বিশ্বভারতীতে যোগ কর্মশালা। নিজস্ব চিত্র
একমাস পরেই আন্তর্জাতিক যোগ দিবস। যোগ বিষয়টি পুরনো তবে বর্তমানে নতুনভাবে জায়গা করে নিচ্ছে। রোগমুক্তির উপায় হিসেবে যেমন যোগ প্রাধান্য পাচ্ছে। অন্য দিকে, যোগ নিয়ে পড়ার উৎসাহ বাড়ছে। ভারতীয়দের পাশাপাশি বিদেশিরাও যোগ নিয়ে উৎসাহী। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২০০তম জন্মদিনে পথচলা শুরু করেছিল বিশ্বভারতীর যোগিক আর্ট ও সায়েন্স বিভাগ। তাঁর ২০২তম জন্মদিন এবং বিভাগের জন্মদিন একসঙ্গে উদযাপিত হল বুধবার। শুধু বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, শান্তিনিকেতনে যোগ বিষয়টি বহু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বরাবরই ধ্যান, উপাসনার উপর জোর দিয়ে এসেছেন। ইতিহাস বলছে, তাঁর আমল থেকেই শান্তিনিকেতন গৃহের আশেপাশে সবজায়গায় ধ্যান করার জায়গা ছিল। এর পর ১৯০১ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিচ্ছেন তখনও বিদ্যালয়ের অন্যতম বিষয় ছিল যোগ। সেইসময় ব্রাহ্মমুহূর্তে (রাতের শেষ, দিনের শুরু) উঠে পূর্বদিকে মুখ করে উপাসনা হতো, আসন শেখানো হতো। এমনকি কবিগুরু বিদেশে থাকাকালীনও শান্তিনিকেতনে পাঠানো চিঠিতে পড়ুয়াদের প্রাণায়াম শেখানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি নিজে যখন শান্তিনিকেতনে থাকতেন নিয়ম করে যোগাভ্যাস করতেন। তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী ১০ বছরের (১৯৪১-১৯৫১) কোনও পোক্ত ইতিহাস জানা যায় না।
১৯৫১ সালের পরে অবশ্য যোগ, ধ্যান, আসন বিষয়গুলি শান্তিনিকেতন থেকে কিছুটা হারিয়ে যেতে থাকে। ১৯৫৫ সালে পুনরায় কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে নতুন উদ্যমে বিষয়গুলি শুরু হয়। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই নকশাল আন্দোলনের প্রভাব পড়ে। আক্রমণের ভয়ে বন্ধই হয়ে যায় সকালের উপাসনা। এর পর ১৯৯৮ সালে বিশ্বভারতীতে যখন শারীরশিক্ষা বিভাগ চালু হল তখন আবার নতুন করে যোগ জায়গা পেল বিশ্বভারতীতে। স্নাতক স্তরের প্রথম বর্ষে যোগ বিষয়টিকে আবশ্যিক করা হল। স্নাতক তৃতীয় বর্ষ ও স্নাতকোত্তরে বিশেষ পেপারের মধ্যে ফুটবল, ক্রিকেটের মতোই যোগকেও একটি বিশেষ পেপার করা হল। ২০০০ সালে যখন অটলবিহারী বাজপেয়ী বিশ্বভারতীর আচার্য, কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী মুরলীমনোহর যোশী তখনই যোগ বিভাগের জন্য অনুমোদন পেয়েছিল বিশ্বভারতী। ১ জন অধ্যাপক, ২ জন রিডার, ৩ জন লেকচারার ও ৫ জন কর্মীর নিয়োগ সহ ১০ লক্ষ টাকা দিতে চেয়েছিল কেন্দ্র সরকার। কিন্তু তখন নির্দিষ্ট পরিকাঠামোর অভাবে বিশ্বভারতী আবার একটি নতুন বিভাগ তৈরিতে প্রস্তুত ছিল না। যেহেতু তার মাত্র বছর দুয়েক আগেই চালু হয়েছে শারীরশিক্ষা বিভাগ। এ ভাবেই শারীরশিক্ষা বিভাগের মধ্যেই যোগ প্রাণ পেতে থাকল। যার অন্যতম কাণ্ডারী ছিলেন যোগিক আর্ট ও সায়েন্স বিভাগের বর্তমান বিভাগীয় প্রধান সমীরণ মণ্ডল।
২০১৩ সালে বিশ্বভারতীর উদ্ভাবনী শিক্ষা ও গ্রামীণ পুনর্গঠন দফতরের ডিরেক্টর পদে দায়িত্ব নিলেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন। যার ফলে পদাধিকার বলে ওইসময়ই তিনি বিনয়ভবনের অধ্যক্ষ হন। জানা যায়, তিনি ও সমীরণবাবুর উদ্যোগে এবং বিনয়ভবনের ইনস্টিটিউট বোর্ডের এক্সটারনাল মেম্বার স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দের সহায়তায় পুনরায় যোগ বিভাগ গঠনের উদ্যোগ নেয় বিশ্বভারতী।
২০১৬ সালে শারীরশিক্ষা বিভাগের অধীনে শুরু হয় যোগশিক্ষার উপর স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা কোর্স। ২০১৬ সালের ১৯ মে কেন্দ্র থেকে ছ'টি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ বিভাগ গঠনের অনুমতি দেওয়া হয়। যার মধ্যে একটি ছিল বিশ্বভারতী। ৩০ মে শিক্ষাসমিতিও বিষয়টির অনুমোদন করে। সেই অনুযায়ী ২০১৭ সালের ১৫ মে ‘যোগিক আর্ট অ্যান্ড সায়েন্স’ নামে বিভাগটির উদ্বোধন হয়। ওই শিক্ষাবর্ষ থেকেই পড়ুয়ারাও ভর্তি হতে শুরু করেন। বর্তমানে ডিপ্লোমা কোর্সটিও এই বিভাগের অন্তর্গত হয়েছে। বর্তমানে যোগ চর্চায় গুরুত্ব বেড়েছে। বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তির চাবিকাঠি হিসেবে যোগ প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, প্রবল উৎসাহে যোগাভ্যাস করা যায়, তাতে ক্ষতি নেই। তবে নিজের শরীরের জন্য কতটুকু দরকার, আর ঠিক কী কী দরকার, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যোগের জন্য কোনও শান্ত পরিবেশ বেছে নিলে মনঃসংযোগের কাজে সুবিধা হয়। একইসঙ্গে হালকা আরামদায়ক পোশাক পড়াও জরুরি। অ্যান্টি-স্কিড যোগা ম্যাট কেনাই ভাল। যদিও মাটিতে চাদর পেতে কিংবা খালি মেঝেতেও যোগাভ্যাস করা যায়। অভ্যাসের শেষে শবাসনের জন্য কিছুটা সময় রাখতে হবে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কিছুদিন কিংবা সপ্তাহখানেক নয়, যোগাভ্যাসের ভাল ফল পেতে হলে নির্দিষ্ট সময়ে নিয়ম করে অভ্যাস করতে হবে। যদিও যোগ বিষয়টি পুরনো তবে তাতে আধুনিকতা মিশেছে বলেই মানুষের আকর্ষণ বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে প্রশিক্ষকদেরও জীবিকার নতুন পথ খুলে যাচ্ছে।
যোগের আরও একটা নাম আছে, সাইকো-সোম্যাটিক মেডিসিন। অর্থাৎ, মন থেকে শরীরে যে সব রোগ জন্ম নেয়, তাদের মোক্ষম ওষুধ যোগাসন। দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ থেকে প্রেশার, সুগার, অনিদ্রার মতো বিভিন্ন শারীরিক অসুখ হয়। ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের মতো কিছু পেটের রোগ আছে, নিয়মিত যোগাভ্যাসের ফলে যেগুলি সেরে যায়। এসব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ডাক্তাররাও পরামর্শ দেন যোগাসনের দিকে ঝোঁকার। কারণ, মনকে ফুরফুরে রাখার কাজ করে যোগাসন। ফলে শরীরও ঝরঝরে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, যাঁরা অফিসে চাকরি করেন, তাঁদের জন্য এগজ়িকিউটিভ যোগা খুব ফলপ্রসূ। যাঁরা প্রথম যোগাসন শুরু করেন তাঁদের ক্ষেত্রে প্রথমদিকে কিছু হালকা এক্সারসাইজ় দেওয়া হয়। যাঁরা প্রথম যোগ শুরু করছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে নমনীয়তা কত, তা আগেই দেখে নেওয়া দরকার। কেননা নমনীয়তা কম থাকলে যোগাভ্যাস খুব একটা সহজ হবে না। আরও একটি বিষয় জেনে রাখা জরুরি। তা হল, ব্যথার কোনও ইতিহাস আছে কিনা। পুরনো ব্যথা থাকলে যোগাসনের সব ভঙ্গি করা যায় না। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন সব কিছুই সহজলভ্য। তবে ইন্টারনেট দেখে কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তাতেই যোগ চর্চা ঠিকমতো হবে, মিলবে রোগমুক্তির উপায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy