Advertisement
E-Paper

চোপ! পিতৃতন্ত্র চলছে

মাসে তিন-চার দিন ঠাকুরঘরে যাওয়া বন্ধ। বিছানায় শোওয়া বারণ। সবাই বলে, তুমি অশুচি। ছাত্রছাত্রীরা গত বছর এ নিয়ে নাটক বেঁধেছিল। এ বার অজ্ঞাত কারণে তা নাকচ করে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।মাসে তিন-চার দিন ঠাকুরঘরে যাওয়া বন্ধ। বিছানায় শোওয়া বারণ। সবাই বলে, তুমি অশুচি। ছাত্রছাত্রীরা গত বছর এ নিয়ে নাটক বেঁধেছিল। এ বার অজ্ঞাত কারণে তা নাকচ করে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
সাহসিনী: নাটকের মহড়ায় নিমগ্ন মেয়েরা। ছবি: মৈনাক বিশ্বাস

সাহসিনী: নাটকের মহড়ায় নিমগ্ন মেয়েরা। ছবি: মৈনাক বিশ্বাস

আমরা একটা নাটক করতে চাই দিদি, ৮ মার্চ এর প্রোগ্রামের জন্য,’’ সদ্য তরুণীদের দলটির কথা শুনে মধ্যবয়সি অধ্যাপিকা-দিদিমণির দিন-শেষের ক্লান্তি কেটে-যায়। গত চার বছর ধরে সহপাঠীদের সঙ্গে মিলে এই বি এ-এম এ ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করছে, গতানুগতিক ধাঁচার বাইরে— অনেকটাই এই দিদিমণির উৎসাহে এবং উদ্দীপনায়। এ বারে তারা ঠিক করেছে, শরীর এবং‌ বড় হয়ে ওঠা, এই বিষয় নিয়ে করবে অনুষ্ঠান। তিনি বলেন, “বাহ্‌, খুব ভাল, কার লেখা নাটক?” মেয়েরা একটু ইতস্তত ভাবে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে। অতঃপর অল্পবয়সিরা যাকে দলনেত্রী বলে মেনেছে, তাদের থেকে দু’বছরের বড় সেই ছোট-চুল, ছোট্টখাট্টো ‘ফেমিনিস্ট দিদি’ গালে টোল ফেলে হাসে, “এই নাটকটা এখনও কেউ লেখেনি, তাই আমরাই এর স্ক্রিপ্ট লিখব।” তার পর হেঁয়ালির জবাবের সুরে বলে “মানে পিরিয়ডস নিয়ে নাটক।” দিদিমণি চমৎকৃত হয়ে যান। পিরিয়ডস অথবা মাসিক, মেন্সট্রুয়েশন বা মেয়েলি ঋতু, যে নামই বলি না কেন, আঠাশ বা তিরিশ দিনের মাথায়, যে রক্তস্রাবকে ঘিরে আছে সামাজিক গোপনীয়তার ঘেরাটোপ, তাকে নিয়ে নাটক!

আলোচনা বা লেখালিখিও যাকে নিয়ে কঠিন, তাকে নিয়ে নাটক? দিদিমণি নতুন চোখে দেখেন পিতৃতন্ত্রের নিঃশব্দ নির্দেশ যারা ভাঙতে চাইছে সেই দুঃসাহসীদের। ভাবেন, এদেরই বোধহয় প্রকৃত বীরাঙ্গনা বলা চলে। বলেন “বেশ, তা হলে কী ভেবেছ সেটা শুনি।” তরুণীরা সমস্বরে বলে, “হ্যাঁ, আলোচনা হবে লাল চা আর কমিউনিটি মুড়ি-মাখা সহযোগে।” অতএব ফেব্রুয়ারি মাসের মোলায়েম কমলা অপরাহ্ণে দিদিমণি এবং ছাত্রীরা লাল ধুলো উড়িয়ে হাঁটতে থাকে। দমকা বাতাসে বাদামি–হলুদ ঝরা পাতারা ওড়ে। আটকে যায় ওদের চুলে, বাসন্তি রঙের ওড়নায় আর সবুজ-বেগুনি ছোট টপে।

