Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Congress

রাহুলের বিকল্প হিসেবে নয়া সূত্র কংগ্রেসের, কার্যকরী সভাপতি পদ তৈরির ভাবনা, দৌড়ে এগিয়ে ৪

এই রণকৌশলের পরিকল্পনা হতেই নাম নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-গুঞ্জন। কার্যকরী সভাপতির পদে কাকে বসানো হবে, তা নিয়ে যেমন চর্চা চলছে, তেমনই দলের অন্দরমহলে শুরু হয়েছে তদ্বির-তৎপরতা।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

সংবাদ সংস্থা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৯ ১৪:৫৯
Share: Save:

ইস্তফার সিদ্ধান্তে অনড় রাহুল গাঁধী, এটা বোঝার পরই এ বার নতুন ফর্মুলা প্রয়োগের পথে কংগ্রেস। কী সেই সূত্র? দলের শীর্ষনেতৃত্ব সূত্রে খবর, ‘ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট’ অর্থাৎ ‘কার্যকরী সভাপতি’ হিসেবে নতুন কাউকে দায়িত্ব দিয়ে রাহুলের চাপ কিছুটা হালকা করা হতে পারে। তাতে অনেকটা সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। অর্থাৎ রাহুলকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া হবে না, আবার তিনি বৃহত্তর প্রেক্ষিতে কাজও করতে পারবেন। কার্যকরী সভাপতি দলের দৈনন্দিন কাজকর্ম সামলাবেন। অন্য দিকে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে মনোযোগ দিতে পারবেন রাহুল।

লোকসভা ভোটে দলের ভরাডুবি এবং বিজেপির বিপুল সাফল্যের পর ২৫ মে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির (সিডব্লিউসি) বৈঠকেই পদত্যাগপত্র জমা দেন রাহুল। কিন্তু সেই ইস্তফা গ্রহণ করেনি সিডব্লিউসি। তার পর থেকে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে অনেক। কিন্তু রাহুল অনড়। ইস্তফার সিদ্ধান্ত থেকে সরতে রাজি নন রাহুল। তাই কংগ্রেসের ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ নয়া এই সূত্র বের করেছে বলে দলীয় সূত্রে খবর।

আর নয়া এই রণকৌশলের পরিকল্পনা হতেই নাম নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-গুঞ্জন। কার্যকরী সভাপতির পদে কাকে বসানো হবে, তা নিয়ে যেমন চর্চা চলছে, তেমনই দলের অন্দরমহলে শুরু হয়েছে তদ্বির-তৎপরতা। যে নামগুলি নিয়ে আলোচনা চলছে, শুরু হয়েছে তাঁদের দক্ষতা, সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। রয়েছে একাধিক সমীকরণও। নেহরু-গাঁধী পরিবারের বাইরের কাউকে এই পদে বসানো হলেও, পুরোপুরি ওই পরিবার মুক্ত হওয়া যে কার্যত অসম্ভব, সেটাও মেনে নিচ্ছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।

আরও পড়ুন: ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা, বিজেপির মিছিল ঘিরে ধুন্ধুমার, জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ

আরও পড়ুন: অচলাবস্থা এখনও কাটল না, রাজ্য জুড়ে চলছে চিকিত্সা সঙ্কট, চরম হয়রানি রোগীদের

কংগ্রেসের কার্যকরী সভাপতির দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন সচিন পায়লট। প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা রাজেশ পায়লটের ছেলে ৪১ বছরের সচিন বয়সে তরুণ। আবার সচিনের রাজনৈতিক দক্ষতা পরীক্ষিত। ২০১৩ সালে তাঁকে যখন কংগ্রেসের পুনর্গঠনে রাজস্থানে পাঠানো হয়েছিল, তিনি একনিষ্ঠ ভাবে সেই কাজ করেছেন। ২০১৮ সালে মুখ্যমন্ত্রীর পদের অন্যতম দাবিদারও ছিলেন তিনি। সচিন কংগ্রেসকে রাজস্থান উপহার দিলেও তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়নি। পরিবর্তে সেই চেয়ারে বসানো হয়েছে বর্ষীয়ান নেতা অশোক গহলৌতকে। আবার সচিন পায়লট রাহুলের ঘনিষ্ঠ এবং তরুণ ব্রিগেডের অন্যতম মুখ। আবার গহলৌতকে মুখ্যমন্ত্রী করার সময়ই রাহুল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী না করা হলেও সচিনকে আরও বড় দায়িত্ব দেওয়া হবে অর্থাৎ, এর পুরস্কার পাবেন। সেই প্রতিশ্রুতি এ বার পূরণ হতে পারে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক শিবিরের একটা বড় অংশ।

সচিন পায়লটের ক্ষেত্রে শুধু একটিই প্রতিবন্ধকতা। তিনি রবার স্ট্যাম্প নন। অর্থাৎ চোখ-কান বন্ধ করে গাঁধী পরিবারের সিদ্ধান্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন, এমনটা তিনি নন। বরং সিদ্ধান্তকে নিজের বিচার-বুদ্ধি ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে বিচার করার চেষ্টা করেন। গাঁধী পরিবারের ক্ষেত্রে যেটা মেনে নেওয়া কঠিন বলেই মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষরা।

কংগ্রেসের কার্যকরী সভাপতির দৌড়ে এগিয়ে সচিন পায়লট। —ফাইল চিত্র

লোকসভা ভোটে নিজের ছেলে বৈভবের টিকিট নিয়ে আবদার-জোরাজুরি এবং ভোটে বৈভবের হার নিয়ে রাহুল গাঁধী তীব্র উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন অশোক গহলৌতের উপর। কিন্তু কার্যকরী সভাপতির দৌড়ে এখন উঠে আসছে সেই গহলৌতের নামই। আদ্যপান্ত ‘পার্টি ম্যান’ গহলৌত রাজনীতিতে অভিজ্ঞ এবং প্রবীণ। ভাল সংগঠক। তাঁর সেই দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারে কংগ্রেস। তিনি আবার দলের নেতা আহমেদ পটেলের ঘনিষ্ঠ। আর পটেল যে সনিয়া গাঁধীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকেন সব সময়, সেটা সর্বজনবিদিত। গহলৌতের পাল্লা ভারী এখানেই। আবার পঞ্জাবে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহ, মধ্যপ্রদেশে কমল নাথ, মহারাষ্ট্রে অশোক চহ্বণের মতো নেতাদের সঙ্গে খুবই ভাল সম্পর্ক গহলৌতের। সেটাও তাঁর প্লাস পয়েন্ট।

রাজনৈতিক দিক থেকেও এর ফায়দাও রয়েছে কংগ্রেসের। গহলৌতকে মুখ্যমন্ত্রী করার পর থেকেই রাজস্থানে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেড়েছে। সচিন পায়লটপন্থীরা গহলৌতের বিরুদ্ধে সরব। ফলে গহলৌতকে দিল্লি আনলে কার্যত এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। রাজস্থানের অসন্তোষ সামলানো যাবে, অথচ গহলৌতেরও অসন্তুষ্ট হওয়ার কিছু থাকবে না। সে ক্ষেত্রে সচিন পায়লটকে মুখ্যমন্ত্রী করার সম্ভাবনাও রয়েছে।

তবে গহলৌতকে নিয়ে কংগ্রেসের সমস্যা একটাই। এ বারের লোকসভা ভোটে রাজস্থানে কংগ্রেস ভোটে লড়েছে তাঁর নেতৃত্বেই। কিন্তু সেখানে ২৫ আসনের একটিতেও জয় আসেনি। ফলে এক জন ‘ফেল’ করা নেতাকেই পুরস্কার দিলে দলের মধ্যেই ক্ষোভ মাথাচাড়া দিতে পারে। সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না পর্যবেক্ষকদের একাংশ।

কার্যকরী সভাপতির অন্যতম দাবিদার রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত। —ফাইল চিত্র

জল্পনায় তৃতীয় নাম জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। রাজস্থানের মতোই সঙ্কট তৈরি হয়েছিল মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের সময়ও। তখন জ্যোতিরাদিত্যকেও সচিনের মতোই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাহুল। ফলে তাঁর নামও বিবেচনায় রয়েছে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের। প্রয়াত কংগ্রেস নেতা মাধবরাও সিন্ধিয়ার ছেলে জ্যোতিরাদিত্য অবশ্য সচিন পায়লটের মতো অতটা স্বাধীনচেতা নন, বরং স্বকীয়তার কথা না ভেবে শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেই তিনি অভ্যস্ত। আবার রাজনৈতিক দিক থেকেও জ্যোতিরাদিত্য ততটা ওজনদার নন। ফলে এই দুই গুণই গাঁধী পরিবারের জন্য স্বস্তির বিষয় হতে পারে। আর ভাগ্য খুলতে পারে জ্যোতিরাদিত্যর।

তবে সমস্যাও রয়েছে। মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেসে বরাবরই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রবল। জ্যোতিরাদিত্য, কমল নাথ এবং দিগ্বিজয় সিংহদের মধ্যে ক্ষমতার শীর্ষে থাকার ‘ঠান্ডা-যুদ্ধ’ বরাবরই রয়েছে। ফলে জ্যোতিরাদিত্যকে কার্যকরী সভাপতির পদে বসালে সেই কোন্দল আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে— সেই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে নেতৃত্বকে। তার উপর সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের গড় গুণা কেন্দ্রে থেকে জ্যোতিরাদিত্য নিজেই হেরে গিয়েছেন। সেটা তাঁর ক্ষেত্রে মাইনাস পয়েন্ট হতে পারে।

জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার নামও আলোচনায় রয়েছে কংগ্রেসের কার্যকরী সভাপতি হিসেবে। —ফাইল চিত্র

কংগ্রেস সূত্রে খবর, রাহুল গাঁধী ইস্তফা দেওয়ার সময়ই বলেছিলেন, তাঁর নাম তো বটেই, গাঁধী পরিবারের কাউকেই যেন কংগ্রেস সভাপতির পদে ভাবা না হয়। এমনকি, প্রিয়ঙ্কা গাঁধীর নাম উল্লেখ করেই তিনি বিষয়টি নির্দিষ্ট করে দেন। কিন্তু তার পরও দলের শীর্ষনেতৃত্বের ভাবনায় উঠে এসেছে প্রিয়ঙ্কার নাম। রাহুলের নিজের ক্ষেত্রে না হলেও প্রিয়ঙ্কাকে কার্যকরী সভাপতি পদে বসানোর ক্ষেত্রে তাঁকে রাজি করাতে পারেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। জন্ম থেকেই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠায় রাজনীতি প্রিয়ঙ্কার মজ্জাগত। তিনি সাধারণ মানুষ এবং নিচু তলার কর্মীদের সঙ্গে তাঁর রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ। নিজেও সাধারণের মধ্যে মিশে কাজ করতে পারেন। বয়সে নবীন, ফলে অনেক সময় পাবেন। তার উপর চেহারায় রয়েছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর আদল। সবচেয়ে বড় সুবিধা, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু গাঁধী পরিবারের মধ্যেই থাকবে।

এই সব প্লাস পয়েন্ট থাকলেও প্রিয়ঙ্কাকে নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, তিনি নিজে রাজি হবেন তো? দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা হলেও সদ্যসমাপ্ত লোকসভা ভোটে সবেমাত্র সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন। বছর ঘোরার আগেই এত বড় দায়িত্ব নিতে তিনি রাজি হবেন কি না, সেটা নিয়েই চিন্তিত কংগ্রেস হাই কমান্ড। দ্বিতীয় প্রশ্ন, পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ নিয়ে কংগ্রেসকে বরাবর আক্রমণ করে বিজেপি। প্রিয়ঙ্কাকে ফের পদে বসালে সেই আক্রমণের ধার আরও বাড়ার আশঙ্কা। তৃতীয়ত, প্রিয়ঙ্কার স্বামী রবার্ট বঢরার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তদন্ত করছে ইডি। ফলে প্রিয়ঙ্কাকে দায়িত্বে আনলে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে কাজে লাগিয়ে সেই তদন্ত আরও জোরদার করতে পারে বিজেপি। প্রিয়ঙ্কা কি তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবেন? সেটা নিয়েও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ সন্দেহ প্রকাশ করছেন।

জল্পনা চলছে প্রিয়ঙ্কা গাঁধীর নাম নিয়েও। —ফাইল চিত্র

সব মিলিয়ে দলের অভ্যন্তরে চলছে কাটাছেঁড়া। কোন দিকে কার পাল্লা ভারী, কাকে পদে বসালে রাজনৈতিক সুবিধা বেশি এবং খারাপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম, তাঁকেই নির্ধারণ করা হবে বলে দলের শীর্ষ সূত্রে খবর। তবে যাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হোক, এই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দলকে শক্ত ভিতের উপর তিনি দাঁড় করাতে পারবেন কি সেটা নিয়েই সবচেয়ে বেশি চিন্তিত দলের ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’।

রাজনীতি, অর্থনীতি, ক্রাইম - দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE