কলকাতায় বাঙালি খাবারের পাশাপাশি নানা এলাকার খাবার নিজের মতো করে জায়গা করে নেয়। কলকাতার চিনা খাবার হোক, বা মোগলাই— সবেরই নিজস্ব পরিচিতি আছে। বিভিন্ন প্রদেশের লোকেরা কৌতুক করে বলেন, ‘বঙ্গাল ডুবা হ্যায় খানে পে’। ২০২৫ ছিল কোরিয়ান আর জাপানি খাবারের বছর। এই দুই দশের খাবার বেশ কিছু দিন হল মন জয় করেছে কলকাতাবাসীর। তবে ২০২৫ ছিল কোরিয়া ও জাপানের জনপ্রিয় খাবারকে নিজের পাড়ার খাবার করে নেওয়ার। এক সময়ে যে ভাবে মোড়ে মোড়ে চিনা চাউমিন, মোগলাই রোল এবং পরবর্তী কালে নেপাল-তিব্বতের মোমোর দোকান তৈরি হয়, এ বছরটা ছিল তেমনই কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় কোরিয়ান খাবারের স্টল তৈরির সময়। তার সঙ্গে আর কী কী বদল এল এ বছর, আনন্দবাজার ডট কম তা দেখতে ঘুরে বেড়াল কলকাতা শহরের বিভিন্ন প্রান্ত।
পাড়ায় পাড়ায় র্যামেন ঝড়
কোরিয়া এখন জেন জ়ি বাঙালির প্রাণের বড় কাছের। সে দেশের সিনেমা, গান, পপ ব্যান্ড এবং তারকাদের নিয়ে মাতোয়ারা শহরের তরুণ প্রজন্ম। এই মুগ্ধতা এতটাই বেড়েছে যে, ফ্যাশন থেকে শুরু করে রূপচর্চা সবেতেই কোরিয়াকে অনুসরণ করছেন মানুষ। খাওয়াদাওয়াতেও চোখে পড়েছে কোরিয়ার প্রতি অগাধ ভালবাসা। নিউ টাউনের রাস্তার ধারে ফুড ট্রাক হোক কিংবা নিউ মার্কেটের রাস্তার ধারের ছোট ঠেক— শহরে এখন কোরিয়ান খাবার খুঁজতে খুব বেশি সময় লাগবে না। এ বছর ব্যাঙের ছাতার মতো অলিগলিতে খুলেছে কোরিয়ান খাবারের ফুড জয়েন্ট। জাপচে, কিমচি চিকেন, মুনেও ডিওপবাপ, নিওপচিওক মান্ডু, গিমবাপ, কোরিয়ান র্যামেন, কর্নডগ থেকে বুবা ড্রিঙ্ক— এখন আর কলকাতার নামীদামি রেস্তরাঁতেই নয়, ছোট ছোট দোকানেও পাওয়া যাচ্ছে। অবস্থা এমনই যে, এ পাড়ার র্যামেন ভাল, না কি ও পাড়ার কর্নডগ— সেই নিয়েও অল্পবয়সিদের মধ্যে বাধছে ঠান্ডা লড়াই। কোরিয়ান স্ট্রিট, ইয়াম ইয়াম কোরিয়ান বাকেট, অজুম্মাস কিমবাপ, মিস এন প্লেস, টাও বাও, বেন্তো— এ বছর শহর জুড়ে ফুলেছে নানা কোরিয়ান খাবারের নানা ছোটবড় দোকান। যেখানে হয়তো বড় রেস্তরাঁগুলির মতো ঝাঁ-চকচকে পরিবেশ পাবেন না, তবে কোরিয়ান খাবারের খাঁটি স্বাদ নিশ্চয়ই পাবেন। কোরিয়ান বার্বিকিউ, কোরিয়ান হটপটের সঙ্গেও পরিচয় হচ্ছে বাঙালির। কোরিয়ার বিংসু আইসক্রিম এখন পাওয়া যাচ্ছে কলকাতার রাস্তার ধারের একটি ছোট্ট আইসক্রিম পার্লার আইস-ও-বেরিতে। রোল-চাউমিন, মোমো, কাটলেটের বাইরে এখন কলকাতার স্ট্রিট ফুডে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে কোরিয়ান খাবার। ২০২৫-এর ট্রেন্ড অন্তত সেই কথাই বলছে।
মাচা নিয়ে মাতামাতি
২০২৫ সালে দেশের আর পাঁচটা শহরের মতো কলকাতাবাসীও ডুবেছে মাচার প্রেমে। শৌখিনীরা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ক্যাফেতে গেলে এখন আর চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি নয়, জাপানি চা মাচা অর্ডার করছেন। কেবল চা নয়, কফি থেকে তিরামিসু, পেস্ট্রি থেকে মিল্কশেক— মাচা এখন সর্বত্র। চা খাওয়ার ভক্ত কোনও কালেই ছিলেন না যাঁরা, তাঁদের মধ্যেও জাপানি চা নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই। সল্টলেকের পিঙ্ক সুগারস্ ক্যাফেতে পাবেন ব্লুবেরি ব্লু মাচা থেকে ভ্যানিলা ব্লু মাচা, পার্ক সার্কাসের এইটথ ডে ক্যাফেতে গেলে পাবেন মাচা আইসড লাটে, মাচা ক্যাপুচিনো আবার ক্যাফে ইভাব্রিউতে পাবেন মাচা লেমোনেড, মাচা টনিক। মাচার স্বাদের কেক খেতে চাইলে বারিস্তা কফিতে পেয়ে যাবেন হেজ়ালনাট মাচা টি কেক, ২৫ মেন স্ট্রিটের মেনুতে পেয়ে যাবেন মাচা মুজ় কেক। এমনকি, সাবেকি ফ্লুরিজ়ের মেনুতেও নতুন সংযোজন মাচা লাতে। মাচা এক ধরনের গ্রিন টি। গ্রিন টি-র পাতা গুঁড়ো করে এই চা তৈরি করা হয়। এতে থাকে ভরপুর মাত্রায় অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট। কোভিডকালে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য ভারতীয় মধ্যে জনপ্রিয়তা পায় এই চা।
রসনায় দর কমেছে পদ্মার ইলিশের
শুধু যে জাপান-কোরিয়া ঢুকেছে পাড়ায়, তা নয়। কিছু জিনিস বেরিয়েও গিয়েছে। যেমন সাধারণত পদ্মার ইলিশের জন্য মুখিয়ে থাকত কলকাতার বাঙালি। চিংড়ি নিয়ে সারা বছর মাতামাতি করলেও, বর্ষায় বাংলাদেশের ইলিশ না পেলে ঠিক জমত না। তবে এ বছরও পদ্মার ইলিশে টান পড়েছে। ২০১২ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের রফতানি কার্যত বন্ধ করেছে বাংলাদেশ। যদিও গত কয়েক বছর ধরে ‘পুজো উপহার’ হিসাবে কিছু মাছ আসছিল, এ বছরে তা-ও বিশেষ দেখা যায়নি। ফলে বাংলাদেশ থেকে এ বছর মাত্র ১,২০০ টন ইলিশ রফতানি হয়েছে ভারতে। গত বছরের তুলনায় সেই পরিমাণ প্রায় অর্ধেক। জোগান কম, তাই দাম আকাশছোঁয়া। পুজোর সময়ে গড়িয়াহাটের বাজারে ২৪০০-২৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে পদ্মার ইলিশ! দাম শুনে এ পারের বাঙালি স্রেফ একটাই কথা বলেছে, মাথায় থাকুক পদ্মার ইলিশ! ইলিশ চিরকালই একটু কুলীন গোত্রীয় মাছ। পয়সা পকেটে না থাকলে ইলিশ ওই বছরে দু’-চার বারের বেশি খাওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ পুজো-পার্বন, পয়লা বৈশাখে বা বর্ষার বিশেষ কোনও দিন ছাড়া ইলিশ মধ্যবিত্ত বাঙালির পাতে সে রকম ভাবে জায়গা পায় না। তাই অধরা পদ্মার ইলিশের বদলে এ বছর গঙ্গার পাশাপাশি গুজরাত আর মায়ানমারের ইলিশ দিয়েই মন ভরিয়েছে কলকাতার বাঙালি। বড় বড় রেস্তরাঁর ‘ইলিশ উৎসব’ হোক কিংবা বাড়িতে দুপুরের ভোজ, ইলিশ ভাপা, ইলিশ পাতুরি, ইলিশের ট্যালটেলে ঝোল কিংবা ইলিশের মাথার টক—বাঙালির রসনা মিটেছে দেশি ইলিশেই।
সব খাবারে স্বাস্থ্যের ‘টুইস্ট’
বাঙালি এখন অল্প হলেও স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবছে। অনেকেই জিমের মেম্বারশিপ কেবল পুজো অবধি সীমিত রাখেননি, বছরভর শরীরচর্চায় মন দিয়েছেন। শরীরচর্চা তো হল, তবে খাওয়াদাওয়া? সকালের রুটি, লুচি, পরোটা তরকারির বদলে এখন ওট্স, মুসলি, হোলউইট ব্রেড দিয়েই প্রাতরাশ সারা হচ্ছে অনেক বাড়িতে। কয়েক বছর ধরেই এ বদল চোখে পড়েছে। তবে এ বছর শহরের বিভিন্ন রেস্তরাঁ এবং ফুড অ্যাপগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বাঙালির স্বাস্থ্যসচেতনতার কথা। শহরের বড় বড় রেস্তরাঁর মেনুকার্ডে দামের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে ক্যালরি কাউন্ট। এখন মেনুকার্ডে দাম দেখে নয়, ক্যালোরি দেখে খাবার অর্ডার করছে বাঙালি। খাবার সরবরাহকারী বিভিন্ন অ্যাপেও যোগ করা হয়েছে ‘হেলদি মোড’। অ্যাপে গিয়ে ওই মোডটি অন করলেই স্বাস্থ্যকর খাবারের তালিকা হাজির হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। সেখানে আবার চাইলে কত ক্যালোরির মধ্যে খেতে চাইছেন, সেটিও উল্লেখ করা যাবে। স্যুপ, স্যালাড, স্যান্ডউইচের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর পিৎজ়া, পাস্তা, রোল, সিজ়লার, কবাবের রকমারি সম্ভার চোখে পড়বে সেই তালিকায়। কচিপাতা দ্য ফার্ম ক্যাফে, কিটো ক্যাফে, ইয়ালো স্ট্র, ফালাম ক্যাফে, উইফিট, ক্যালোরি ক্রেভ— শহর জুড়ে স্বাস্থ্যকর রেস্তরাঁ কিংবা ক্যাফের সংখ্যা বেশ বেড়েছে এই বছরে। সেই সব ক্যাফে-রেস্তরাঁর মেনুতে নজর কাড়ছে অ্যাভোক্যাডো টোস্ট, সুপার ফুড অমলেট, ব্লুবেরি আমন্ড বাটার টোস্ট, কিনুয়া অ্যান্ড নাট স্যালাড, চিটো এগলিশিয়াস স্যালাড, চিকপি অ্যান্ড সটেড ভেজিটেবিল স্যালাডের মতো স্বাস্থ্যকর বাহারি সব খাবারদাবার। চড়া দামে সেগুলি কিনে খাচ্ছেন বাঙালি। চপ, কাটলেট, মোমো, ফিশফ্রাই, বিরিয়ানিকে পুরোপুরি ছাড়তে না পারলেও বাঙালি হাই প্রোটিন, লো-কার্ব, লো-ক্যালোরি এবং সহজপাচ্য খাবারের দিকে ঝুঁকছে ভাল মতোই। প্রেমিকাকে নিয়ে ডেটে যাওয়া হোক কিংবা পরিবারের সঙ্গে ভোজ— স্বাস্থ্যকর খাবার পাওয়া যায় এমন ক্যাফে, রেস্তরাঁগুলিকেই এখন বেছে নিচ্ছেন অনেক বাঙালি। কেউ ভালবেসেই খাচ্ছেন, কারও ক্ষেত্রে আবার চিকিৎসকের চোখরাঙানি একটা বড় কারণ।
ভিগানদের নজরে কলকাতা
মাছে-ভাতে বাঙালির তকমা এ বার খানিকটা হলেও বদলে গিয়েছে! এ বছর দেশের শ্রেষ্ঠ ভিগান খাবারের শহরের শিরোপা পেয়েছে কলকাতা। ভিগান খাবার মানে হল, যা কিছু প্রাণিজ, তার সবই বাদ। দেশের নানা প্রদেশেই নিরামিষ খাবারের চল আছে, কিন্তু সব জায়গায় এত শাকসব্জি পাওয়া যায় না। বাঙালি রান্নায় শাকসব্জির বহুল ব্যবহার। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নিরামিষ খাবারে পনির, ছানা, দুধ, ঘি, মাখন ব্যবহারের চল বেশি। সে সবই হল প্রাণিজ জিনিস। অথচ বাঙালি হেঁশেলে শাকপাতা, তরকারি আর নামমাত্র ফোড়ন দিয়ে এমন সুস্বাদু সব পদ বানানো হয়, যার স্বাদ ভোলার নয়। নানা ধরনের সব্জির খোসা বাটা থেকে পোস্তর বড়া, সজনেশাক ভাজা থেকে মোচা-নারকেলের চপ, খিচুড়ি, আমসত্ত্ব খেজুরের চাটনি— বাঙালি হেঁশেলে দুধ, ঘি, ছানা ছাড়াও অসংখ্য নিরামিষ পদ তৈরি হয়। এখন বহু লোকেই ভিগান হচ্ছেন। সচেতনতা বাড়ছে। ফলে মাছ-ভাতের বাইরে বাঙালি রান্নার যে একটা বড় জগৎ আছে, তার পরিচিতি নতুন করে ছড়িয়েছে কলকাতা শহর ও তার বাইরে। ক্যাফেগুলির মেনুতে চোখে পড়ছে ভিগান খাবারের আলাদা মেনু। তাতে থাকছে বহু বাঙালি খাবার। ২০২৫ সালে শহরে নিরামিষ রেস্তরাঁর সংখ্যা বেশ বেড়েছে। তাদের মেনুতে আলাদা করে ঠাঁই পাচ্ছে ভিগান পদ। ফ্যাব ক্যাফে বাই ফ্যাবইন্ডিয়া, দ্য ডেলি ক্যাফে, বার্মা বার্মা, ক্যাফে ভ্যালেনটিনো, দ্য ফ্লেমিং বোল, ওয়াবি সাবি, উবুন্তু ইটের মতো একাধিক রেস্তরাঁয় আপনি চাইলেই পেয়ে যাবেন ভিগান খাবার।