এবং তিনি একই জায়গার বাসিন্দা বলে) তাঁকে বার বার লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। তাঁর ‘কিছু হলে’ সে জন্য পুলিশ দায়ী থাকবে। যদিও এখন চিকিৎসক ধুমাল ওই অভিযোগের কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি কেবল বিষয়টি তদন্ত কমিটির সামনে তুলে ধরেছিলাম। পরে রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্দেশাবলি চিকিৎসকে জানিয়েছিলাম।’’

Crime Maharashtra Police Maharashtra doctor death
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy