Advertisement
E-Paper

অধ্যক্ষা মানবী

রূপান্তরিত মানুষ হিসেবে প্রথম বার কোনও কলেজের প্রধান হলেন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন সাবেরী প্রামাণিকতুমি নাকি পিন্‌ছিপাল হইয়েচো!’’ ‘‘হ্যাঁ।’’ ‘‘হাসির খোরাক কইরলে গো! দেখো হাস্যাস্পদ হইয়ে যেয়ো না!’’ ‘‘তা আমি তো হাসিরই খোরাক! বরাবর।’’ সন্তোষপুরে নতুন কেনা ফ্ল্যাটে বসে এক শিক্ষিকার সঙ্গে তাঁর কথালাপটি শোনাচ্ছিলেন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০০:০৪
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

তুমি নাকি পিন্‌ছিপাল হইয়েচো!’’

‘‘হ্যাঁ।’’

‘‘হাসির খোরাক কইরলে গো! দেখো হাস্যাস্পদ হইয়ে যেয়ো না!’’

‘‘তা আমি তো হাসিরই খোরাক! বরাবর।’’

সন্তোষপুরে নতুন কেনা ফ্ল্যাটে বসে এক শিক্ষিকার সঙ্গে তাঁর কথালাপটি শোনাচ্ছিলেন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘রূপান্তরিত’ মানুষ হিসেবে প্রথম বার কোনও কলেজের প্রধান হয়ে যিনি আপাতত খবরে। আর সে-খবর পেয়ে ও ভাবেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন তাঁর কলেজের কাছেই অন্য কলেজের এক বিভাগীয় প্রধান।

কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের মানবীর অধ্যক্ষা হয়ে ওঠাটা কার্যত নজিরবিহীন। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী নিজেকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়েই ওই পদের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

কী সেই রায়?

গত বছরের এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, বৃহন্নলা ও রূপান্তরকামীরা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবেই আবেদন জানাতে পারবেন।

এ প্রতিবেদন তৈরির সময় মানবী ঝাড়গ্রামের মানিকপাড়া কলেজের বাংলার শিক্ষক। নতুন কলেজে চলে যাবেন কিছু দিনের মধ্যেই। বলছিলেন, ‘‘নৈহাটিতে বাবা থাকেন। বাবাকে দেখাশোনা করার জন্যই কৃষ্ণনগরের চাকরিটা নিলাম। না হলে অধ্যক্ষ হওয়ার তেমন কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না। তবে এখন একজন ভাল অধ্যক্ষ হয়ে ওঠাটাই আমার পেশাজীবনের প্রথম পছন্দ।’’

নতুন দায়িত্ব। আজ আর শুধু শিক্ষক নয়, একেবারে প্রধান। কেমন লাগছে, জানতে চাইলে বললেন, ‘‘নতুন কলেজ থেকে ফোন এসেছিল। ওঁরা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। কী ভাবে আমি এগোবো, তা নিয়েও কথা চলছে। ভালই তো লাগছে।’’ তবে সাফল্যের আরও একটি শৃঙ্গ পেরিয়ে মাঝে মাঝেই ফিরে যাচ্ছেন কঠিন থেকে কঠিনতর সময়গুলোয়।

২০০৩ সাল। সদ্য সোমনাথ থেকে মানবী হয়েছেন তখন। কত কথা কানে আসত। রাগে, অপমানে গা গুলিয়ে উঠত। এক জন যেমন বলেছিল, ‘‘তুই তো ভেল্কি দেখালি রে! ব্যাটাছানা থেকে বিটিছানা হইয়ে গেলি। এই সে দিন পর্যন্ত ককর ক করে মোরগ ডাকছিল, হঠাৎ দেখি সে-ই মুরগির মতো কক্‌কক্ করছে!’’

এমন কথা আজও শোনেন। কিন্তু ফারাক এই যে, আজ আর তেমন গায়ে মাখেন না।— ‘‘বাড়ির লোকজন প্রথম দিকে ভাবত, এত সব শরীরে কি সইবে? মরেই যাব বোধ হয়। আমার দুই দিদি যেমন। আমায় নিয়ে এত চিন্তায় থাকত, কেবল শুকনো মুখে ঘুরত। এখন ওরাও অনেক স্বাভাবিক।’’

বিরানব্বই বছরের অসুস্থ বাবা আর তাঁরই মতো অনেক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নিয়ে মানবীর এখনকার জীবন। তাঁর সংসার। আর আছে ‘একমাত্র ছেলে’ বছর চব্বিশের যুবক দেবাশিস। সদ্য এমএ পাস করেছেন। ঝাড়গ্রামে মানবীর কলেজ-পাড়ার কাছেই অন্য একটি কলেজে পড়াশোনা করতেন। মেদিনীপুরের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। চার বছর আগে এক সেমিনারে মানবীর আলাপ তাঁর সঙ্গে। কথায় কথায় হঠাৎই তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘আমাকে মা বলে ডাকতে পারবি?’’ সেই থেকে মানবী দেবাশিসের মা। আর দেবাশিস? পদবি পাল্টে হয়ে গিয়েছেন দেবাশিস মানবীপুত্র।

