রাস্তার খাবারের ভিডিয়ো দেখা এক রকম দেশ-দর্শন। খাদ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে সাক্ষাৎ তো হয়ই, ছোট্ট টেবিলে সাজানো ট্রেগুলো জানান দেয় অনেক কিছু। তাই দেশ-বিদেশের রাস্তার খাবারের ভিডিয়োয় ঝাঁকিদর্শন চলে। সে দিন সুইডেনের রাস্তায় পৌঁছনো গিয়েছিল। ফুড ভ্লগার হিসেবে মার্ক উইয়েন্সের বেশ নাম। বহু দেশ ঘোরেন। সেই ভিডিয়োয় তিনি স্টকহোমে। প্লেট সাজিয়ে বসেছেন। ইউরোপের খাবারের প্লেট যে রকম হয়। আমিষের প্রাধান্য। মার্কের প্লেটে ছিল ডিমসেদ্ধ, সসেজ, কাসুন্দি দেওয়া হেরিং মাছ। স্যালাডের পরিমাণও বেশ। আশ্চর্য লেগেছিল অন্য প্লেট দেখে। তাতে সাজানো ছিল কিছু বীজ। বিদেশি কিছু নয়। খুব চেনা। সূর্যমুখী আর কুমড়োর বীজ। সঙ্গে হ্যাজ়েলনাট। চামচ দিয়ে বেশ সোনামুখ করে খেলেন মার্ক।
কুমড়োর বীজ খাওয়া দেখে ইতিচারণায় হাসি অনিবার্য। এ আনাজ বাংলায় প্রচুর চাষ হয়। কিন্তু আনাজে তৈরি পদের নামকরণে কেমন যেন অশ্রদ্ধা লুকিয়ে। ঘ্যাঁট, ছক্কা, কুমড়োনি— স্বাদে অতুলনীয়, কিন্তু জাতে নয়। তা সত্ত্বেও কুমড়োর বীজে ইতিহাসচারণা বাস্তব। ইহা সত্য। আমরাও যে এক সময়ে খেতাম! ‘যম দত্তের ডায়ারী’ খুলুন। সেখানে লেখা, “আমাদের মুড়ীর আড্ডার চিরস্থায়ী মেম্বার পাঁড়ে বাড়ি থেকে পকেটে কাগজে মুড়িয়া কুমড়া বীজের শাঁস লইয়া আসিত। কুমড়া বীজ রৌদ্রে শুকাইয়া ওপরকার খোসা কুঁটিয়া বাদ দিয়া ভিতরের শাঁস বাহির করা হইত। এই শাঁস বাদামের মতন খাইতে। পাঁড়ের দৌলতেই মুড়ীর সঙ্গে এই শাঁস আমাদের প্রায়ই জুটিত।” যম দত্ত অর্থাৎ যতীন্দ্রমোহন দত্তের জন্ম ১৩০১ বঙ্গাব্দে। ‘পদ্মশ্রী’ প্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ তথা আইনজ্ঞ, সুরসিক লেখকটির জীবনের প্রথম তিন দশক কেটেছে পানিহাটি এলাকায়। পানিহাটিকে এখন কলকাতাই ধরা হয়। যম দত্ত আক্ষেপ করলেও সেই সময়েও পানিহাটি বর্ধিষ্ণু এলাকা ছিল। আর ‘হাটখোলার দত্ত পরিবারের পানিহাটি শাখার সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা ছিল’। সুতরাং একেবারেই গ্রামীণ এলাকায় বা আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারে কুমড়োর বীজ খাওয়ার চল ছিল, তা বলা যায় না।
যম দত্তের সময়ে যাওয়ার দরকার নেই। গত শতকের সত্তর-আশির দশকেই কুমড়ো বীজ হাতে-পাতে পাওয়া যাবে। হাতে মানে শুধু খাওয়া। ওই যম দত্ত বর্ণিত পদ্ধতিতে ভেজে, তবে মুড়িতে মিশিয়ে নয়, বাদাম খাওয়ার মতো করে খেতেন অনেকে। আবার ভেজে খোলা ছাড়ানো এই শাঁস বেটে গরম ভাতেও খাওয়া হত। সুন্দর স্বাদ।
