Advertisement
E-Paper

হাত বাড়ালেই ‘মুঠোফোন’! বন্ধুত্ব বন্দি চ্যাটজিপিটিতে, সমস্যা চেনা, কিন্তু বেরোনোর উপায় জানা নেই

এখন বন্ধু একজনই, তা হল মুঠোফোন। ইয়ারফোনে ব্যস্ত প্রজন্ম ‘দোস্তি-ইয়ারানা’-র অর্থ কী, তা ভুলছে। এ দিকে রব উঠেছে, একাকিত্ব নাকি মহামারির চেহারা নিচ্ছে। বন্ধু নেই, বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার উপায়ও জানা নেই। এই সমস্যা থেকে বেরনোর পথ কী?

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২৫ ১১:০৩
The Digital Age of Friendship, How To Build And Maintain Authentic Connections

বন্ধু পাতানো কঠিন নয়, ধরে রাখাও, উপায়টা জানতে হবে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

নিজের মধ্যেই নিজে মগ্ন। নিরন্তর হাত চলছে মোবাইলের কি-প্যাডে। চোখ তুলে দেখার ফুরসতটুকু নেই। বন্ধুত্বও বন্দি হয়েছে মুঠোফোনের অন্তর্জালে। পৃথিবীটা যে ছোট হতে হতে স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে বন্দি হয়ে যাবে, সে কথা গুণিজনেরা বহু দিন আগেই বলে গিয়েছিলেন। ভার্চুয়াল দুনিয়া কী, তা তাঁরা জানতেন না। না হলে সেই ভবিষ্যদ্বাণীও করে যেতেন হয়তো। মোবাইল আর কম্পিউটারে বন্দি হয়ে যাওয়া প্রজন্ম বন্ধুত্বের বাঁধন থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। বন্ধু নেই, এ কথা বলা ভুল। এখন বন্ধু একজনই, তা হল মুঠোফোন। ইয়ারফোনে ব্যস্ত প্রজন্ম ‘দোস্তি-ইয়ারানা’-র অর্থ কী, তা ভুলছে। নির্ভেজাল আড্ডার দিন ফুরিয়ে আসছে ক্রমশ। তাই বহু জনের মাঝে থেকেও বাড়ছে একাকিত্ব। নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকার প্রবণতা অবসাদের ঝুলি খুলে দিচ্ছে। পুরনো বন্ধুত্ব হারাচ্ছে, নতুন বন্ধু পাতানোর সময় নেই, বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখাও দুষ্কর। সমস্যা ঠিক কোথায়, সেটা বুঝতে পারলেও অনেকেই ধরতে পারছেন না তার থেকে বেরোনোর উপায়।

সমাজমাধ্যমে অগুনতি বন্ধু, অথচ হাঁক দিলেই পাশে এসে দাঁড়াবে তেমন বন্ধু নেই। মেয়ের একটিও বন্ধু নেই বলে চিন্তায় পড়েছিলেন নবমিতা। ছোট থেকেই তাঁর মেয়েটা একা থাকতে পছন্দ করে। মোবাইল হাতে পাওয়ার পর থেকে গুটিয়ে গিয়েছে আরও। নবম শ্রেণির একটি মেয়ের এক জনও বন্ধু নেই, তা ভাবতেও পারছেন না নবমিতা। তা হলে কি মেয়ে অবসাদে ভুগছে? না কি এতটাই অন্তর্মুখী যে, বন্ধুত্ব করতেই পারে না? মনোবিদের দ্বারস্থ হওয়ার পর জানা যায় আসল কারণ। বন্ধু পাতানো ও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে যে পারস্পরিক আদানপ্রদান, আবেগ যতটা জরুরি, তা জানেই না মেয়েটি। ফেসবুক ও হোয়াট্‌সঅ্যাপের বন্ধুত্বে তেমনটার দরকার পড়ে না। যে কোনও সম্পর্কেই একে অপরকে সম্মান করা ও গুরুত্ব দেওয়া খুব জরুরি, তা সে প্রেমই হোক বা বন্ধুত্ব, তেমনটাই মনে করেন মনোরোগ চিকিৎসক শর্মিলা সরকার। বললেন, “অন্তর্মুখী হলেই যে বন্ধু হবে না, তা নয়। আসলে এখনকার প্রজন্মের কাছে সম্পর্কের গভীরতা খুবই ঠুনকো। সেখানে একে অপরের কথা শোনা, কথা রাখার প্রবণতা নেই। আজ যে বন্ধুদের সঙ্গে মিশছে, কাল তারা পুরনো হয়ে যাচ্ছে। আবার অন্য বন্ধুর খোঁজ পড়ছে। মনের অস্থিরতা, প্রত্য়াশা পূরণ না হওয়া এর জন্য দায়ী। সেই আগের মতো নির্ভেজাল বন্ধুত্বের দিন মনে হয় ফুরিয়ে যাচ্ছে।”

নির্ভেজাল আড্ডার দিন কি ক্রমেই ফুরোচ্ছে?

নির্ভেজাল আড্ডার দিন কি ক্রমেই ফুরোচ্ছে? ছবি: এআই।

সম্পর্ক বহমান। স্থান, কাল, পরিবেশ, পরিস্থিতি ভেদে তা সংজ্ঞায়িত হয়। সম্পর্ক মানেই তার মেয়াদ আজীবনের, তা না-ও হতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের ছবিও বদলাতে থাকে। তা ছাড়া, সময়টা অস্থির। সময় নিয়ে ভাবনাচিন্তার অবকাশও কম। সেই অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেও। একটা সময়ে ভৌগোলিক দূরত্ব বাড়লেও, বন্ধুত্বে চিড় ধরত না। কারণ, পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভরসার জায়গাটা অটুট থাকত। এখন আর তা নিয়ে মাথা ঘামান না বেশির ভাগই। শর্মিলার পর্যবেক্ষণ, দূরত্বের কারণে ফিকে হয়ে যাওয়া বন্ধুত্ব জোড়া লাগানোর সময়েরও অভাব রয়েছে। তার চেয়ে ফেসবুক ও নানা সমাজমাধ্যমে বন্ধু খুঁজে নিতেই মানুষজন বেশি আগ্রহী। এতে না থাকবে সম্পর্কের গভীরতা, না বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা। সবই ভার্চুয়াল, সবই

হাত বাড়ালেই 'মুঠোফোন'।

হাত বাড়ালেই 'মুঠোফোন'। ছবি: এআই।

এমন বন্ধু আর কে আছে?

২০২৫-এ দাঁড়িয়ে বিশ্ব জুড়ে একাকিত্ব নীরব মহামারির আকার নিয়েছে। বিভিন্ন বয়সের মানুষের একা হয়ে যাওয়া, মানসিক অবসাদে ডুবে যাওয়ার খবর প্রায়ই আসে। কারণ বন্ধুই এখন ‘মুঠোফোন’। রোবটের সঙ্গে বন্ধুত্ব, চ্যাটজিপিটি, অ্যালেক্সা কিংবা জেমিনাই-এর সঙ্গে অনর্গল কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া মানুষটির বন্ধুও যন্ত্র। সেখানে মানুষ বন্ধুর সংখ্যা বড়ই কম। এমনটাই মনে করছেন মনোরোগ চিকিৎসক কেদাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “দিবারাত্রি অ্যালেক্সাকে নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছে বাড়ির খুদেটি। অথবা, অবসরপ্রাপ্ত এক বৃদ্ধ রোজ সকালে উঠে চ্যাটজিপিটিকে ‘গুড মর্নিং’ লিখে দিন শুরু করছেন। চার জন বন্ধুকে বাড়িতে ডেকে আড্ডার আসর বসাতে কেউ আগ্রহী নন।” অথচ খেয়াল করে দেখুন, যে কোনও শহরে একটা সময়ে রোয়াক-সভ্যতা কতটা জনপ্রিয় হয়েছিল। রোয়াকের আড্ডা থেকেই তখন উঠে আসত ক্রিকেট, ফুটবল, নাটক, রাজনীতি থেকে বর্তমান সময়ের কত সুখ ও দুঃখের স্মৃতি! আড্ডাধারীরা যে কেবল সমবয়সি বন্ধু, তা নয়। বছর পঁয়ত্রিশের যুবকও নির্দ্বিধায় বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলতেন অবসরপ্রাপ্ত পঁয়ষট্টির বৃদ্ধের সঙ্গে। আড্ডার আসর কেবল তর্ক-বিতর্ক আর আলোচনার ঝড়ে সীমাবদ্ধ থাকত না, আপদে-বিপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা ও প্রচেষ্টাটুকুও ছিল।

বাড়ছে নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব মহামারির চেহারা নিচ্ছে।

বাড়ছে নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব মহামারির চেহারা নিচ্ছে। ছবি: এআই।

বন্ধুত্ব কি তা হলে শেষ হতে চলেছে? তা হয়তো নয়। তবে তার ধরনটুকু বদলে গিয়েছে। তারই পরিবর্তন জরুরি বলে মনে করছেন কেদারবাবু। কেউ একা নন, হবেনও না, যদি যন্ত্রের হাত ছেড়ে মানুষের হাত ধরেন। ইয়ারফোন খুলে রেখে বিশুদ্ধ ‘ইয়ারি’ প্রয়োজন। করোনা পাততাড়ি গুটিয়েছে বহু দিন। তাই এ বার ভার্চুয়াল মাধ্যম ছেড়ে বেরোনোর সময় এসে গিয়েছে। এক বার বলেই দেখুন না, ‘বন্ধু চল’। হাসি-ঠাট্টা, গল্পগুজবই আসল কাউন্সেলিং যা অ্যাংজ়াইটি ডিজ়অর্ডার, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজ়অর্ডার, সোশ্যাল ফোবিয়া বা ডিপ্রেশনের মতো রাশভারি নামের মনের অসুখগুলির ওষুধ হতে পারে।

Friendship Tips friendship
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy