‘মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো…’ তীব্র কাংস্যনিনাদ আর নেই। মহুয়ায় মৌ আজ বেশ পরিশীলিত স্বরেই বাজে। সৌজন্যে প্রযুক্তি। গাঁক গাঁক করে ওঠা অ্যালুমিনিয়ামের চোঙা আজ লুপ্তপ্রায়। বদলে গলির এ মাথা-ও মাথা বরাব্বর আলোকজিঞ্জিরের কোণে ঘাঁটি মেরে থাকে কাঠের শব্দ-বাক্স। আর সেখান থেকেই নির্গত হয় ‘আধো আলো ছায়াতে’, ‘কেউ জানে না, তুমি যে আমার’, ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ অথবা ‘আর কত রাত একা থাকব’। আশা ভোঁসলে কি জানেন, এই একটা সময় বাঙালি তাঁকে মগডাল থেকে পেড়ে এনে লাগাতার বাজিয়ে চলে? অথবা প্রয়াত রাহুল দেব বর্মন? মাঝেমধ্যে লতা মঙ্গেশকর ও সলিল চৌধুরী? শব্দপ্রক্ষেপণ প্রযুক্তির অভিযোজন ঘটে গেলেও পুজোর আবহসঙ্গীত হিসেবে বেজে চলা গানের কিন্তু নট নড়ন-চড়ন-নট-কিচ্ছু। পুজোর ব্যাকগ্রাউন্ডে যে হিন্দি গান চলে, তেমনও নয়। আশা নীরব হলে কিছু ক্ষণের জন্য কিশোর কুমার চলে। ‘হাওয়া মেঘ সরায়ে’ থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘এ দিন আজি কোন ঘরে গো’ অথবা চাঁদিফাটা দ্বিপ্রহরে ‘সঘন গহন রাত্রি’। কে-ই বা মাথা ঘামায় সঠিক সময়ের! এ তো আর আকাশবাণীর ডিউটি রুম নয় যে, ঘোর বাদলার দিনে ‘বৈশাখ হে মৌনী তাপস’ চালিয়ে স্টুডিয়ো থেকে উপস্থাপক বেরিয়ে এসে ডিউটি অফিসারের ধমক খাবেন। এ এক মুক্ত পরিসর, যেখানে সব ক’টি দিনই গানের দিন, যাবতীয় লগনই গান শোনাবার।
বাঙালির বচ্ছরভর হেদিয়ে বেঁচে থাকার মাঝে পুজোর পাঁচ দিন এক্কেবারে শৈব তাণ্ডব। স্থির, ধীরোদাত্ত জীবনকে এক্কেবারে তছনছ করে দিয়ে যায় শারোৎসব। কিচ্ছু বলার নেই। উৎসব বলে কতা! বচ্ছরকার দিন বলে কথা! ভিড়, ঠাকুর দেখার হেঙ্গাম, এগরোল খেয়ে চোঁয়া ঢেকুর, তাকে চাপা দিতে ভসভসে সোডার জল, প্যান্ডেলের পিছনে হাতছিপ্পু নিপ-বোতল, সবজেপানা কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতলে হালকা তুলির টানের মতো মিশ্রিত ভদকা— এ সব মিশিয়ে যদি নৈবেদ্য হয়ে থাকে, তবে তার উপরের নাড়ুটি হচ্ছে উৎসবোপলক্ষে বেজে চলা গান। আজ অর্ধশতক ধরে দেখা যাচ্ছে একই গান বেজে চলেছে পুজোর পাঁচ দিন। রাহুল দেব বর্মন, আশা ভোঁসলে যেন সেই নাড়ুর নারকেল আর খেজুর গুড়, লতা মঙ্গেশকর আর সলিল চৌধুরী যেন তাতে ছড়ানো মিছরিদানা। ঠিক কী কারণে বছরের পর বছর পুজোর হাল ও হকিকত বদলালেও তার আবহসঙ্গীত বদলায় না? অথচ সত্তরের দশকে সিমলা ব্যায়াম সমিতির প্যান্ডেলে ‘দ্য ভেঞ্চার্স’-এ ‘টাকিলা’ বেজেছে, আনন্দ শংকরের সেতারে ‘জাম্পিং জ্যাক ফ্ল্যাশ’ বেজেছে। শহরতলির পুজোয় ‘দিল দে কে দেখো’ থেকে ‘কাম সেপ্টেম্বর’-এর থিমও বেজেছে। কোন জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় এমন একবগ্গা গানবাজি, কে বলবে?
স্থির, ধীরোদাত্ত জীবনকে এক্কেবারে তছনছ করে দিয়ে যায় শারোৎসব। কিচ্ছু বলার নেই। উৎসব বলে কতা! বচ্ছরকার দিন বলে কথা! ছবি: সংগৃহীত।
গান শুধু স্পিকারে নয়, পুজোর দিনগুলিতে না হলেও বিজয় দশমীর পর থেকে পাড়ায় পাড়ায় বাঁধা মাচায় যে সব শিল্পীরা গাইতে ওঠেন, তাঁদেরও বাঁধা গৎ এই একই গানগুলি। তার সঙ্গে বরং যুক্ত হয় ‘সাত সমুন্দর পার ম্যাঁয় তেরি’ অথবা ‘আপনি তো জ্যায়সে ত্যায়সে’। মাচায় হিন্দি-বাংলার সহাবস্থান ঘটলেও বিষয়টা একই রকম। সময় যেন থেমে আছে দুই কুড়ি বছরের পার। সত্তর কিংবা আশির দশকের পর থেকে এ ভারতভূমিতে কোনও সঙ্গীতই যেন রচিত হয়নি। বছর তিরিশেকের কৃষ্ণেন্দু শ্রীমানি বরহনগরের বাসিন্দা। নেহাতই চায়ের দোকানের আড্ডাতেই বলে উঠলেন, “একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাতে তো জন্ম কাবার হয়ে গেল! তবু আগুন পাওয়া গেল না।” বলাই বাহুল্য তিনি রাহুল দেব বর্মনের সুরে আশা ভোঁসলের গাওয়া ‘একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাও/ তাতে আগুন পাবে’ গানটির দিকেই ইঙ্গিত করছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে জানালেন, জ্ঞান হওয়া ইস্তক তিনি এই এক গান শুনে চলেছেন। কিন্তু কেন এমন হয়— প্রশ্ন করায় কৃষ্ণেন্দু জানালেন, যাঁর বা যাঁদের উপরে প্যান্ডেলে গান বাজানোর ভার থাকে, তিনি বা তাঁরা একগুচ্ছ গান পেনড্রাইভে পুরে সাউন্ড সিস্টেমে গুঁজে দিয়ে চলে যান। আট কিংবা ১৬ জিবি পেনড্রাইভে ধৃত আশাকিশোররাহুলরফিমান্নাহেমন্ত অনন্ত প্রবাহে বাজতে থাকে। ‘দেশলাই কাঠি’র পরেই হয়তো ‘বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা’ তার পরেই ‘সে আমার ছোট বোন’ বা মুহূর্তকাল পরে ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন’। কিন্তু তাতে কোনও মতেই কবীর সুমন নেই, অঞ্জন দত্ত নেই, শিলাজিৎ নেই এমনকি নচিকেতাও নেই। সর্বোপরি বাংলা ব্যান্ডেরও নামগন্ধ নেই। কেন এই অতীতছায়া? কিসের এই অমোঘ আকর্ষণ?
সুরকার প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এই প্রশ্ন রাখা হলে তিনি জানালেন, সাম্প্রতিক সঙ্গীত পুজো প্যান্ডেলে না বাজার ব্যাপারটা অবশ্যই একটা লক্ষণীয় বিষয়। তাঁর মতে, যে সব গান সাধারণত পুজো প্যান্ডেলে বেজে থাকে, তার সিংহভাগই ‘অরগ্যানিক’। অর্থাৎ, সেগুলি এমন এক সময়ের গান, যখন ট্র্যাক রেকর্ডিং ছিল না, যন্ত্রীরা যে যাঁর মতো করে বাজিয়ে চলে যেতে পারতেন না। কোনও এক ফাঁকে গায়ক এসে শুধু গানটুকু গেয়ে স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে যেতে পারতেন না। তার পর ট্র্যাকগুলি মিলিয়ে মিশিয়ে কাটছাঁট করে গান বানানো সম্ভব ছিল না। প্রযুক্তির কল্যাণে গান এখন অনেক বেশি ঝকঝকে, অনেক কম সময়ে ‘তৈরি’ হয়ে যায় বটে। কিন্তু তার মধ্যে ‘অরগ্যানিক’ যুগের স্পর্শের অভাব থেকেই যায়।
সুধীন দাশগুপ্ত কি সলিল চৌধুরী একটা গান বাঁধলে তার মহড়া থেকে শুরু করে রেকর্ডিং পর্যন্ত কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, সাউন্ড রেকর্ডিস্ট একসঙ্গে কাজ করতেন। ফলে তাঁদের মধ্যে একটা বন্ধন বা বন্ডিং তৈরি হত, যা থেকে জন্ম নিত ‘অরগ্যানিক’ গান। সেই গানের শ্রুতির জায়গাটিও ছিল অন্য রকম। সেই ‘অরগ্যানিক’ যুগে শ্রুতি ছিল সামূহিক বা কমিউনিটি লিসনিং। বাড়িতে রেডিয়োয় গান বাজলে পরিবারসুদ্ধ লোক, মায় পাশের বাড়ির লোকও শ্রোতায় পরিণত হতেন। গ্রামোফোনওয়ালা (সে সময় খুব কমই ছিল) বাড়ির কেউ একটা রেকর্ড কিনে আনলে চা-সিগারেট সহযোগে বন্ধুরা সমবেত হয়ে চুপ করে গানই শুনতেন। কিন্তু আজ শ্রুতি বিষয়টিও একান্ত ব্যক্তিগত, মনে করিয়ে দিলেন প্রবুদ্ধ। কানে ইয়ারবাড লাগিয়ে ফেললেই বাইরের জগৎ থেকে ভো-কাট্টা। এমতাবস্থায় সামূহিক শ্রুতিকে ফেরাতেই কি প্যান্ডেলে সেই ‘অরগ্যানিক’ যুগের গানগুলি বাজে?
আরও পড়ুন:
প্রবুদ্ধের আরও যুক্তি, পুজোর দায়িত্বে এখন যে প্রজন্ম, তাঁরা ‘সিনয়র’। জেন জি সেখানে মুখ দেখালেও, কর্তৃত্বের রাশ সেই পক্বকেশ প্রজন্মের হাতেই। তাঁদের স্মৃতিতে সামূহিক শ্রুতি মানেই সেই সব ‘অরগ্যানিক’ গান। তবে প্রবুদ্ধ এ-ও বললেন যে, “এখনকার পুজোয় অন্য গানও বাজে। স্বাগতালক্ষ্মী থেকে শানের মতো সমসাময়িক শিল্পীর রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজে। আর ঐতিহ্যের মুখরক্ষায় সানাই তো বাজেই।”
গান বাজানোর দায়িত্বে যে ‘বড়’রা, সে কথায় সায় দিলেন নতুন প্রজন্মের সঙ্গীতশিল্পী পোর্শিয়া সেন। তাঁর মতে, পুজোর অর্গানাইজাররা প্রায় সবাই মিলেনিয়ামের আগের প্রজন্মের মানুষ। তাঁদের স্মৃতি-তাড়নাতেই বেজে ওঠেন আশা-রাহুল বা ক্বচিৎ লতা-সলিল। পুজোর সময় অনুষ্ঠান করতে গেলেও অনুরোধ আসে সেই সব গানই গাওয়ার। রিমেকের কল্যাণে অনেকেই আদি ও আসল শিল্পীর নাম না জেনেও সেই সব গান শুনতে চান। পোর্শিয়ার মতে, একটা বড় সংখ্যক মানুষ নস্ট্যালজিয়ায় আটকে আছেন। কিন্তু তার পরেও মাঝেমধ্যে প্যান্ডেল থেকে যে ইমন বা লগ্নজিতার কণ্ঠ ভেসে আসে না, এমন নয়। বাঙালির জীবন থেকে ‘পুজোর গান’ হারিয়ে যাওয়া যে শ্রুতির পরম্পরাকে ঘেঁটে দিয়েছে, সে কথা পোর্শিয়া স্বীকার করলেন। প্রবুদ্ধের মতে, যে গানগুলি প্যান্ডেলে বাজে, সেগুলি সময়ের কষ্ঠিপাথরে উত্তীর্ণ। আজকের গান কতটা কালজয়ী হবে, তা জানা আজকেই সম্ভব নয়। সময় বলবে সে কথা। প্রবুদ্ধের কথায়, “মুহূর্তের উত্তেজনায় তাই প্যান্ডেলে ক্ষণিকের জন্য ‘লুঙ্গি ডান্স’ বেজে উঠলেও পরক্ষণেই আবার সেই অরগ্যানিক গানই বেজে ওঠে।”
আরও একটা বিষয়ের দিকে নজর ফেরালেন পোর্শিয়া। সেটা পুজোর ‘থিম মিউজিক’। অনেক পুজোতেই আজ থিম মিউজিক তৈরি হয়। সেগুলি বাজানো হয় সারা ক্ষণ। নেপথ্যে থাকেন আজকের কৃতী সুরকারদের অনেকেই। ‘পুজোর গান’ উধাও হয়ে গেলেও যেন অন্য ফর্মে ফিরে এসেছে। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন, ক’টা পুজোতেই বা থিম মিউজিক তৈরি হয়? সংখ্যায় অল্প হলেও তারা যে রয়েছে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না, পোর্শিয়ার মত।
মণ্ডপে সপরিবার মা দুর্গা। বাংলার ঢাকের বোলের সঙ্গে মিশে গিয়েছে অবাঙালি ‘কুড়কুড়ে’। প্যান্ডেল থেকে সেই স্বরও শ্রুত হয় মাইক মারফত। শ্রুত হয় পুরোহিত মশাইয়ের স্ত্রোত্রোচ্চারণও। কখনও সব কিছু ছাপিয়ে বেজে ওঠেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-বাণী কুমার-পঙ্কজকুমার মল্লিক। পুজোর সাউন্ডস্কেপে এরা সকলেই এক ঝলক হাওয়ার মতো। তার পরে আবার সারা দিন ‘আর কতো রাত একা থাকব’ অথবা ‘ফুল কেন লাল হয়’। এই সব প্রশ্নসূচক গানের উত্তর এত বছরেও কেউ দিতে পারলেন না ভেবে কালাতিপাত করে কোনও লাভ আছে কি? ক্রমশ মাইকে মাইকে টক্কর। আশামান্নাহেমন্তলতাকিশোররাহুল মিলেমিশে জগাখিচুড়ি। এর মধ্যেই শহরতলির নিরালা এক ইস্টিশনে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কোন এক দূর মণ্ডপ থেকে ভেসে এল জগজিৎকণ্ঠ— ‘হোঁঠো সে ছুঁ লো তুম/ মেরা গীত অমর কর দো’। মাইকে বাজা সেই ক্যাকোফনি থেকে যদি একটি কলিও কেউ আলাদা করে তুলে নেন ঠোঁটে, ঠোঁট থেকে ঠোঁটান্তরে ছড়িয়ে সেই গান তো অমর বটেই! ‘কালজয়’ বড় সহজ কাজ নয়। সবাই যে তা পারবে, তারও কোনও মানে নেই। তবু ঠোঁট পাতা থাকে দু’-একটি কলির জন্য, তা ‘বিরহ বড় ভাল লাগে’ হতে পারে, ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ও হতে পারে, কে যে কখন ঠোঁটে তুলে এনে তাকে ‘অমর’ করে তুলছেন, তার খবর মাইক রাখে না, মণ্ডপ রাখে না, প্রতিমাও রাখে না। তাকে মনে রাখে সময় , স্মৃতিভারাতুর সময়।
বাংলার ঢাকের বোলের সঙ্গে মিশে গিয়েছে অবাঙালি ‘কুড়কুড়ে’। প্যান্ডেল থেকে সেই স্বরও শ্রুত হয় মাইক মারফত। শ্রুত হয় পুরোহিত মশাইয়ের স্ত্রোত্রোচ্চারণও। সব মিলিয়ে অন্ন্য ক্যাকোফনি। ছবি: সংগৃহীত।