কাঁইদানা খাওয়ার চল আশির দশকের শেষ পর্যন্ত ছিল। তখনও পাড়ার দোকানে নোনতা স্বাদের হাওয়া ভরা প্যাকেট ঝুলতে কয়েক বছর দেরি। ছেলেমেয়েরা এক মুঠো কাঁইদানা নিয়ে মাঠে খেলতে বা পড়তে চলে যেত। মাঝে মাঝে মুখে ফেলে কটরমটর করে চিবোনো। কাঁইদানা আর কিছুই নয়, তেঁতুলের বীজ। তখন প্রায় ঘরেই তেঁতুল। কাঁসা পিতলের ঘটিবাটি, পুজোর বাসনপত্র মাজা বা খাওয়ার জন্য। পাকা তেঁতুলের বীজ বার করে জমিয়ে রাখা হত। এক দিন সেগুলো মুড়ি ভাজার মতো বালিতে ভেজে নিলে চমৎকার ছেলে-মেয়ে ভোলানো মুখরোচক বা ‘টাইম পাস’। তবে তেঁতুল বীজের খোলা শক্ত হওয়ায় শাঁসের স্বাদ পেতে দাঁতের জোর লাগত। এখন কাঁইদানা একটি অবলুপ্ত শব্দ। নতুন শতকের জাতকেরা চিনবেন না।
ইতিহাসচারণা এই জন্যই যে, বাঙালি এক সময়ে ঘরোয়া বীজনির্ভর ছিল বেশ খানিকটা। চালে লতিয়ে উঠছে কুমড়ো। মাচায় শিম। আনাজ হিসেবে খাওয়া চলত। আর বীজও পাতের পদ বৃদ্ধি করত। কুমড়োর মতো শিম বীজও অন্তত দু’রকম ভাবে খেতে জানত বাঙালি। এক, ওই বালিতে ভেজে বাদামের মতো খাওয়া। দ্বিতীয় হল, সেদ্ধ করে নিয়ে শাঁসটা বেটে কাঁচালঙ্কা, সর্ষের তেল, পেঁয়াজ দিয়ে খাওয়া। গরম ভাতে সে বাটা প্রারম্ভিক পদ হিসেবে বেশ ভাল।
শিবঠাকুর বেশ খাদ্যরসিক। তাঁর রসনার কল্যাণে কাঁঠাল বীজ অমরত্ব পেয়েছে। ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’তে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর শিব স্ত্রী গৌরীকে নানা পদ রাঁধার ফরমাশ করেছিলেন। সে ফরমাশে কাঁঠালের বীজের পদ রয়েছে দু’টি। প্রথমে “নটীয়া-কাঁটাল বিচি সার গোটা দশ।/ ফুলবড়ি দিবে তাতে আর আদা-রস।” দ্বিতীয় পদটি হল, “মানের বেসারে দিবে কুমড়ার বড়ি।/ ভাঙ্গিয়া কাঁটাল বিচি দিবে চারি কুড়ি।” কাঁঠাল বীজ শুধু তরকারির উপকরণ ছিল না। আরও নানা ভাবে খাওয়া হত। কেউ খেতেন ধানে সিদ্ধ করে, কেউ মুড়ি ভাজার সময়ে বালিতে ভেজে। কেউ বা পুড়িয়ে।
কিছু বীজ সাধারণ অসুখের টোটকা হিসেবে ব্যবহার হত। যেমন সর্ষে। বাড়ির কারও সর্দি হয়েছে। নাক বন্ধ। মা-ঠাকুমা শিলে কাঁচা পেঁয়াজ, লঙ্কার সঙ্গে সর্ষে বেটে গরম ভাতের পাতে দিয়ে দিলেন। বাটা দিয়ে মাখা এক গ্রাস ভাত গলায় সেঁধোতেই ঝাঁজ যেন ব্রহ্মতালুতে ধাক্কা মারল। খুলে গেল বন্ধ নাক। বিজ্ঞাপিত ক্যাচলাইনের পণ্য ছাড়াই।
বাঙালির বীজ-ভক্তির এ রকম বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু সে ভক্তিরস অনেক আগেই শুকিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, এই বীজে পুষ্টিগুণ ভরপুর। বেশি খেলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রায় নেই, যদি না নির্দিষ্ট কিছু অসুস্থতা থাকে। তবুও এই সব ঘরোয়া খাবারের চল কমেছে। স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রাবল্যের যুগেও। এর নানাবিধ কারণ। মুক্ত অর্থনীতি, বিজ্ঞাপন, বিদেশি খাবার, গতিময় জীবন, যৌথ পরিবারে ভাঙন— অনেক কিছু। খাবার নিয়ে ভেদাভেদও কিছুটা দায়ী হতে পারে। সেটা অবশ্য যাকে বলে ‘তখন’ সেই সময়েও ছিল। ‘যম দত্তের ডায়ারী’তে আছে, “কলিকাতা অঞ্চলের লোক কলাইয়ের ডাল তত পছন্দ করেন না… যাঁহাদের আর্থিক অবস্থা ভাল, বিশেষ করিয়া নূতন বড়লোকেরা কলাইয়ের ডালকে ‘ছোটলোকী খাওয়ার’ মনে করেন।” আবার এই লেখাতেই রয়েছে, বর্ধমান জেলা তথা রাঢ়বাসীদের কলাইয়ের ডালের প্রীতির গীত। সে গীত এ রকম— “শিব লিখেছেন তন্ত্রসারে/ মাংসতুল্য গুণ মাসকলাই ধরে।।/ এমন ডালে যে দোষারোপ করে/ বেঁধে ধোরে তার পাঠাই দ্বীপান্তরে।”
এই যে অনীহা বা খাবারে উচ্চ-নীচ ভাগাভাগি, এ শুধু বাঙালির একচেটিয়া নয়, সারা ভারতের। তাই মিলেটসের (জোয়ার, বাজরা, রাগি) প্রবল পুষ্টিগুণ সত্ত্বেও তা সারা ভারতের আপন হয়নি। আবার ভারতই রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে প্রস্তাব পেশ করে ২০২৩ সালকে ‘মিলেটস বর্ষ’-এর স্বীকৃতি আদায় করে। মিলেটসের খাবার প্রচলনে উদ্যোগী হয় সরকার। সংসদ ভবনের ক্যান্টিনে তৈরি হয় জোয়ারের উপমা, রাগির দোসা, বাজরার খিচুড়ি। মিলেটসের বিস্কুটও এসেছে বাজারে। অথচ গত শতকের ষাটের দশকে মাইলো নিয়ে বেশ রাজনৈতিক ও সামাজিক তাপ-উত্তাপ তৈরি হয়েছিল। অনীহা থেকে তৈরি হয়েছিল ছড়া-ও। মাইলোতেও কিন্তু মিলেটস ছিল।

সুস্বাদু: জলজ উদ্ভিদের বীজ মাখনা। ছবি: উত্তম বিশ্বাস
বিজ্ঞাপন কিন্তু কিছু অপ্রচলিত বীজকে খাবার হিসেবে তুলে আনতে পেরেছে। যেমন, মাখনা। জলজ উদ্ভিদের বীজ। কাঁচা ও ভেজে খাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গের জেলায় চাষ হয়। কিন্তু খাদ্য হিসেবে তেমন প্রচলন ছিল না। মাখনার পুষ্টিগুণের প্রচার কয়েক বছর ধরে চলছে। পুষ্টিগুণের জন্য এখন মাখনা শহরের বাচ্চাদেরও জলখাবারে দেওয়া হয়।
লক্ষণীয়, ঐতিহ্যের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া কিছু বীজ কিন্তু বাঙালির খাদ্যতালিকায় টিকে গিয়েছে। পরিসর সীমিত হলেও। যেমন, ভ্যাটের খই, কুসুম বীজ। মালদহ জেলার ইংরেজ বাজারে কার্তিক পুজোর মেলায় ভ্যাটের খই বিক্রি হওয়া রীতি। শালুক বা শাপলার বীজ থেকে তৈরি হয় এই খই।
আর কুসুম তো বিভূতিভূষণীয়। ‘আরণ্যক’-এ মঞ্চী কুসুম ফুল কাটছিল। কুসুম ফুলের পাপড়ির গুঁড়ো লেগে তার হাত আর শাড়ির সামনের দিকটা রাঙা হয়ে গিয়েছিল। বীরভূম আর বর্ধমানে হলুদ মুড়ির সঙ্গে কুসুম ফুলের বীজ ভেজে খাওয়ার রীতি আছে। বীরভূমে সারা বছরই খাওয়া হয়। বর্ধমানে পৌষ-পার্বণের সময়েও খাওয়া হয়। তবে চল কমেছে। পিছনে সেই একই ধরনের কারণ। আমরা খাদ্যাভ্যাসেও বিস্মৃতিপ্রবণ।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)