সিনেমা নির্মাণ কিছুতেই কবিতা রচনা, ছবি আঁকা বা ভাস্কর্য তৈরির মতো ‘নির্জন এককের’ শিল্প নয়। কার্যত সিনেমা একটি মিশ্র শিল্পমাধ্যম, যেখানে নির্মাতা বা পরিচালককে বিবিধ পেশার মানুষের উপরে নির্ভর করতে হয়। আজকের এই ডিজিটাল যুগেও হাতে ক্যামেরা থাকলেই সিনেমা বানানো যায়— এমন কহাবত চলিত থাকলেও বিষয়টা যে আদপে তা নয়, তা যাঁরা এই কাজে ব্যাপৃত হয়েছে, তাঁরা সকলেই জানেন। তবু, ফিল্ম জগতে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি’ নামের একটি অভিধা ঘুরপাক খায়। বিশেষ করে চলচ্চিত্র উৎসবের আঙিনায় ‘ইন্ডি’ ছবির জন্য রক্ষিত থাকে বিশেষ বিভাগ, সে সব ছবি গণমাধ্যমে আলোচনাবৃত্তে উঠেও আসে। সুতরাং ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ বা সংক্ষেপে ‘ইন্ডি’ ছবির যে একটা (বা একাধিক) আলাদা বলয় রয়েছে, সে কথা মেনে নিতে হয়।
কাকে বলা যায় ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ ছবি? ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিনে গিয়ে খোঁজ করলেই এমন একটা সংজ্ঞা উঠে আসে— যা মূলধারার চলচ্চিত্র জগতে নিয়োজিত পুঁজির বাইরে স্বল্প বাজেটে স্বকীয় ভাবনায় ভিন্ন ধারার আখ্যান পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্মিত হয়, তা-ই ‘ইন্ডি’ সিনেমা। ভারতের মতো দেশে, যেখানে চলচ্চিত্রের ভাগ্যবিধাতা বলিউড, সেখানে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণ ঠিক কতখানি স্বাধীন— এ প্রশ্ন থেকেই যায়। বলিউড এবং সর্বভারতীয় আঙিনা থেকে সরে এসে যদি পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকানো যায়, তা হলে দেখা যাবে, ‘ইন্ডি’ ছবির সংখ্যা বাংলাতেও কম নয়। টলিউডের পরিকাঠামোর বাইরে সিনেমা নির্মাণ এখানে বাংলাদেশের মতো অতখানি সংহত না হতে পারে অথবা দক্ষিণ ভারতীয় ছবির জগতের মত একটা সমান্তরাল ধারা তৈরি করে ফেলতে না পারে, তবু বাংলা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি নির্মিত হয় এবং হয়ে চলে।
আরও পড়ুন:
বাংলা ছবির প্রেক্ষিতে দেখলে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি কি কোনও স্বতন্ত্র ধারার কথা বলে? স্বতন্ত্র চিত্রভাষ? সত্তরের দশকে বলিউডে যেমন ‘মধ্যধারা’র ছবি নির্মাণে গিয়ে এসেছিলেন বহু প্রতিভাবানই। তাঁদের পকেটে বড় বাজেট ছিল না। বিরাট তারকারা তাঁদের ছবিতে সে অর্থে মুখ দেখাননি। শুধুমাত্র আখ্যানবিন্যাসকে পুঁজি করেই নির্মিত হয় ‘মধ্যধারা’র ছবি। এবং এক সময়ে সেই ছবির আখ্যানবিন্যাসই বলিউডের বৃহৎ পুঁজির অভিমুখ বদল করে। বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ বলিউডে ‘মধ্যধারা’ বলে আলাদা কিছুর অস্তিত্বই নেই। এক সময়ে যে সব পরিচালক বড় বাজেটকে এড়িয়ে নতুন ব্যাকরণের ছবি তুলতে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই আজ নেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তাঁদের দেখানো পথেই বলিউডের ‘বড়’ পুঁজির একাংশ আজ আবর্তিত হচ্ছে। ছোট শহরের মধ্যবিত্ত জীবন, অপেক্ষাকৃত গ্ল্যামারহীন অভিনেতা, ‘হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়’— এমন বাস্তবতা কিন্তু আজকের বলিউডের এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। সমান্তরালে যদি বাংলার দিকে তাকানো যায়, ‘ইন্ডাস্ট্রি’ কিন্তু সে অর্থে কোনও ‘মধ্যধারা’কে লালন করেনি। ইন্ডাস্ট্রির বাইরে থেকে ছবি করার কথা তথাকথিত স্বর্ণযুগে কেউ তেমন একটা ভাবেননি। রাজেন তরফদার বা পার্থপ্রতিম চৌধুরীরা ‘ইন্ডাস্ট্রি’র ব্যাকরণ বদলাতে পারেননি। তাঁদের কাজ বাংলা ছবির মহাফেজখানায় ‘ব্যতিক্রমী’ তকমা লাগানো এক ধূসর আলমারিতে তোলা রয়েছে। আশির দশক পর্যন্ত বাংলা ছবি ‘ইন্ডাস্ট্রি’র বাইরে বেরোয়নি। সম্ভবত নব্বইয়ের দশকেও নয়। তার পরে নতুন সহস্রাব্দের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং সেই প্রযুক্তির ক্রমশই সহজলভ্য হয়ে ওঠা থেকে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ ছবি নির্মাণের ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন বা ঋত্বিক ঘটক (বিশেষ করে শেষোক্ত জন) যে অভিধায় ‘স্বাধীন’, মিলেনিয়াম-পরবর্তী ইন্ডিপেন্ডেন্ট চলচ্চিত্র-কর্তারা সেই অভিধার সঙ্গে মাপসই হবেন না। প্রযুক্তি এবং তার লভ্যতা এসে ‘স্বাধীনতা’র অর্থ বদলে দিয়েছে।
সত্যজিৎ একদা চলচ্চিত্র সমালোচকদের কারবারে রুষ্ট হয়েই খানিক এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন যে, কারও পকেটে পাঁচসিকে পয়সা আর হাতে তিন ঘণ্টা সময় থাকলেই তিনি একটা ছবি দেখে ফেলতে পারেন। কিন্তু তা নিয়ে যা খুশি বলার অধিকার কি তাঁর জন্মায়? বিষয়টা কিছুটা যেন জীবনানন্দ দাসের ‘সমারূঢ়’ কবিতার “বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা”-র খুব কাছ দিয়ে যায়। কিন্তু পকেটে পাঁচসিকে আর হাতে তিন ঘণ্টা সময়ের অবস্থান বদল ঘটল বর্তমান শতকের প্রথম দশক পার হতে হতে। মোবাইল ফোনেও যে সিনেমা তোলা সম্ভব তাকে মান্যতা দিলেন জঁ-লুক গোদারের মতো পরিচালক। বিশ্বজোড়া অগণিত সিনেমা পরিচালনেচ্ছুকেরা ‘স্বাধীনতা’র এক নতুন সংজ্ঞা হাতে পেলেন। তেমন মোবাইলে কুটুম-কাটুম করে একটা ছবি একলাই বানিয়ে নেওয়া যায়— এমন একটা বাণী যেন ঘোরাফেরা করতে লাগল পরিচালনাভিলাষীদের মধ্যে। শুধু তা-ই নয়, গত দেড় দশক হল ইন্টালন্যাশনাল মোবাইল ফোন ফিল্ম ফেস্টিভাল-ও চালু হয়ে গিয়েছে। সুতরাং ‘ইন্ডি’ পরিচালনার যে এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ঘটে গিয়েছে, তা বোঝা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ‘ইন্ডি’ ছবির যে সম্ভাবনাময় দিকগুলি উন্মোচিত হল, এ বাংলায় তেমনটা দেখা গেল কি? মোবাইলের কথা তোলা থাক। বেশ কিছু যুবক-যুবতী খানিক ঘরের খেয়ে এবং বনের মোষ তাড়িয়েই অদম্য জেদ নিয়ে ‘ইন্ডাস্ট্রি’র বাইরে ছবি করলেন, করে চললেন। সেই সব ছবির যে প্রাতিষ্ঠানিক ‘মুক্তি’ ঘটল, এমনও নয়। ফেস্টিভাল সার্কিটে কিছু ছবি দর্শক তথা বিচারকদের সম্ভ্রম আদায় করল, টুকটাক পুরস্কারও পেল। কিন্তু বাংলা ছবির যে বৃহৎ বাংলাবাজার, সেখানে এই সব ছবি এবং এই সব পরিচলকের ‘স্বাধীনতা’ কতখানি আদৃত হল, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এবং আরও একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে, ঠিক কতখানি ‘স্বাধীন’ এই ইন্ডিপেন্ডেন্ট পরিচালকেরা?
নিজেকে কি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পরিচালক বলবেন? প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ‘দোস্তজী’ ছবির পরিচালক প্রসূন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। প্রসূন প্রথমেই জানালেন, তিনি নিজেকে আদৌ ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ বলবেন না। কারণ তাঁর মতে, পরিচালক তখনই ‘স্বাধীন’, যখন তিনি নিজে হাতে চিত্রগ্রহণ, শব্দ সংযোজন, সম্পাদন— সবটাই করছেন। কিন্তু সেটা বাস্তবে সম্ভবই নয়। সর্বোপরি, সিনেমার মতো একটা শিল্প , যেখানে পুঁজি একটা বড় ব্যাপার, সেখানে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ শব্দটা নিয়েই তাঁর আপত্তি রয়েছে। তাঁর কথায়, “কম টাকায় ক্রাউড ফান্ডিংয়ে ছবি করাকেই ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ বলতে রাজি নই। ছবি পরিবেশনার দায়িত্ব কে নেবে?”
এক অমল বন্ধুত্বের পাশাপাশি রাষ্ট্রিক দুঃসময়ের কথা বলেছিল 'দোস্তজী'। ছবি: সংগৃহীত।
প্রসূনের সুরে সুর মেলালেন ‘মানিকবাবুর মেঘ’ ছবির পরিছালক অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ইন্ডপেন্ডেন্ট সিনেমা কার্যত ‘সোনার পাথরবাটি’। বিশেষ করে ভারতের মতো আর্থ-সামাজিক অবস্থার দেশে তো বটেই। আর্থিক জায়গা থেকেই ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স’ সম্ভব নয়। সেটা ইউরোপ বা আমেরিকায় সম্ভব হলেও হতে পারে, ভারতে কদাপি নয়। তবে একই সঙ্গে এ কথাও বললেন যে, “যদি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স’ মানে স্বাধীন মত প্রকাশ হয়, তা হলে সেই স্বাধীনতার অর্থ রয়েছে। কিন্তু বাংলায় তেমন কিছু করা বেশ কঠিন।” কেন কঠিন, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অভিনন্দন জানালেন, তাঁর একান্ত ইচ্ছে একটা ভৌতিক ছবি বানানোর। কিন্তু ‘মানিকবাবুর মেঘ’ থেকে তাঁকে ‘সামাজিক ভাবে দায়বদ্ধ’-সুলভ একটা তকমার ঘেরাটোপে আটকে দেওয়ার চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। ওই দাগিয়ে দেওয়া বা ঘেরাটোপের বাইরে বেরোনোর স্বাধীনতা তাঁর কাছে একান্ত জরুরি। আবার তাঁর মতে, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি মানেই তা এ দেশে ‘ফেস্টিভাল সার্কিট’-এর ছবি। ফেস্টিভালগুলির আবার নিজস্ব মাপকাঠি রয়েছে, ‘চাহিদা’ রয়েছে। সেই মাপকাঠি বা চাহিদা পূরণ করার চাপও তথাকথিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট পরিচালকের উপরে থাকে। বিদেশে যেমন ফেলোশিপ-নির্ভর ছবি-করিয়েদের পরিসর রয়েছে, এ দেশে তেমন নেই। ফলে ছবি করার আগে বহু কিছু মাথায় রেখেই এগোতে হয়।
মানুষ ও এক মেঘের সম্পর্কের গল্প, 'মানিকবাবুর মেঘ'-এ নজর কেড়েছিল আখ্যানের নতুনত্ব। ছবি: সংগৃহীত।
‘ঝিল্লি’ ছবির পরিচালক ঈশান ঘোষ আবার মনে করালেন পরিবেশনার কথা। তাঁর মতে ২০-৩০-৪০ বছর আগে ফেস্টিভালে কম সংখ্যক ছবি দেখানো হত। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবির একটা স্বতন্ত্র পরিসর ছিল। কিন্তু ডিজিটাল যুগে ছবির সংখ্যা বেশি। সেই অনুপাতে দর্শকের সংখ্যা নয়। ফলে থিয়েটারে ছবি রিলিজ করার প্রসঙ্গ এসেই যায়। দক্ষিণ ভারতে যেটা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু বাংলায় হয়নি। ঈশান মনে করিয়ে দিলেন, বাংলায় সিঙ্গল স্ক্রিন প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। তিনি বললেন, “‘ঝিল্লি’র পরের ছবি ‘মরীচিকা’। সেখানে আমি পরিচিত অভিনেতাদের নিয়েই কাজ করেছি। ফলে তাকে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ বলা যায় কি?” ঈশানের মতে, ছবি তৈরির প্রণালীটা ‘স্বাধীন’ হলেও হতে পারে, কিন্তু ‘সাপোর্ট সিস্টেম’টা কি ততখানি স্বাধীন? ঈশানও মনে করেন ফেস্টিভাল ছবি প্রদর্শনের কোনও আদর্শ জায়গা হতে পারে না। সেখানে একটা বিশেষ চিত্রভাষাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। সেই রকম চিত্রভাষা সম্পন্ন ছবি বাংলার হলে রিলিজ করলে মানুষ ‘কমিউনিকেট’ করতে পারবেন কি না সন্দেহ। তবে ঈশান নিজে ছবি তৈরির প্রক্রিয়ার অনেকটাই নিজে হাতে করেন। এতে তাঁর মতে ব্যয় কমে। তাঁর কথায়, “ইন্ডিপেন্ডেন্ট হতে গেলে ছবি তৈরির ক্রাফটটা শেখা একান্ত প্রয়োজন।”
সমাজের উপান্তের মানুষের টিকে থাকা আর সদাপরিবর্তনশীল বিশ্ব নিয়ে কথা বলেছিল 'ঝিল্লি'। ছবি: সংগৃহীত।
‘বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান’— এই মুহূর্তে একটা জনপ্রিয় বাক্যবন্ধ। আর এ নিয়ে ঠাট্টা-তামাসাও কম হয় না সমাজমাধ্যমে। কিন্তু ‘বাংলা ছবি’ মানে কোন ছবি? পুঁজি শাসিত (যত কমই হোক না কেন) পরিসরে প্রযোজকের মর্জিকেও প্রাধান্য দিতে হয়। আবার তেমন করতে গিয়ে পরিচালক ‘কম্প্রোমাইজ়’-এর পথে হাঁটেন। অন্য দিকে, আপস করব না— বলে যাঁরা নিজ হাতে নিজস্ব ভাষায় ছবি করছেন, তাঁদের মাথায় জগদ্দল হয়ে বিরাজ করে ছবি পরিবেশন থেকে শুরু করে তার ‘ভিউয়ারশিপ’ পর্যন্ত হাজারটা ভাবনা। সেই সব টপকে বাংলা ছবি কতখানি ‘স্বাধীন’, তার হিসেব কষা এই মুহূর্তে কঠিন। তবু কিঞ্চিৎ আশার আলো জাগান প্রসূন, অভিনন্দন বা ঈশানের মতো পরিচালকেরা। ‘ইন্ডাস্ট্রি’র জাঁতাকলে না পড়ে তাঁরা তাঁদের প্রথম ছবি নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছেন। ছবি নন্দিত হয়েছে। পরবর্তী ছবির প্রযোজকও হয়তো পাচ্ছেন। তখন অবশ্য তাঁদের গায়ে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ তকমাটি থাকবে না। কিন্তু নিজস্ব চিত্রভাষার সঙ্গে আপস না করে পথচলাই তাঁদের লক্ষ্য। এই ‘স্বাধীনতা’টুকুও বড় কম নয়। এটুকুকে পাথেয় করেই কোন পথে হাঁটেন তাঁরা, সেটা দেখার ইচ্ছে রয়ে যায়।