ছাত্রছাত্রীদের অসম্ভব ভালবাসেন। তাদের কাছেও মানবী সমান জনপ্রিয়। যত ঝক্কি এদের বাইরের গণ্ডিটা নিয়ে। অতর্কিত প্রশ্ন, অহেতুক কৌতূহল মাঝে মাঝেই ছিঁড়ে খেতে আসে তাঁকে। সেই গোড়া থেকেই।

১৯৯৫ সাল। তখনও মানবী হননি। পোশাকি নাম সোমনাথ। ঝাড়গ্রামের কলেজে বাংলা মাস্টারমশাই হিসেবে যোগ দিলেন। তারিখটাও খেয়াল করার মতো। ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস।

চুড়িদার-কুর্তা পরা, চোখে কাজল টানা, লম্বা চুলের মাস্টারমশাইকে দেখে একটু আলাদা মনে হলেও গ্রামের পড়ুয়ার দলও কখনও তাঁকে দেখে ভুঁরু কোঁচকায়নি। কিন্তু সহকর্মীদের বাঁকা কথার ঠেলায় অতিষ্ঠ লাগত। মানবীর গোপনাঙ্গ নিয়ে প্রকাশ্যে ঠাট্টা করতে যেমন তাঁদের বাধত না, আপত্তিকর প্রস্তাব দিতেও তাই।

এ সবেরই মধ্যে তিনি মানবী হলেন। বিয়েও করলেন স্থানীয় এক যুবককে। যার পূর্বশর্ত ছিল, নতুন বউকে দিনে আড়াইশোটি রুটি বেলতে হবে। কিন্তু সে সব উপেক্ষা করেই বিয়েটা করেছিলেন। পরিণতি সুখের হয়নি। যার জেরে মামলা গড়িয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট অবধি।

মানবীর কথায়, ‘‘সে অনেক দিনের কথা। এখন ছেলে আমার এত খেয়াল রাখে যে মনে হয়, স্বামীর থেকে সন্তান অনেক বেশি জরুরি। তবে মজার কথা হল, প্রাক্তন প্রেমিকদের কেউ কেউ এখনও যোগাযোগ রাখে। এমনকী, স্বামী যদি শেষ জীবনে আমার কাছে চলে আসেন, তা নিয়ে আশঙ্কাতেও ভোগে তাঁদের একজনের স্ত্রী। আমি অবশ্য কথা দিয়েছি, সে এলেও ফিরিয়ে দেব।’’

চার বছর বয়সে তুতোদাদার যৌনলালসার শিকার, কিশোর ‘বনমালী’র নিজেকে ‘রাধা’ বলে চিনতে পারা এবং প্রকাশ্যে তা স্বীকার করা, একের পর এক প্রেম, সেগুলি ভেঙে যাওয়া, যাদবপুর থেকে স্নাতকোত্তর এবং এম ফিল, পরে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা, স্কুল-কলেজে শিক্ষকতার চাকরি, রূপান্তরিত হয়ে নারী হিসেবে নবজন্ম, বিয়ে, আর সবশেষে মেয়েদের কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচিত হওয়া।— এতটা পথ পেরিয়ে এসে আজ মানবী আগের চেয়ে অনেক আত্মবিশ্বাসী, উদ্যমীও।

কলেজের পাশাপাশি রয়েছে তাঁর তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে কাজকর্ম। যাঁদের অনেকেই দিনের বেলা ওঁর বাড়িতে এসে মনের সুখে মেয়ে সেজে থাকেন। রাতে বাড়ি ফেরেন ছেলেদের পোশাক পরে। এঁদের সঙ্গে ‘ওঁদের ভাষাতে’ কথা বলেন মানবী। যে ভাষার অভিধানে মেয়েকে বলে ‘লাহেরন’, ছেলেকে বলে ‘টোন্যা’! কিন্তু ওই ভাষাটুকুরই যা ফারাক, মানবী বলেন, জীবনের চাওয়াপাওয়া, টানাপড়েনে এ পৃথিবীর রসায়ন বাকি ভূখণ্ডের থেকে কতটুকুই বা আলাদা! তাঁর আক্ষেপ, দুনিয়ার ক’জনই বা বোঝে সে কথা!

উঠে আসার সময় আচম্বিতে বলে ওঠেন, ‘‘ভাল চাকরি করি, মোটা মাইনে পাই। লিপস্টিকটারই কত্ত দাম! এখন আর এ সব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী হবে?’’ তাঁর গাঢ় লাল ঠোঁটের ফাঁকে বিদ্যুৎ খেলে যায়। তার আড়ালে কতটা ক্ষোভ, কতটা হতাশা, কতটাই বা উপেক্ষার আর তাচ্ছিল্যের— বোঝা যায় না!

college principal manabi bandyopadhyay transgender manabi bandyopadhyay krishnanagar womens college saberi pramanik
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy