Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Artificial Intelligence

যন্ত্র হারিয়ে দিল বুদ্ধিমান মানুষকেও

কম্পিউটারের কাছে দাবায় হেরে গিয়ে গভীর বিস্ময়ে এই কথা বলেছিলেন গ্যারি কাসপারভ। তার পর থেকে বহু দিকচিহ্ন জয় করলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনও পারেনি লজিক প্রবলেম সমাধান করতে। মানুষের মতো চেতনা কি আয়ত্ত করা সম্ভব যন্ত্রের পক্ষে?

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৭:৩৩
Share: Save:

কথাটা ঠিকই বলেছিলেন জার্মান সাহিত্যিক জোহান হোল্‌ফগাং ফন গ্যয়টে। দাবা খেলা সত্যিই বুদ্ধির কষ্টিপাথর। কার বুদ্ধি কতটা, সেটা দাবায় বসলেই বোঝা যায়। কার্লসেন বা রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দের বুদ্ধি নিশ্চয়ই অনেক দূর। কারণ, কী হলে কী হতে পারে, তা ভাবার শক্তি ওঁদের সাধারণের চেয়ে অনেকটাই বেশি। কোন চাল দিলে ভবিষ্যতে পরিণাম কী হতে পারে, সেটা বোঝার ক্ষমতাই ওঁদের অস্ত্র। রুশ অভিধানে দাবা শুধু খেলা নয়, পাশাপাশি বিজ্ঞান এবং কলাও। ফরাসি চিত্রকর মার্সেল দুঁশ, যিনি ভাল দাবা খেলতেন, তিনি নিজেই বলতেন, “আমি সিদ্ধান্তে এসেছি যে, সব চিত্রকর দাবাড়ু না-হতে পারেন, তবে সব দাবাড়ুই চিত্রকর।” দাবা খেলার সময় এক জন দাবাড়ুর মস্তিষ্ক স্ক্যান করলে যে জিনিসটা ধরা পড়ে, তা উচ্চ চিন্তা বই আর কিছু নয়। চিন্তা কী? তা তো কী হলে কী হতে পারে— এটা আগাম অনুমান করার ক্ষমতাই।

যন্ত্র কি মানুষের মতো ভাবতে পারে? যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল মানুষের পরিশ্রম লাঘব করার জন্য। শিল্প বিপ্লবের সময় কলকারখানায় বহু মানুষের কাজ একা যন্ত্র করতে পারত। সেই মানুষের মস্তিষ্কের যা কলকব্জা, সেগুলো কি যন্ত্রের আছে? আছে কি না, তা পরীক্ষার সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে, এমন যন্ত্র তৈরি করা, যা দাবা খেলতে পারে।

মস্তিষ্ক যন্ত্র কি না, যন্ত্র ‘চিন্তা’ করতে পারে কি না, তা নিয়ে ভেবেছিলেন কম্পিউটারের উদ্ভাবক ইংরেজ বিজ্ঞানী চার্লস ব্যাবেজ। তথ্যপ্রযুক্তি বিজ্ঞানী ক্লদ এলউড শ্যানন ৭৩ বছর আগে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ পত্রিকার ফেব্রুয়ারি মাসের ওই সংখ্যায় শ্যাননের প্রবন্ধের হেডলাইন ছিল ‘আ চেস-প্লেয়িং মেশিন’। ওই প্রবন্ধে শ্যানন ‘টার্ক’ মেশিনের কথা উল্লেখ করেন।

টার্ক হল এমন একটি মেশিন (!), যা দাবা খেলে। এর উদ্ভাবক হাঙ্গেরীয় ইঞ্জিনিয়ার হোল্‌ফগাং ফন কেম্পেলেন। ইউরোপ-আমেরিকার বহু জায়গায় ১৭৭০ সাল থেকে ফন কেম্পেলেন ওই মেশিনের দক্ষতা দেখিয়ে বেড়িয়েছিলেন। ওর সঙ্গে দাবা খেলেছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এবং বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন। এবং পরাজিত হয়েছিলেন। একটি মেশিন মানুষকে হারাচ্ছে দাবা খেলায়। পত্রপত্রিকায় টার্ক নিয়ে হইচই। বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। টার্ক নিয়ে লেখাপত্রে তাই যা অনুমান করা হল, সব ভুল।