প্রায় প্রতিদিন বিকেল সন্ধেয় নাটকের খসড়া নিয়ে চলে মহড়া। কুশীলবদের কথোপকথন থেকেই ধীরে ধীরে নাটক রূপ পায়। তা জুড়ে থাকে সদ্য তরুণীদের বয়ঃসন্ধিতে ঋতুমতী হওয়ার স্মৃতি। দিদিমণি ক্রমশ বুঝতে পারেন, এরা অনেকেই এসেছে প্রত্যন্ত গ্রাম এবং দরিদ্র পরিবার থেকে। সেই জন্যই তারা অনায়াসে বলতে পারে প্রান্তবাসী মুন্নি, রুবিনা, জেসমিনদের জীবনের গল্প, যাদের কাছে যত কম দামিই হোক, প্যাকেটবন্দি ফুল-ছাপ সুগন্ধী স্যানিটারি ন্যাপকিন সাধ্যে কুলোয় না। বিশেষ করে যদি পরিবারে দু-তিনটি মেয়ে থাকে। তাই নাটকে সৃষ্টি হয় এমন একটি মায়ের চরিত্র, যে মনে করে তার স্কুলপড়ুয়া মেয়েটি স্যানিটারি ন্যাপকিনের বায়না করছে ফ্যাশনের জন্য। সংসারের ঘানি টেনে তিরিক্ষি মেজাজের এই মা-মেয়ের কথোপকথনের একটি টুকরো লিখে বেজায় খুশি হয় নাট্যকারেরা। ‘‘কী দারুণ ঝাঁজ আছে ওদের ডায়ালগে, বলুন দিদি?’’ অতঃপর রাখতে হয় মুন্নি বা রুবিনার বরাদ্দ সেই পুরনো, নরম কাপড়ের ফালির ঘরোয়া সিস্টেমের কথা। কেমন ভাবে করতে হয় সেই ন্যাকড়ার ভাঁজ, কী ভাবে গোপনে কেচে মেলে দিতে হয় লোক থুড়ি পুরুষচক্ষুর আড়ালে, সেই কথাই বলে সবচেয়ে সপ্রতিভ একটি তরুণী, সমবেত দলটির মধ্যে দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে।

এরই সূত্র ধরে আসে ঋতুমতী মেয়েদের নিষেধাজ্ঞার লিস্টি। ঠাকুর-দেবতার কাছ না মাড়ানো, চুলে শ্যাম্পু না করা মায় খাটে না শুতে পারা পর্যন্ত। দিদিমণি দেখেন কী মুনশিয়ানায় এরা বুনে ফেলে ঋতুস্রাবকে ঘিরে কুসংস্কারের জাল, যা কিনা পিতৃতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থেকে যাওয়া, কন্যার প্রতি ঘৃণার এক নির্মম চেহারা। কোনও পাঠ ছাড়াই এই তরুণীরা এনে ফেলে (বিশেষ করে অনুন্নত অর্থনীতিতে) প্রজনন-স্বাস্থ্য প্রসঙ্গ, যা কিনা হিউম্যান রাইটস প্রোগ্রামের অঙ্গাঙ্গি। শুধু ব্যক্তিগত নয়, বিভিন্ন সামাজিক অবস্থা ও অবস্থান থেকে আসা সমবয়েসিদের অভিজ্ঞতা মিশে ধীরে ধীরে তৈরি হয় একটি ‘পারফরমেন্স স্ক্রিপ্ট’।

আরও পড়ুন: প্রেমের পাহারাদার

মুন্নি, রুবিনা, জেসমিনদের কাহিনি মুছে গিয়েছে টেলিভিশনে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপনের দাপটে, যেখানে সম্পন্ন পরিবারের দায়িত্বশীল মা তার ঋতুমতী কন্যার বিষয়ে চিন্তিত হয়ে এনে দেন সেই আশ্চর্য লিক-প্রুফ প্যাড, যা পরে মেয়েটি পরীক্ষা দেওয়া তো বটেই, টেনিস খেলা বা হাইজাম্পও প্র্যাকটিস করতে পারে অনায়াসে। এই ধরনের বিজ্ঞাপনের তুখড় ব্যঙ্গ, সমালোচনা করে এক তরুণী, হিন্দি-ইংরিজি বুকনির মিশেলে। বলে, গিলাপন গিয়েছে তো বুঝলাম কিন্তু পিরিয়ড পেন এর কী হবে? তার পর তার বান্ধবীরা মনে করিয়ে দেয়, কী অসম্ভব কষ্টের মধ্যে কাটে ঋতুস্রাবের তিন কী পাঁচ দিন। তলপেট মুচড়ে ওঠা সেই যন্ত্রণার উপশম করতে পারে কোন কোম্পানি? হ্যাঁ, তাদের দিদি, বোন, সহপাঠিনী বা বান্ধবীদের যে খুব কষ্ট হয় সেই কথা তারা জানে— বলে এই নাটকে অংশগ্রহণকারী অল্পবয়সি তরুণরা! তাদের প্রথমে টিটকিরি-দেওয়া, পাড়ার ডেঁপো ছেলের ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল বলে মর্মাহত হয়ে নালিশ করেছিল তারা দিদিমণিকে। বলেছিল, এ তো অন্যায়, আমরা তো প্রয়োজনে ব্যথা কমানোর ওষুধ আর স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে এনেছি, সাইকেলে চাপিয়ে হস্টেলে পৌঁছেও দিয়েছি। মেয়েদের হ্যারাস করা মোটেও আমাদের আমোদের মধ্যে পড়ে না। অতঃপর তারা নিজেরাই সংলাপ লিখেছে, নাটকের মধ্যেই বলেছে এই সব কথা। কে বলে, পুরুষরা নারীবাদী হয় না?

৮ মার্চ বিকেলে সতেজ, সপ্রতিভ এই প্রজন্মের নাটক দেখে গর্বে ভরে ওঠে দিদিমণি। দেখে, কী সাবলীল ভাবে নাটকের উপস্থাপনা করে কথক ঠাকরুন মেয়েটি, একটি মোড়ায় বসে। সে যখন উঠে যায়, তার কামিজের ঘের থেকে ঝুলতে থাকে লাল-কমলা ফিতে। তারা রেপ্রিজেন্টেশনের মূল কথাটি বুঝে গিয়েছে, তাই তাদের নাটকের শেষে এই কথক ঠাকরুনকেই তারা জড়িয়ে ফেলে ফুল-ছাপ, লাভ-লাভ লেখা রুমালে, যে রুমালটি চুরি করে মুন্নি, রুবিনা বা জেসমিন ব্যবহার করতে চেয়েছিল তাদের ঋতুকালে।

এই ট্র্যাজিক গল্পটির মধ্যে দর্শককে শামিল করে, এই অল্পবয়েসিরা একটা অন্য রক্তের দাগের গল্প বলতে চেয়েছিল, যে কাহিনি পিতৃতন্ত্রের সন্তানের বৈধতা প্রমাণের পিতৃরক্তের দাগের বিপ্রতীপ। বলতে চেয়েছিল, কী অনায়াস দ্বিচারিতা এই সমাজব্যবস্থায়! যেখানে মাতৃত্বকে নিয়ে আনন্দ উৎসব হয়, কিন্তু তার প্রক্রিয়ায় যে নারীরক্তের অবিরল ক্ষরণ চলে, সেই দাগকে মুছে দিতে, সেই রক্তস্রাবকে নোংরা, অশুচি বলে তকমা দেওয়াও চলে অনায়াসে।

বস্তুত এই নাটকটিকে ঠিক এই কারণে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে বলে জনশ্রুতি! এক বছরেরও বেশি সময় পরে এই সংবাদে হতবাক হয়ে গিয়েছে দিদিমণি এবং এই নাটকের কুশীলবরা। এই নাটক দেখে নাকি লজ্জায়, সংকোচে মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে কিছু দর্শকের। যেন তা একটি কেলেঙ্কারি, একটি বিশ্রী নোংরা ঘটনা। হ্যাঁ, এই একুশ শতকেও! এই প্রতিক্রিয়ার পিছনে মনের কতখানি অন্ধকার থাকে, পিতৃতন্ত্রের মতাদর্শে কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে-থাকা থাকে, অবচেতনে কতটা অবমাননা ও ঘৃণা থাকে, সে বিষয়ে কোনও খতিয়ান নেওয়া হবে না কখনও।

তবে কি তারা হেরে গেল একেবারে? না কি এই প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আপাদমস্তক নাড়িয়ে দিতে পারার সংকেত? প্রশ্নগুলো ঘুরতে থাকে দমকা বাতাসে বাদামি-হলুদ ঝরা পাতার ঘূর্ণির সঙ্গে। বসন্ত কি এসে গিয়েছে?

Theatre Menstruation Students Banned Patriarchy Periods
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy