E-Paper

কৃপণ

রিনির বর তমালও এসে দু’হাত ধরে অভিনন্দন জানায় পিসশাশুড়িকে। দময়ন্তী এত ক্ষণে পরিপূর্ণ ভাবে অনুভব করেন তাঁর ‘লাইফটাইম মোমেন্ট’টি।

ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল।

ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল।

মোনালিসা চন্দ্র

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২৫ ০৭:৫৬
Share
Save

বস্টন এয়ারপোর্টে চেনা মুখগুলো দেখতে পেয়ে হুইলচেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন দময়ন্তী। ভাইঝি রিনিকে চোখে না দেখা অবধি টেনশনে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, আমেরিকায় প্রথম পদার্পণের আনন্দটাই মাথা নিতে পারছিলনা। বলতে গেলে রিনির ভরসাতেই দময়ন্তীর সাহস করে এই সাতসমুদ্দুর পাড়ি দেওয়া।

ও দিকে “পিসিমণিইই! ওয়েলকাম ওয়েলকাম...” বলতে বলতে ছুটে এসে দময়ন্তীকে জড়িয়ে ধরে বনবন করে কয়েক পাক ঘুরে নেয় রিনি, তার পর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া গলায় বলে, “আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না তুমি ইউএসএ এসেছ, তাও আবার লেকচার দিতে! আই অ্যাম ফিলিং সো প্রাউড অব ইউ পিসিমণি!”

রিনির বর তমালও এসে দু’হাত ধরে অভিনন্দন জানায় পিসশাশুড়িকে। দময়ন্তী এত ক্ষণে পরিপূর্ণ ভাবে অনুভব করেন তাঁর ‘লাইফটাইম মোমেন্ট’টি। মানুষের জীবনে এমন স্বপ্ন-সত্যি-হওয়া ঘটনা কমই ঘটে। তাও আবার এমন স্বপ্ন, যা কোনও দিন দেখাই হয়নি। এ এক স্বপ্ন-ছাড়ানো উচ্চতার গল্প।

যে বয়সে পৌঁছলে স্বপ্ন-টপ্ন দেখার পাট মোটামুটি চুকে যায়, সেই বয়সে পৌঁছে অভাবনীয় এক স্বপ্ন সফল হচ্ছে দময়ন্তীর। জীবনযাত্রাটি মোটের উপর নির্ঝঞ্ঝাট ছিল বলে স্বপ্নের বালাই-টালাই জীবনে তেমন ছিল না তাঁর। আসলে, জীবনযাত্রায় অভাববোধ না থাকলে স্বপ্নেরা সাধারণত জন্মানোর গরজ দেখায় না।

তবে কৈশোর স্বপ্নিলই ছিল দময়ন্তীর। বিশেষ একটি স্বপ্নে তো রীতিমতো বিভোর হয়ে থাকতেন। মঞ্চের পর মঞ্চ মাতিয়ে চলেছেন, হোর্ডিংগুলোয় জ্বলজ্বল করছে নাম, মঞ্চে পদার্পণমাত্র করতালিতে ফেটে পড়ছে প্রেক্ষাগৃহ, অনুরাগীরা অটোগ্রাফের খাতা হাতে ঘিরে ধরে নড়তে দিচ্ছে না— এমনতর কতশত ছবির মিছিল যে চলত মাথায়! এক জন তারকা আবৃত্তিকার হওয়ার স্বপ্ন ছিল দময়ন্তীর। সে সব কথা মনে পড়লে আজ হাসি পায়।

আমেরিকায় আসার আমন্ত্রণ পাওয়ার প্রাথমিক অভিঘাত কাটিয়ে ওঠার পর অনেক ভেবেচিন্তে দময়ন্তীর মনে হয়েছে, তাঁর সেই কৈশোর-স্বপ্নের সঙ্গে একটা ক্ষীণ যোগসূত্র কোথাও যেন আজকের এই সৌভাগ্যের পিছনে রয়েছে। এই জন্যই বুঝি বলে— জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা।

আবৃত্তিচর্চা নিয়ে কৈশোর-যৌবনের কয়েকটা বছর খুব মেতে থাকলেও তার শেষরক্ষা হয়নি। বড্ড নাক-উঁচু এক বনেদি পরিবারে বিয়ে হয়েছিল দময়ন্তীর। সেই পরিবার তাদের আভিজাত্যের প্রভাব খাটিয়ে তাকে একটু একটু করে সরিয়ে এনেছিল তার শিল্পচর্চার মেঠো মঞ্চগুলো থেকে। দৈনন্দিন আরাম ও সুখের জীবনে স্বপ্নেরা আর জায়গা পায়নি, দময়ন্তীর ভিতরেও লড়াইয়ের ইচ্ছেগুলো মরে গেছিল।

“তুমি কবে থেকে এই সব ফিল্যানথ্রপিক কাজের সঙ্গে জুড়ে গেলে বলো তো পিসিমণি? মিস্টার চ্যাটার্জিই বা তোমায় চিনলেন কী করে?” পিসিকে পাশে বসিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে শুধোয় রিনি।

হাসেন দময়ন্তী। তার পর বলেন, “ছেলেটির ঠাকুমার সঙ্গে পরিচয় ছিল আমার। সেই সূত্রেই নাতিরসঙ্গে আলাপ।”

“ভদ্রলোক কিন্তু ভীষণ ডাইন্যামিক। বলতে গেলে তিনিই এই কনফারেন্সের মাস্টারমাইন্ড। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, অনুষ্ঠানটা হচ্ছেও বেশ বড় করে...” পিছনের সিট থেকে বলে ওঠে তমাল।

“আপনার অনারে পার্সোনাল ইনভিটেশন পেয়েছি আমরা। এখানকার বড় বড় বিলবোর্ড, লোকাল টিভি চ্যানেল সব কিছুতে ফ্ল্যাশ করছে এর অ্যাড...” আরও তথ্য যোগকরে তমাল।

“কিন্তু তোমাকে যে ওরা এক জন স্পিকার হিসেবে সিলেক্ট করল, বয়স্কদের জন্য কী এত কাজ করো তুমি? আগে তো কিছু শুনিনি! তুমি তো পুরো ছুপা রুস্তম নিকলি পিসিমণি!” ডান হাতটা বাড়িয়ে আদর করে পিসির গাল টিপে দেয় রিনি।

কোন কর্মের ফলে আজ তাঁর এই অকল্পনীয় প্রাপ্তি, তা কি দময়ন্তীর নিজের কাছেই পরিষ্কার?

যে জিষ্ণু চ্যাটার্জির আমন্ত্রণে দময়ন্তী আজ আমেরিকায়, তাঁর ঠাকুমার সঙ্গে দময়ন্তীর আলাপ বড়জোর বছর তিনেকের। প্রতিবেশিনী সুলেখার সঙ্গে এক দিন ‘বয়সিনী’ নামের এক মহিলা সমিতিতে গিয়ে কয়েক জনের সঙ্গে আলাপ হয় দময়ন্তীর, উমাদি ছিলেন তাদের এক জন। সেই উমাদিই জিষ্ণুর ঠাকুমা। সত্যি বলতে, বুড়িদের ওই সমিতিটি মোটেই টানেনি দময়ন্তীকে। কিন্তু দেখা গেল, সমিতি তাঁকে না টানলেও সমিতির অনেকে দময়ন্তীর প্রতি একটা টান অনুভব করলেন, বিশেষ করে উমাদি।

আসলে দময়ন্তী বড় মিষ্টভাষী। এই ইউএসপি-টিই সম্ভবত দময়ন্তীর মহার্ঘতম ‘জীবনের ধন’। যে আবৃত্তি শিক্ষকের কাছে বিয়ের আগে কয়েক বছর তালিম নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, তিনি বলতেন, “কথা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে হবে তোমাদের, বুঝেছ? কবিতা তো কবির কথা, কিন্তু অনুষ্ঠানের শুরুতে আর শেষে, কখনও বা দু’টি কবিতার মাঝখানে, যে কথাগুলো বলার সুযোগ তোমরা পাবে, সেটুকু দিয়েই নিজেদের জাত চেনাতে হবে।”

এই উপদেশটিই বুঝি গাঁট বেঁধে রয়ে গিয়েছিল দময়ন্তীর মনে। সেই সঙ্গে রয়ে গিয়েছিল সেই মাস্টারমশাইয়ের শেখানো কিছু প্রকরণ। আবৃত্তির জগৎ থেকে সরে এলেও অবচেতনে হয়তো এ সবেরই চর্চা দময়ন্তী চালিয়ে গেছেন জীবনভর। পারিবারিক জমায়েতে তাঁর কথাবার্তা সকলেই যে একটু আলাদা মনোযোগ দিয়ে শোনে, এটা তো এখনও দেখা যায়। ‘বয়সিনী’র সদস্যরাও শুনেছিল এবং মুগ্ধ হয়েছিল। উমাদি নিজগুণে মুগ্ধ হয়েছিলেন আর একটু বেশি।

স্বামীর রেখে যাওয়া সংস্থানের জোরে সেবক-সেবিকা পরিবৃত জীবন ছিল উমাদির। তাঁর অকালমৃত ছেলে-বৌমার এক সন্তান আমেরিকাবাসী জিষ্ণু, অন্য জন কানাডাবাসী জয়ী। নিজের কাজ আর সংসার সামলে ঠাকুমার নিত্য খবর নেওয়া জয়ীর দ্বারা হয়ে ওঠে না, কিন্তু জিষ্ণুর দ্বারা হয়, কারণ তার ঘর-সংসারও নেই, কাজ-কারবারও নেই। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোই নাকি জিষ্ণুর একমাত্র কাজ। সে যখন দেশে ছিল এই-ই করত, আমেরিকাতে গিয়েও তাই করে।

আপনজনহীন উমাদি মনের আনন্দটুকু জোগাড় করতেন বয়সিনী-র জমায়েতে এসে। দময়ন্তীকে সেখানে টেনে আনার আগ্রহটা তাঁর তরফেই তাই ছিল বেশি। দময়ন্তীর আড়ো-আড়ো ভাব লক্ষ করে সমিতির নানা উৎসবে বিশেষ অতিথির সম্মান দিয়ে তাঁকে ডাকতে শুরু করেছিলেন উমাদি। অত আমন্ত্রণের প্রতিদান হিসেবে এক বার নারী দিবসের অনুষ্ঠানে কিছু কবিতা পাঠ করে সকলকে মাতিয়ে দিলেন দময়ন্তী। আবেগে আপ্লুত বয়সিনী-কোম্পানি এর পর দময়ন্তীকে ধরে পড়ল তাদের কবিতা শেখানোর আবদার নিয়ে।

বলা বাহুল্য, সে প্রস্তাবে মোটেই নেচে ওঠেনি দময়ন্তীর মন। বয়স্ক মানুষগুলোর জিভের জড়তা কাটানোর, র-ড় এবং স-শ এর দোষ খণ্ডানোর কিংবা স্বরক্ষেপণের মাহাত্ম্য বোঝানোর পরিশ্রম করার কোনও উৎসাহ দময়ন্তী মনের মধ্যে খুঁজে পাননি। কিন্তু বরাবরের মতো তাঁর মিষ্টি কথার ওড়না-ঢাকা অন্তঃকরণটি চোখের আড়ালেই রয়ে যায় বয়সিনীদের। উল্টে তারা ভাবে, যথেষ্ট ইচ্ছে থাকলেও সাংসারিক কারণেই বুঝি দময়ন্তী অপারগ। ফলে দময়ন্তীর প্রতি তাঁদের আবেগে ভাটার টানও ধরে না।

শেষ অবধি অবশ্য দময়ন্তী বয়সিনীদের দিয়ে দু’-একটা অনুষ্ঠান করিয়েছিলেন। আসলে তত দিনে অন্য এক ভাবনা মনের গহনে মাথা তুলতে শুরু করেছিল। বুড়িদের জন্য না হোক, অল্পবয়সিদের জন্য একটা আবৃত্তির স্কুল খুললে কেমন হয়? তাতে নতুন করে পুরনো শখের চর্চাও হয়, কিছু অর্থাগমের সম্ভাবনাও থাকে। তাঁর আবৃত্তিচর্চায় যাঁদের মান যেত, সেই গুরুজনেরা সকলেই আজ পরলোকে, ফলে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। স্কুলের জায়গা নিয়েও সমস্যা হবে না। উমাদি পারলে নিজের বিশাল ড্রয়িংরুমটিই দময়ন্তীকে ছেড়ে দিয়ে বলবেন, ‘স্কুলটা এখানে করো প্লিজ়’। আসলে লোকজনের সঙ্গ পাওয়ার তৃষ্ণা মানুষটির আকণ্ঠ।

বয়সিনীদের দিয়ে দু’-একটা কবিতা-কোলাজ আর শ্রুতিনাটক করানোটা তাই ছিল দময়ন্তীর একটা হিসেবি পদক্ষেপ। এ কাজের পিছনে খুব যে খেটেছিলেন তাও নয়, কিন্তু তবু বয়সিনীর দল অনুভব করেছিল তাঁর দায়বদ্ধতা। দময়ন্তী মাঝে মাঝে ভাবেন, শিল্পে সততার প্রয়োজন সত্যি সত্যি কতখানি, অন্তত বাচিকশিল্পে। তাঁর মতো সাধারণ এক জন শিল্পীই যদি বাক্চাতুর্য আর কণ্ঠস্বরের জাদুতে মিথ্যাকে এতখানি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেন, তা হলে উৎকৃষ্ট শিল্পীরা তো হয়-কে নয় করে দেবেন!

সেই সব দিনগুলোয়, দময়ন্তী যখন ঘন ঘন উমাদির বাড়ি যেতেন রিহার্সালে কিংবা শুধুই গল্প করতে, তখন প্রায়ই ঠাকুমার কাছে কল আসত নাতির, আর সেই সব ফোনালাপে দময়ন্তীর ব্যাপারে উচ্ছ্বাসের ঢল নামাতেন উমা। সে উচ্ছ্বাসে শুধু যে দময়ন্তীর শিল্পপ্রতিভার প্রশংসা থাকত তা নয়, তার চেয়েও বেশি করে থাকত তাঁদের মতো বৃদ্ধাদের জীবনে আনন্দ আর উৎসাহের কতখানি জোয়ার এনে দিয়েছেন দময়ন্তী, তার বিবরণ। কে নাকি অবসাদে তলিয়ে যাচ্ছিল, আবৃত্তির হাত ধরে তাকে জীবনে ফিরিয়েছেন দময়ন্তী। পুত্রবধূদের অত্যাচারে কার যেন অশ্রুসর্বস্ব জীবন হয়ে উঠেছিল, নাটকের মধ্যে সে খুঁজে পেয়েছে অশ্রু সংবরণের মহৌষধ। উমাদির কথা শুনে লজ্জাই পেতেন দময়ন্তী, তবে সেই সঙ্গে নিজের কথাশিল্পী-সত্তাটির পিঠ না চাপড়েও পারতেন না। যে বাজারে ভাল কাজেরই নাম নেই, সেখানে দময়ন্তীর এমন দায়সারা কাজেরও এত প্রশংসা! শুনলে লজ্জা করে বইকি।

দময়ন্তী কি তখনও ভাবতে পেরেছিলেন আরও কী কী তোলা রয়েছে তাঁর জন্য ভবিষ্যতের শিকেয়?

এক স্নিগ্ধ ভোরে কাউকে এতটুকু ব্যতিব্যস্ত না করে বৃদ্ধা উমাদি স্বর্গে গেলেন। খবর পেয়ে ছুটে এল নাতি। শ্রাদ্ধশান্তি করল যথাবিহিত। বয়সিনীরা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে করল তাঁদের উমাদির স্মরণসভা। সে সভায় বসে নাতি শুনল দময়ন্তীর মনকাড়া ভাষণ আর স্মৃতিচারণ। আলাপ করল তার ঠাকুমার সঙ্গিনীদের সঙ্গে, দময়ন্তীর সঙ্গে তো বটেই। এর কিছু দিন পরেই টেলিফোনে এল সেই প্রস্তাব। ‘ওয়ার্ল্ড জেরিয়াট্রিক সোসাইটি’-র নর্থ আমেরিকা চ্যাপ্টারের ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট মিস্টার জিষ্ণু চ্যাটার্জি শ্রীমতী দময়ন্তীকে অনুরোধ করছেন তাঁদের সংস্থার দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে বক্তা হিসেবে সে দেশে পদার্পণের কষ্টস্বীকার করার জন্য।

‘ভাবার একটু সময় চাই’ বলে টেলিফোনটি নামিয়ে রেখে বেশ কিছু ক্ষণ থরথরিয়ে কেঁপেছিলেন সে দিন দময়ন্তী। এ কী অবিশ্বাস্য প্রস্তাব! যাওয়া-আসার ভাড়া তো বটেই, থাকা-খাওয়া বাবদ কিছু সাম্মানিক অর্থের পর্যন্ত অঙ্গীকার করছে তারা। খোঁজখবর করে দময়ন্তী জানলেন সংস্থাটি অনামী তো নয়ই, বরং বয়স্কদের কল্যাণমূলক কাজের জন্য যথেষ্ট বিখ্যাত।

যে সমস্ত বাধাবিপত্তি সব সময় সঙ্গিন উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদেরও বুঝি কখনও সখনও ইচ্ছে হয় ভূমিকা বদলের। বল্লম-তলোয়ার নামিয়ে রেখে তারা তখন হাতে তুলে নেয় ফুলের সাজি, আর কঠিন রাস্তায় ছড়াতে থাকে ফুল। ফলে কণ্টকাকীর্ণ পথও ফুসমন্তরে হয়ে যায় কুসুমাস্তীর্ণ। দময়ন্তীর আমেরিকা যাত্রার ঘটনাটিও ঘটল খানিকটা তেমনই। কোনও বাধাই যেন মাথা তুলে দাঁড়াল না সেখানে। শেষ মুহূর্তে সম্মেলনের ‘ভেনু’টা পর্যন্ত বদলে গিয়ে হয়ে গেল বস্টন, যেখানে থাকে দময়ন্তীর আদরের ভাইঝি রিমি। কনফারেন্স অডিটোরিয়ামটিও, দেখা গেল, রিমিদের বাড়ি থেকে মাত্র ‘ওয়ান-আওয়ার ড্রাইভ’।

স্বদেশীয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের একাকিত্ব ও অসহায়তা বিষয়ে কিছু আলোচনা ও তার সম্ভাব্য সমাধানসূত্র নিয়ে আধঘণ্টার একটি ‘টক’ দিতে বলা হয়েছে দময়ন্তীকে। ‘নেট’ ঘেঁটে সে ‘টক’-এর মুসাবিদা তৈরি করলেন দময়ন্তী, কর্তার সাহায্য নিয়ে। রিমি করে দিল তার সাবলীল অনুবাদ। তমাল বানিয়ে দিল গোটাকয়েক স্লাইড, যা আরও আকর্ষক করে তুলবে দময়ন্তীর উপস্থাপনা। তার পর বারংবার রিহার্সাল দিয়ে দময়ন্তী আত্মস্থ করলেন সে বক্তৃতা, প্রস্তুত করলেন নিজেকে, তার পর চড়ে বসলেন বিমানে।

নির্দিষ্ট দিনে মন-মাথা-চোখ একত্র করে এবং নিজের যাবতীয় বাক্প্রতিভা উজাড় করে পড়ে ফেললেন দময়ন্তী লিখে আনা ‘টক’টি। জায়গা বুঝে স্লাইড দেখানোর দায়িত্ব নিল রিমি। কেউ কোনও প্রশ্ন করলে তার মোকাবিলার দায়িত্বও নিয়ে রাখল সে। দময়ন্তী ভাল ইংরেজি বলার অক্ষমতা জানিয়ে মার্জনা চেয়ে বাংলায় বলবেন, রিনি সঙ্গে সঙ্গে তা ইংরিজিতে অনুবাদ করে দেবে, এমনই হল ব্যবস্থা। দময়ন্তী একা নন, ভিনদেশি আরও কিছু বক্তা এই উপায় অবলম্বন করবেন, অতএব বিষয়টিতে লজ্জা-সঙ্কোচের কিছু রইল না।

নিজের ভূমিকায় প্রায় নিখুঁত দময়ন্তী অনুষ্ঠান শেষে শ্রোতাদের করতালি ও শ্রদ্ধামিশ্রিত দৃষ্টিতে নিষিক্ত হতে হতে অনাস্বাদিতপূর্ব এক রোমহর্ষণে আপ্লুত হলেন। মনে মনে তিনি তখন বলছিলেন— এ জন্মে আর কিছু না পেলেও তাঁর চলবে।

দিনশেষে ক্লান্ত দময়ন্তী এলিয়ে পড়েছেন শয্যায়। করতালির সঘন গুঞ্জন রাত্রির নিবিড় নৈঃশব্দ্যে বিলীন এখন। সেই গভীর অবসরে এক অদ্ভুত কম্পন ধীরে ধীরে গ্রাস করে তাঁকে। বহুযুগের ও পার থেকে এক কিশোরীর ক্ষীণ স্বরতরঙ্গ ভেসে আসছে যেন তাঁর কর্ণকুহরে। আজ যা-যা ঘটল তার সবটুকুই বুঝি স্বপ্ন ছিল ওই কিশোরীর। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণের দিনে তার কণ্ঠে এত বেদনা কেন? কেন এত আক্ষেপ? তিনি এক সময়ে স্বপ্নের হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে? কর্ণেন্দ্রিয় তীক্ষ্ণতর করেন দময়ন্তী। তাঁকে যে শুনতেই হবে কিশোরীর আক্ষেপোক্তি।

সেই কিশোরী তখন মৃদুকণ্ঠে আবৃত্তি করে চলেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা— “...যবে পাত্রখানি ঘরে এনে উজাড় করি– এ কী!/ ভিক্ষা-মাঝে একটি ছোটো সোনার কণা দেখি।/ দিলেম যা রাজ-ভিখারীরে স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে,/ তখন কাঁদি চোখের জলে দুটি নয়ন ভরে—/ তোমায় কেন দিই নি আমার সকল শূন্য করে।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Short story

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।