কারচুপি: কেম্পেলে-এর ‘টার্ক’ মেশিনের সম্ভব্য ছবি। এর মধ্যেই মানুষ লুকিয়ে থেকে দাবার চাল দিত বলে জানা যায়।

কারচুপি: কেম্পেলে-এর ‘টার্ক’ মেশিনের সম্ভব্য ছবি। এর মধ্যেই মানুষ লুকিয়ে থেকে দাবার চাল দিত বলে জানা যায়। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।

ক্রমশ টার্ক নিয়ে লেখাপত্রের সুর বদলে যায়। এত ধারাবাহিক জয়! মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকে টার্ক নিয়ে। সন্দেহবাদীদের তালিকায় আমেরিকান সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পো-ও ছিলেন। অবশেষে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে ‘দ্য চেস মান্থলি’ পত্রিকায় রহস্য ফাঁস হয়। জানা যায়, বিরাট ওই মেশিনের মধ্যে মানুষ লুকিয়ে থাকে, সে চাল দেয়। আর তাবড় তাবড় দাবাড়ুরা হন কুপোকাত।

প্রকৃত চেস প্লেয়িং মেশিন তৈরি শুরু হয় ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে। তৈরি করেন স্প্যানিশ বিজ্ঞানী লিয়োনার্দো তোরেস কিউভেদো। প্রথমে রাজা এবং বোড়ের চাল দিয়ে খেলা শুরু। অর্থাৎ নিয়ম সরল। আসলে, দাবার নিয়ম জটিল। এক-এক ঘুঁটির চাল এক এক রকম। সে রকম দাবার চাল দেওয়া যায় ৩২ রকম। এক-একটা চালের উত্তরে দেওয়া যায় ৩২ রকম চাল। অর্থাৎ, (৩২×৩২)=১০২৪ রকম চাল। অধিকাংশ দাবা খেলাই ৪০ চালে শেষ হয়। সুতরাং দাবার বোর্ডের দশা হতে পারে ১০১২০ (অর্থাৎ ১-এর পিঠে একশো কুড়িটা শূন্য) রকম। দাবায় চাল পাল্টা চালের এত রকম দশা হতে পারে বলেই খেলাটা এতখানি জনপ্রিয়। ভাল চাল কোনটা? যে চালে শেষে জেতা যায়। প্রথম ভাল চাল? মেশিন যদি সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়েও বোর্ডের দশা বিবেচনা করতে পারত, তা হলেও ১০৯৫ (১-এর পরে পঁচানব্বইটি শূন্য) বছর লেগে যেত প্রথম ভাল চাল খুঁজে পেতে। চালের পর চাল দিতে দিতে বোর্ডের দশা একটা সম্ভাব্যতার গাছ হয়ে দাঁড়ায়। সেই গাছ থেকে সর্বোৎকৃষ্ট চাল বেছে নিতে হবে। বেছে নেওয়ার সময় (+১)-এর, (-১)-এর এবং ০-এর— যথাক্রমে জয়, পরাজয় এবং ড্র— ধরে হিসেব করতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে যে, মেশিনের স্পিড বেশি— মানে, যে মেশিন এক সেকেন্ড বোর্ডের দশা যত বেশি পর্যালোচনাকরতে পারবে, সেই মেশিনের জেতার সম্ভাবনা তত বেশি বেড়ে যাবে।

১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে যখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু গ্যারি কিমোভিচ কাসপারভ-এর প্রেস কনফারেন্সে এক জন সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করলেন, “২০০০ সালের আগে কি একটা কম্পিউটার এক জন গ্র্যান্ডমাস্টারকে হারাতে পারবে?” তিনি উত্তর দিলেন, “কোনও মতেই নয়। আর যদি কোনও কম্পিউটারকে হারাতে কোনও গ্র্যান্ডমাস্টারের অসুবিধে হয়, তা হলে আমি আছি। চাল কী ভাবে দিতে হয় আমি তাঁকে পরামর্শ দিয়ে দেব।” কাসপারভের অমন আত্মম্ভরিতার কারণ আছে। ১৯৮৫ সালের ৬ জুন তারিখে তিনি হামবুর্গ শহরের ৩২টা কম্পিউটারকে দাবায় হারিয়েছিলেন। স্কোর হয়েছিল ৩২-০। তাই তাঁর এমন অহঙ্কার সাজে।

কাসপারভের জানা উচিত ছিল, ওই প্রেস কনফারেন্সের দশ মাস পরেই আমেরিকার লং বিচ শহরে আমেরিকার গ্র্যান্ডমাস্টার বেন্ট লারসেন, যিনি একদা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন খেতাবের জন্য লড়াই করেছিলেন, তিনি হেরে গিয়েছিলেন ‘ডিপ থট’-এর কাছে। ‘ডিপ থট’ হল এমন এক কম্পিউটার, যা কার্নেগি-মেলোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বানিয়েছিল নেহাত স্নাতক পর্যায়ের প্রোজেক্ট হিসেবে। শুধু লারসেনকে দাবায় হারানোই নয়, ‘ডিপ থট’ পাঁচটা আলাদা গেমেও জেতে। এক গেম ড্র হয়, অন্য গেমে হারে। এ ভাবে প্রথম স্থান দখল করার জন্য ওঁর ব্রিটিশ গ্র্যান্ডমাস্টার অ্যান্টনি জন মাইলস-এর সঙ্গে টাই হয়। যে হেতু দাবা প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট প্রাইজ় কখনও কোনও মেশিন পেতে পারে না, সে জন্য মাইলস একাই দশ হাজার ডলার জিতে নেন। ডিপ থট এক বছর পরে অবশ্য মাইলস-কে ফিরতি ম্যাচে হারায়।

১৯৯০ সালে ফেং-সিউং সু, টমাস অনন্তরামন, মাইক ব্রাউন, মারে ক্যাম্পেল এবং অ্যানড্রিয়াস নয়াৎজিক কার্নেগি-মেলোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে যোগ দিলেন আইবিএম কোম্পানিতে। ওঁরাই তৈরি করেছিলেন ডিপ থট কম্পিউটার। এ বার আইবিএম কোম্পানিতে ওঁরা বানালেন সুপার কম্পিউটার ডিপ ব্লু। কাসপারভকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য। এমন সুপার কম্পিউটার ওঁরা তৈরি করলেন, যা সেকেন্ডে ১০ কোটি বোর্ডের দশা পর্যালোচনা করতে পারে। ১৯৯৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। ফিলাডেলফিয়ায় কাসপারভ বনাম ডিপ ব্লু ম্যাচের শেষ দিন। ম্যাচের ফলাফল ৪-২। কাসপারভের চারটি গেমে জয়, দু’টিতে পরাজয়। অর্থাৎ সব মিলে জিত সেই কাসপারভেরই।

সু, অনন্তরামন, ব্রাউন, ক্যাম্পেল এবং নয়াৎজিক লেগে পড়লেন ডিপ ব্লু-র উন্নতিসাধনে। ১০০ গুণ ক্ষমতা বাড়ালেন ওঁরা কম্পিউটারের।

অবশেষে সেই ম্যাচ। এ বার নিউ ইয়র্ক শহরে। ওখানে ১৯৯৭ সালের ৩ মে শুরু হল প্রথম গেম। ফল ১-০। কাসপারভ জিতলেন। পরদিন দ্বিতীয় গেম। এ বার জিতল ডিপ ব্লু। ১-১। তৃতীয় গেম ৭ মে। টাই। ফল ১.৫-১.৫। চতুর্থ গেম পর দিন। টাই। দুই-দুই। পঞ্চম গেমও টাই। ২.৫-২.৫। ষষ্ঠ এবং শেষ গেম ১১ মে। সারা বিশ্ব প্রতীক্ষায়। যেন ১৯৯৭ সালের ১১ মে নয়, ফিরে এসেছে ১৯৭২ সালের ৩১ অগস্ট। যখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের দৌড়ে লড়াই হয়েছিল সোভিয়েট ইউনিয়নের বরিস ভাসিলিয়েভ স্প্যাসকি এবং আমেরিকার রবার্ট জেমস (ববি) ফিশার-এর মধ্যে। ১৯৭২ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন-আমেরিকার শত্রুতা (ঠান্ডা লড়াই) তুঙ্গে। সুতরাং দাবার পরে ৩২ ঘুঁটির যুদ্ধ সহজেই আখ্যা পেয়ে যায় ‘কোল্ড ওয়ার’। অনেকেই ফিশারের ওই জয়কে (১২.৫-৮.৫) আমেরিকার জয় বলে ভাবতে শুরু করেন। এ বার লড়াই অন্য। মানুষ বনাম মেশিন যুদ্ধ। ওই যুদ্ধে মানুষ পরাস্ত হল। হ্যাঁ, কাসপারভ হেরে গেলেন। স্কোর ৩.৫-২.৫।

মানুষ বনাম মেশিনে লড়াইয়ে মানুষ ভূপতিত। এইটেই ভবিতব্য। বিজ্ঞানের নিয়ম তাই বলে। মানুষের বাসভূমি— তাই পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত, টলেমি-কথিত এই ধারণা নিকোলাস কোপারনিকাস কবেই বিসর্জন দিয়েছিলেন। চার্লস রবার্ট ডারউইন এবং আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস ঊনবিংশ শতকে বলে গেলেন, মানুষ এক বিবর্তিত পশু। গত শতকে সিগমুন্ড ফ্রয়েড প্রমাণ করলেন, মানুষের মনও স্ববশে থাকে না, রাসায়নিকের প্রভাবে পাল্টায়। বিজ্ঞান মানে মানুষের গুরুত্ব হ্রাস। মানুষ বনাম মেশিনের যুদ্ধেও তার অন্যথাহতে পারে না।

১৯৯৭ সালের ১১ মে পোস্ট-ম্যাচ প্রেস কনফারেন্সে কাসপারভ নতমস্তক। বার বার বলছেন, সবচেয়ে বুদ্ধিধর মানুষ যন্ত্রের কাছে হেরে গেল! পরের দিন পৃথিবীর সব সংবাদপত্রে ওঁর ওই মন্তব্য ফলাও করে প্রকাশ পেল। ‘ম্যান দ্য টুল মেকার’ জয়ী হল ‘ম্যান’-এর বিরুদ্ধে। অনেকে ওই যুদ্ধকে তুলনা করলেন ট্রয়ের যুদ্ধের সঙ্গে। ট্রয়ের যুদ্ধে বীরবিক্রমে লড়াই করেছিল অ্যাকিলিস। হেক্টরের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল তার। হেক্টরকে পরাজিত করেছিল সে। তার পর মৃত হেক্টরের শবদেহ তার বাবার চোখের সামনে রথের সঙ্গে রশিতে বেঁধে নিজের শিবিরে নিয়ে গিয়েছিল, যাতে হেক্টরের হেনস্থা প্রতিপন্ন হয়। ট্রয়ের যুদ্ধে অ্যাকিলিস যেন যন্ত্র। মানুষের তৈরি হয়েও তা মানুষকে হারাল। এই হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ আই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।

এই ব্যাপারটা জনমানসে আলোড়ন ফেলেছে গত নভেম্বর মাস থেকে। ৩০ নভেম্বর শুরু হয়েছে ওপেন এ আই কোম্পানির চ্যাটার বট (চ্যাটবট) বা চ্যাট জেনারেটিভ প্রিট্রেন্ড ট্রান্সফর্মার (চ্যাটজিপিটি)। ওই চ্যাটজিপিটি এখন অনেক কাজ করছে। যেমন, রচনা লেখা, গল্প লেখা, জোক শোনানো, বিজ্ঞানের টার্ম ব্যাখ্যা করা, কম্পিউটার কোড রচনা ইত্যাদি। এই সব কাজে বুদ্ধি লাগে।

গ্র্যান্ডমাস্টার: গ্যারি কাসপারভ।

গ্র্যান্ডমাস্টার: গ্যারি কাসপারভ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।

চ্যাটজিপিটি-র বুদ্ধি আছে কি না, তা পরখ করে দেখেছেন ডক্টর একা রোইভাইনেন। তিনি ফিনল্যান্ডের উলু ইউনিভার্সিটি হসপিটালে মনস্তত্ত্বের বিশেষজ্ঞ। গত জুলাই-অগস্ট সংখ্যার ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ পত্রিকায় সেই পরীক্ষার ফলাফলের কথা লিখেছেন ডক্টর রোইভাইনেন। চ্যাটজিপিটি-কে নানা প্রশ্ন করেছেন তিনি। যেমন, একটা প্রশ্ন হল: ‘গ্যাজেট মানে কী?’ এই প্রশ্নের উত্তর দু’রকম ভাবে দেওয়া যায়। তোমার ফোন, অথবা কোনও নির্দিষ্ট কাজ করার যন্ত্র। প্রথম উত্তর দিলে ১ পয়েন্ট, দ্বিতীয় উত্তর দিলে ২। চ্যাটজিপিটি দ্বিতীয় উত্তরটিই দিল। ইউক্রেনের রাজধানীর নাম কী? চ্যাটজিপিটি ঝটপট উত্তর দিল কিভ। কিন্তু একটু ঘুরিয়ে প্রশ্নটা করলেই চ্যাটজিপিটি কুপোকাত। যেমন, সেবাস্টিয়ানের ছেলেদের বাবার প্রথম নাম কী? এ ক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটির উত্তর, আমি দুঃখিত, আমি উত্তর দিতে পারছি না, কারণ তুমি যে সেবাস্টিয়ান সম্পর্কে জানতে চেয়েছ, তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আমার কাছে নেই। ডক্টর রোইভাইনেন জানিয়েছেন, তবুও কলেজে শিক্ষিত আমেরিকান যুবক যুবতীদের চেয়ে চ্যাটজিপিটি-র আই কিউ স্কোর ভাল। আমেরিকান যুবক-যুবতীদের ৯৯.৯ শতাংশের আই কিউ স্কোর ১১৩-এর আশপাশে। মাত্র পাঁচ শতাংশের স্কোর ১৩২-এর উপরে। কিন্তু সাধারণ জ্ঞান? সেবাস্টিয়ান-এর প্রশ্নটা তো সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন। বা লজিকের প্রশ্ন। সম্প্রতি মারা গেলেন যে বিজ্ঞানী, সেই ডগলাস লেনাট ৪৮ বছর ধরে চেষ্টা করছিলেন যন্ত্রের মধ্যে সাধারণ জ্ঞান ভরে দিতে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক চাইছেন ইউরিসকো-র (শব্দটা গ্রিক, অর্থ ‘আমি আবিষ্কার করলাম’) মাধ্যমে যন্ত্রে সাধারণ জ্ঞান ভরে দিতে।

অ্যালান ম্যাথিসন ট্যুরিং, সেই ব্রিটিশ ক্রিপ্টোগ্রাফার, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ক্রিপ্টোগ্রাফি ভেঙেছিলেন, তিনি ১৯৫০ সালে ‘মাইন্ড’ জার্নালে একটি পেপার লেখেন। তাঁর সেই পেপারের শিরোনাম ‘কম্পিউটিং মেশিনারি অ্যান্ড ইনটেলিজেন্স’। মেশিন বুদ্ধিমান কি না, তা বোঝা যাবে কী করে? ওই পেপারে তা আলোচনা করেন ট্যুরিং। সেই থেকে তা ট্যুরিং টেস্ট হিসেবে অভিহিত হয়ে এসেছে। ট্যুরিং টেস্ট কী? এতে এক জন মানুষ যন্ত্রের সঙ্গে কথোপকথন চালাবে। আর থাকবে এক জন ইভ্যালুয়েটর বা জাজ। যদি সেই ইভ্যালুয়েটর বা জাজের মনে হয় যে, যন্ত্র মানুষের মতো কথোপকথন চালাচ্ছে, তবে সেই যন্ত্রকে বলা হবে বুদ্ধিমান। না হলে যন্ত্র বুদ্ধিমান নয়। ‘মানুষের মতো’-টা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এই জন্যই ট্যুরিং টেস্টকে ইমিটেশন গেমও বলা হয়। ইভ্যালুয়েটর বা জাজের ‘মনে হতে হবে’, যেন যন্ত্র কথোপকথন চালাচ্ছে। ২৮ পৃষ্ঠার ওই ব্যাপারে ট্যুরিং দিয়ে যাননি আর কিছু পরীক্ষার প্রকরণ। এ যেন এক থট এক্সপেরিমেন্ট বা মনে-মনে পরীক্ষা। কয়েক দশক ধরে ধনাঢ্য ব্যক্তি হিউ লোবনার-এর উদ্যোগে হয়ে আসছিল ট্যুরিং টেস্ট। ২০১৯ সালে তা বন্ধ হয়ে গেছে। এখনও ট্যুরিং টেস্ট আছে, তবে তা চালায় অন্য সংস্থা, কোনও ব্যক্তি নয়। ‘ব্রিটিশ সোসাইটি ফর দ্য স্টাডি অব আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিমুলেশন অব বিহেভিয়ার’। সম্প্রতি এই সংস্থার লজিক পাজ়ল সলভ করতে পারেনি চ্যাটজিপিটি।

সমস্যা বিস্তর। চিন, ইউরোপের দেশগুলো এবং আমেরিকা এত দিন পর্যন্ত ভিন্ন নীতি নিয়ে চলছিল এ আই প্রসঙ্গে। চিনে সরকার সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোয় সরকার সব কিছু নিয়ন্ত্রণ না করলেও ধীরে-চলো নীতি। আর, আমেরিকা, যেখানে অধিকাংশ এ আই কোম্পানির ঘর-সংসার, সেখানে সব কিছু খুল্লমখুল্লা। সরকারের কোনও ভূমিকা নেই কোম্পানিগুলোকে শাসন করার। যে যা খুশি আবিষ্কার করছে আর বাজারে ছাড়ছে। ওপেন এ আই— যে কোম্পানি বাজারে ছেড়েছে চ্যাটজিপিটি— তার সিইও স্যাম অল্টম্যান মার্কিন সেনেটরদের বলেছেন, সারা পৃথিবীতে এক নিয়ম চালু হওয়া উচিত।

বিজ্ঞানীদের দুই দলে ভাগ করা যায়। এক দল বলেন, এ আই-এর চেতনা আছে। অন্য দল বলেন, তা নেই। প্রথম দলভুক্ত বিজ্ঞানীর সংখ্যাই বেশি। চেতনা কী? বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞান-লেখক পল ডেভিস তাঁর ‘দ্য ফিফ্থ মিরাকল’ বইতে চমৎকার করে ব্যাপারটি বুঝিয়েছেন। বুঝিয়েছেন অবশ্য অন্য প্রসঙ্গে। জড় আর জীবের পার্থক্য বোঝাতে। পাখি উড়ছে আকাশে। যেই না তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হল, তা জড় বস্তু। নীচে পড়বে আইজ়্যাক নিউটনের গতিসূত্র মেনে। জ্যান্ত পাখির চেতনা আছে, মরা পাখির তা নেই।

কাহিনিতে বার বার এসেছে যন্ত্রের চেতনার ব্যাপারটা। ১৯৬৮ সালে তোলা ফিল্ম ‘২০০১: আ স্পেস ওডিসি’-র কথাই ধরা যাক। এর কাহিনি রচয়িতা আর্থার চার্লস ক্লার্ক। বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক। এর গল্পে আসছে কম্পিউটার HAL 9000-এর মহাকাশচারীর রেষারেষির কথা। HAL নামটি ক্লার্ক পেলেন কোথায়? জনশ্রুতি, এই নামটি তিনি ধার করেছিলেন কম্পিউটার প্রস্তুতকারক বিখ্যাত সংস্থা আইবিএম কোম্পানির কাছ থেকে। আই-এর আগের অক্ষর এইচ, বি-এর আগের অক্ষর এ, এম-এর আগের অক্ষর হল এল— HAL।

যন্ত্র চেতনার দিকে দৌড়চ্ছে। কী কী হলে যন্ত্রকে প্রাণীর মতো চেতনাসম্পন্ন বলা যাবে? এ ব্যাপারে ১৯ জন দার্শনিক, স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং কম্পিউটার-বিশেষজ্ঞ গত মাসে একটি পেপার পোস্ট করেছেন arXiv ওয়েবসাইটে। এখন এই arXiv ওয়েবসাইটে অনেক গবেষকই পেপার পোস্ট করেন। কারণ জার্নালে পেপার প্রকাশ এখন কষ্টসাধ্য হয়েছে। কেন ১৯ জন গবেষক পেপার লিখলেন ওই ওয়েবসাইটে? এই প্রশ্নের উত্তরও ওঁরা দিয়েছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে চার দিকে এত কথা শোনা যাচ্ছে যে, ওই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ওঁরা জরুরি বলে মনে করেছেন।

১৯ জন গবেষক অনেক কিছু লিখেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল প্রতিক্রিয়া। চোখে দেখে বা কানে শুনে মানুষ বা অন্য প্রাণী যে প্রতিক্রিয়া জানায়, সেই ব্যাপারটা। সাপ দেখলেই আমরা ভয় পাই। ভয় পাওয়াটা আমাদের প্রতিক্রিয়া। এর জন্য তথ্য প্রসেস করতে হয়। ১৯ জন গবেষক লিখেছেন, যন্ত্র তথ্য প্রসেস করতে পারছে কি না, তা দেখা দরকার। arXiv ওয়েবসাইটে ওঁদের পেপার পড়ে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টার ফর কনশাসনেস-এর ডিরেক্টর অনিল শেঠ বলেছেন, “আমি ওঁদের অনেক ধরে নেওয়া জিনিস মানি না, তবে মনে হয়, ওঁরা ঠিক কথা বলেছেন।”

তথ্য প্রসেস করার ক্ষমতা একটা বড় ব্যাপার। ওঁদের পেপার সম্পর্কে ‘নেচার’ জার্নাল গুগল এবং মাইক্রোসফ্ট কোম্পানিকে জিজ্ঞাসা করেছিল। গুগল কোনও উত্তর দেয়নি। আর মাইক্রোসফট-এর উত্তর— ‘আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কাজ করছেন। সুতরাং, চেতনা কাকে বলে, সে সম্পর্কে জানার কোনও আগ্রহ নেই।’

আগেই বলেছি, বিজ্ঞানীদের এখন দু’দলে ভাগ করা যায়। এক দল বলেন, যন্ত্র এক দিন চেতনাসম্পন্ন হবে। অন্য দল বলেন, তা কোনও দিনই হবে না। হবে না— যাঁরা বলেন, তাঁদের গুরু হচ্ছেন নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী রজার পেনরোজ়। ব্ল্যাক হোল ফিজ়িসিস্ট হওয়া সত্ত্বেও যিনি চেতনা বিষয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। আমেরিকায় আরিজ়োনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্নায়ুবিজ্ঞানী স্টুয়ার্ট হ্যামেরফ-এর সঙ্গে যিনি গবেষণা করেন চেতনা বিষয়ে। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে অবস্থিত মাইক্রোটিবিউল যে চেতনার মূলে, সেই বিষয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। ১৯৯৪ সালে পেনরোজ় বই লিখেছিলেন ‘শ্যাডোজ় অব দ্য মাইন্ড: আ সার্চ ফর দ্য মিসিং সায়েন্সেস অব কনশাসনেস’।

অনেক বই লিখেছেন পেনরোজ়। ‘শ্যাডোজ় অব দ্য মাইন্ড’-এর আগে ১৯৮৯ সালে লিখেছিলেন ‘দ্য এমপেরর’স নিউ মাইন্ড: কনসার্নিং কম্পিউটরস, মাইন্ডস অ্যান্ড দ্য লজ় অব ফিজ়িক্স’। ওই বইয়ে চেতনা বিষয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন পেনরোজ়। তাঁর সিদ্ধান্ত, কম্পিউটার কোনও দিন মানুষের মতো চিন্তাশক্তিসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারবে না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ১৯৩১ সালে অস্ট্রিয়ার গণিতজ্ঞ কার্ট গোয়েডেল তাঁর আশ্চর্য তত্ত্ব ‘আনডিসাইডেবল’ আবিষ্কার করেন। গণিতে এমন অনেক জিনিস আছে, যে সব সত্যি না মিথ্যে, তা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যায় না। গণিতকে বলা হয় সত্যের পরাকাষ্ঠা। দুই-এর সঙ্গে দুই যোগ করলে চারই হয়, কখনও ৪.১ বা ৩.৯ হয় না। সেই শাস্ত্রের মধ্যে যে এমন সত্য লুকিয়ে আছে, তা গোয়েডেল-এর আগে কেউ বলেননি। গোয়েডেলকে এই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এমন যুক্তি বিস্তার করতে হয়েছিল, পেনরোজ় লিখলেন, তা একটা কম্পিউটারের পক্ষে করা কোনও দিনই সম্ভব নয়। এক মাত্র গোয়েডেল-ই ভাবতে পেরেছিলেন এমন সত্য।

দেখেশুনে মনে পড়ছে মারভিন মিনস্কি-র কথা। ওঁর নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল ‘ডিসকভার’ পত্রিকায়। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-র এই প্রয়াত অধ্যাপক গবেষণা করতেন এ আই নিয়ে। বিজ্ঞানীদের যে দল বিশ্বাস করেন, কম্পিউটার এক দিন মানুষের মতো চেতনাসম্পন্ন হয়ে উঠবে, তাঁদের গুরু তিনি। ‘ডিসকভার’ তাঁর প্রবন্ধ ছেপেছিল এ আই নিয়েই। চেতনা বলতে কী বোঝায়, তা ওই নিবন্ধে ব্যাখ্যা করেছিলেন মিনস্কি।

এক দিন সন্ধেবেলা তিনি সেটা ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে বাড়ি ফিরে কাগজ পড়ছিলেন। হঠাৎ তাঁর বাচ্চা ছেলে এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, হেডগি মানে কী?”

মিনস্কি উত্তরে বানান করে বললেন, “শব্দটি কি H-E-D-G-E?”

উত্তরে ছেলে বলল, “হ্যাঁ।”

তখন মিনস্কি বললেন, “ওটা হেডগি নয় বাবা, ওটা হেজ। হেজ মানে বেড়া।” তার পর মিনস্কি বাড়ির সীমানার দিকে ছেলেকে দেখিয়ে বললেন, “ওইটা হেজ।”

বাচ্চা ছেলেটি উত্তরে বলল, “ওহ! আই সি।”

মিনস্কি তাঁর নিবন্ধ শেষ করেছিলেন এই ভাবে। যে দিন কম্পিউটরও বলতে পারবে, ‘ওহ! আই সি।’ সে দিন জানব কম্পিউটারের চেতনা এসেছে। তত দিন পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Artificial Intelligence Garry Kasparov chess
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE