ব্যস্ততা জীবন থেকে অনেক কিছুই কেড়ে নিতে পারে। আবার তারই ফাঁকে নিজের জন্য সময় বার করাটাও প্রয়োজনীয়। অনির্বাণ ভট্টাচার্যের জীবনে ব্যস্ততার সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেই মানুষটিই ছুটির দিনে বাড়িতে জানলায় নতুন পর্দা টাঙাতে পছন্দ করেন। ইদানীং বাগান করায় মন দিয়েছেন। জানলে কেউ কেউ অবাক হতেই পারেন। কিন্তু অনির্বাণ এ রকমই। সম্প্রতি, পেশা এবং ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি সমাজজীবন নিয়েও তাঁর ভাবনা ভাগ করে নিলেন অভিনেতা।
আরও পড়ুন:
কেমন আছেন অনির্বাণ? প্রশ্ন করায় উত্তর এল, ‘‘ভাল-খারাপ মিশিয়েই জীবন। সেটা মেনেও নিয়েছি। তাই আমি ভালই আছি।’’ অনির্বাণ নিজে কাজে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন। তাই তিনি জীবনে ‘চাপ’কে বিশেষ পাত্তা দিতে নারাজ। তাঁর সহজ যুক্তি, জীবনে চাহিদা বাড়লে চাপও তৈরি হবে। অনির্বাণের কথায়, ‘‘এখন তো আমরা প্রত্যেকেই চাহিদার চেন সিস্টেমের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। আগেকার প্রজন্মে মানুষের চাহিদা কম ছিল, তাই চাপও কম ছিল।’’
জীবনের চলার পথে প্রতিযোগিতা বা চাহিদা থেকে মনের উপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে। অনির্বাণের সহজ দর্শন— তার জন্য ‘কান্নাকাটি’ করে কোনও লাভ হয় না। বললেন, ‘‘চাপ থেকে আমি মুক্তি পাব, এই ভাবনার মধ্যেই একটা ফাঁকি লুকিয়ে রয়েছে। আসলে, আমি চাপ নিয়েছি বলেই তো তার সুবিধাও ভোগ করছি!’’
সাফল্য এবং ব্যর্থতার সঙ্গেই কখনও কখনও মনে অবসাদ বাসা বাঁধতে পারে। অনির্বাণও তার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু তার জন্য পিছু হটতে নারাজ অভিনেতা। বললেন, ‘‘অবসাদ আমার চালিকাশক্তি। আমি তা থেকে পালাই না। তাই অবসাদ আমাকে কখনও বাড়িতে বসিয়ে রাখতে পারেনি।’’

ছবি: সংগৃহীত।
একটা সময় ছিল, যখন শিল্পীর সঙ্গে অবসাদকে জুড়ে দেওয়ার প্রবণতাকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে দেখা হত। অনির্বাণের যুক্তি, ‘‘জীবনানন্দ দাশ বা তুষার রায়ের যদি অবসাদ হয়ে থাকে, এখন সেটা সকলেরই হচ্ছে।’’ অনির্বাণের মতে, পৃথিবী যত ‘নতুন’ হচ্ছে, সেখানে অবসাদও আরও বেশি করে জাঁকিয়ে বসছে। তাঁর কথায়, ‘‘এক সময়ে বসন্ত রোগে মানুষ মারা যেত। এখন সেটা সেরে যায়। কোনও দিন হয়তো অবসাদও সেরে যাবে। পজ়িটিভ থাকতেই হবে।’’
কথাপ্রসঙ্গেই অনির্বাণ জানালেন, প্রয়োজনে এক বার মনোবিদের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অভিনেতা বললেন, ‘‘গিয়ে কোনও লাভ হয়নি। কারণ, বুঝতে পেরেছিলাম, আমি যে কাজ করে ভাল থাকি, তার মাধ্যমেই আমাকে ভাল থাকতে হবে। আমার কাজটাই আমার ওষুধ। তাই বলা যায়, নিজেই নিজের থেরাপি করেছি।’’ তবে, নিজেকে কেউ সাহায্য না করতে পারলে, তাঁর যে অবিলম্বে মনোবিদের সাহায্য নেওয়া উচিত, সে কথাও জোর গলায় মনে করিয়ে দিতে চাইলেন অভিনেতা। বললেন, ‘‘মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এক সময়ে সমাজে যে ছুতমার্গ ছিল, সেটা কিন্তু শহরে এখন অনেকটাই কেটেছে। আমি চাইব, জেলা এবং মফস্সলেও যেন কুণ্ঠাবোধ দ্রুত কেটে যায়।’’

‘পক্ষীরাজের ডিম’ ছবির একটি দৃশ্যে (বাঁ দিক থেকে) মহাব্রত, অনির্বাণ এবং অনুমেঘা। ছবি: সংগৃহীত।
চলতি মাসেই মুক্তি পাবে সৌকর্য ঘোষাল পরিচালিত ‘পক্ষীরাজের ডিম’ ছবিটি। ছোটদের জন্য তৈরি এই ছবিতে অনির্বাণ অভিনয় করেছেন একজন শিক্ষকের ভূমিকায়। ছোটদের জন্য তৈরি ছবির সংখ্যা সময়ের সঙ্গে কমেছে। নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে অনির্বাণের ব্যাখ্যা অন্য রকম। বললেন, ‘‘ছোটদের নিয়ে কাজ তো বড়রাই করেন। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ থেকে ‘হ্যারি পটার’— অজস্র উদাহরণ রয়েছে। বড়রা এখন নিজেদের নিয়ে বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। খুব আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছেন। তাই ছোটদের নিয়ে আলাদা করে ভাবার সময়ও তাঁদের নেই।’’
অবশ্য, ছোটদের জন্য ভাবনার চিন্তাস্রোতে মাঝেমাঝে যে ধাক্কা আসে, সে কথাও স্বীকার করে নিলেন অনির্বাণ। উদাহরণস্বরূপ বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাম্প্রতিক ব্রিটিশ ওয়েব সিরিজ় ‘অ্যাডোলেসেন্স’কে স্মরণ করালেন তিনি। অনির্বাণের কথায়, ‘‘একটা ধাক্কা এলে তখন সকলে নড়েচড়ে বসেন। তার পরেও বিষয় থেকে দূরে গিয়ে সিরিজ়টির শট টেকিং (সিরিজ়ের প্রতিটি পর্ব সিঙ্গল টেকে শুট করা হয়েছে) মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়!’’

ছবি: সংগৃহীত।
অনির্বাণ নিজে টলিপাড়ার প্রথম সারির অভিনেতা। ছোটদের সঙ্গে তাঁর সখ্যও রয়েছে। এক সময়ে মঞ্চে ছোটদের সঙ্গে বেশ কিছু কাজও করেছিলেন তিনি। কিন্তু ‘তারকা’ হিসেবে ছোটদের ছবিতে কাজের ক্ষেত্রে তাঁর মনের মধ্যে আলাদা কোনও ভাবনা কাজ করে না বলেই উল্লেখ করলেন তিনি। অনির্বাণের কথায়, ‘‘আমি তাদের সহকর্মী হিসেবেই ট্রিট করি। কারণ, ফ্লোরে আমাদের একই রকম কাজ করতে হবে— অভিনয়। সেখানে বড় বা ছোট হয় না।’’ এই ছবিতে দুই কিশোরের চরিত্রে অভিনয় করেছে মহাব্রত বসু এবং অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’জনের সঙ্গেই আলাদা করে নিজস্ব সমীকরণ তৈরি হয়েছে বলে স্বীকার করলেন অনির্বাণ। ফলে ভবিষ্যতে ছোটদের জন্য এবং ছোটদের নিয়েই কোনও কাজের উদ্যোগও নেবেন বলেই জানালেন তিনি।
আরও পড়ুন:
প্রযুক্তির ‘কল্যাণে’ ছোটদের নানাবিধ সমস্যা থেকে অপরাধ পর্যন্ত বিষয়ে অনির্বাণ অবহিত। বরং তাঁর মতে, ভারতের মতো দেশে প্রযুক্তির ‘কল্যাণে’ শিশুদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার হার অনেক বেশি। তাই মেদিনীপুরে তাঁর শৈশবকালের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের বেড়ে ওঠার মধ্যেও পার্থক্য আলাদা করে অভিনেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তবে ভাল-খারাপের মিশেলেই তাকে নিতে চাইছেন অনির্বাণ। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক এই ছবির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্তমান সময়ে শ্রদ্ধাশীল সেই সম্পর্কেও যে বদল এসেছে, তা অনির্বাণকে হতাশ করে। ‘‘আমি যে স্যরেদের ক্লাস করেছি, এই ছবিতে সেই ধরনের শিক্ষক এবং ছাত্রদের কথা বলা হয়েছে’’, একই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন অভিনেতা।
তবে ছোট বা বড় নয়, বর্তমান সময়ে সমাজমাধ্যমকে ‘ভার্চুয়াল জেনোসাইড’ হিসেবেই উল্লেখ করলেন অনির্বাণ। বললেন, ‘‘আমি নিজে সমাজমাধ্যম ব্যবহার করি না। কিন্তু তার পরেও যে সব তথ্য ফোনে চলে আসছে, সেটাই একজনকে ভাল না থাকতে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট!’’ অনির্বাণ মনে করেন, যাঁরা তথাকথিত সমাজমাধ্যমের স্রষ্টা, তাঁদের কাছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাল থাকার গুরুত্ব কমেছে। অনির্বাণের কথায়, ‘‘তাঁরা এক একটি দেশের সরকারকে পোষেন! তাঁদের কাছে বাচ্চা বা বড়, কোনও একজন ব্যক্তি তো স্বাভাবিক ভাবেই গুরুত্বহীন।’’

ছবি: সংগৃহীত।
কর্মজীবনে ব্যস্ততার ফাঁকে কয়েক দিনের বিরতি বা ভ্রমণ জীবনকে নতুন ভাবে দেখতে শেখাতে পারে। কিন্তু ছোট থেকেই এক অর্থে ঘোরার অভ্যাস তৈরি হয়নি অনির্বাণের। এখন তাঁর ‘ভ্রমণ’ কর্মসূত্রেই। এখনও ছুটির দিনে, বাড়িতেই সময় কাটাতে পছন্দ করেন অভিনেতা। বাড়িতে থাকলে তাঁর দৈনন্দিন চা-কফি পানের হারও বেড়ে যায়। বলছিলেন, ‘‘আমার একটা সাইকেল আছে। এখনও ছুটির দিনে সাইকেল চালিয়ে আশপাশে বেরিয়ে পড়ি।’’
তবে ছুটি থাকলেও কাজ নিয়ে নিরন্তর ভাবনা চলতেই থাকে মনের মধ্যে। অনির্বাণ বলছিলেন, ‘‘নিয়মিত লেখালিখি করি। প্রচুর গান শুনি, সিনেমা দেখি।’’ ফোনে বেশি ক্ষণ কথা বলা বিশেষ একটা পছন্দ করেন না অনির্বাণ। তাই বেশির ভাগ সময়ে অবসর কাটে দেশ-বিদেশের খবরে চোখ রেখে। অনির্বাণের কথায়, ‘‘বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নতুন নতুন বিষয় নিয়ে ইউটিউবে পডকাস্ট দেখে সময় কাটে। তবে মাথা কী ভাবে খালি রাখা যায়, তার জন্য এখন বিভিন্ন ভিডিয়ো দেখছি।’’
ফেলে আসা শৈশব ব্যক্তিকে আকর্ষণ করে। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে স্মৃতিমেদুরতা। ‘পক্ষীরাজের ডিম’-এর কল্যাণে যদি ২০ বছর বয়স কমে যায়, তা হলে অনির্বাণ ভট্টাচার্য নিজেকে কী প্রশ্ন করবেন? মুখে পরিচিত হাসি। ভাবার সময় নিলেন অনির্বাণ। বললেন, ‘‘তার মানে ১৮ বছরের আমি! আগে বলব, ‘কী করতে চাইছিস, ভাল করে ভেবে নে।’ উত্তরে কিশোর আমি ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলা বা সাঁতার কাটার ইচ্ছাপ্রকাশ করব।’’ এরই সঙ্গে অনির্বাণ হেসে যোগ করলেন, ‘‘সিনেমা এবং নাটকে অভিনয়ের কথাও উঠবে। তখনই আমি নিজেকে বলব, বাংলা সিনেমা-নাটক করতে যেয়ো না। কারণ, খুব চাপ আছে!’’