জনতা সোলার এটিএম। ছবি সৌজন্যে: এন বি ইনস্টিটিউট ফর রুরাল টেকনোলজি।
পিন নম্বর লাগবে না। তাই তা কষ্ট করে মনে রাখার দরকারও হবে না। লাগবে না এটিএম কার্ডও। ফলে, যত্ন করে সেই কার্ড রাখারও প্রয়োজন হবে না। শুধু আঙুলের ছাপ দিয়েই এ বার এটিএম থেকে আপনি টাকা তুলে নিতে পারবেন। সেই এটিএম চালাতে লাগবে না বিদ্যুৎশক্তিও। ফলে, যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি বা সারা দিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টা থাকে বিদ্যুৎ, সেখানে এই এটিএম চালানো যাবে অনায়াসেই। সৌরশক্তিতে। তার নাম- ‘জনতা সোলার এটিএম’।
কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের আর্থিক সহায়তায় এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে কলকাতারই এক গবেষকদল। যার নেতৃত্বে রয়েছেন সৌরবিজ্ঞানী শান্তিপদ গণচৌধুরী। যিনি কলকাতার এন বি ইনস্টিটিউট ফর রুরাল টেকনোলজি (এনবিআইআরটি)-র অধিকর্তা। সহযোগী গবেষকদের মধ্যে রয়েছেন ঋচিক ঘোষ ঠাকুর ও প্রযুক্তিবিদ জিনিয়া হক। গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ’ (আইজেএসইআর)-এ।
ইতিমধ্যেই কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্ক যোগাযোগ করেছে গবেষকদের সঙ্গে। ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি গ্রামে সৌরশক্তিতে চলা এই এটিএম চালু করে দিতে পারে কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্ক।
প্রায় ২০ বছর হয়ে গেল এটিএম চালু হয়েছে দেশে। কিন্তু তা দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এখনও ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তার কারণ মূলত দু’টি। এক, গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র বৈদ্যুতিকরণ এখনও সম্ভব হয়নি। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে বলে খাতায়-কলমে দেখানো হলেও, সেখানে দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিদ্যুৎ থাকে না গড়ে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা। ফলে, বিদ্যুৎশক্তিতে চলা এটিএম বসানো সম্ভব হয়নি গ্রামে গ্রামে। তার ফলে, দেশের ৬ লক্ষ ৩৪ হাজার গ্রামে এখনকার এটিএম ব্যবস্থাকে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। দুই, সাক্ষরতার অভাব। যার ফলে, এটিএম থেকে টাকা তোলার জন্য যে প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তা গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয় না। দেশে এখন এটিএমের সংখ্যা ২ লক্ষ ৫ হাজার ১৫১টি। অথচ মাত্র ১০ শতাংশ গ্রামে এখনকার এটিএম বসানো সম্ভব হয়েছে।
সৌরশক্তিতে চলা এটিএম সেই অসুবিধা দূর করবে কী ভাবে?
মূল গবেষক বিশিষ্ট সৌরবিজ্ঞানী শান্তিপদ গণচৌধুরী ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে জানিয়েছেন, এই জনতা সোলার এটিএম যেহেতু চালানো হবে সৌরশক্তিতে, তাই বিদ্যুৎশক্তির সাশ্রয় তো হবেই, কোনও এলাকায় বিদ্যুৎ না পৌঁছলেও, সেখানে সৌরশক্তিতে চলা এই এটিএমকে পৌঁছে দেওয়া যাবে।
আরও পড়ুন- কালান্তক হয়ে উঠছে গ্রামের বিষ ধোঁয়া, রাজ্যে বাড়ছে ক্যানসার, মৃত্যুও
আরও পড়ুন- জল থেকে ক্যানসারের বিষ তাড়ানোর পথ দেখালেন বাঙালি
গবেষকরা দেখেছেন, ‘স্ট্যান্ডবাই মোড’-এ থাকার সময় (যখন এটিএমের স্ক্রিনে আলো ফুটবে না) বড়জোর ৪০ ওয়াট সৌরশক্তি খরচ হবে। আর টাকা তোলার সময় খরচ হবে, খুব বেশি হলে, ১৫০ ওয়াট। মানে, একটি কম্পিউটার চালাতে যতটা বিদ্যুৎশক্তি লাগে, তার দ্বিগুণেরও কম।
দ্বিতীয় সুবিধা, সৌরশক্তিতে চলা এই এটিএম থেকে টাকা তোলার পদ্ধতিটিও হবে খুব সহজ। যা নিরক্ষর বা প্রবীণদের পক্ষেও মোটেই অসুবিধার হবে না। কারণ, এখনকার এটিএম থেকে টাকা তোলার জন্য যেমন আমাদের ব্যাঙ্কের দেওয়া গোপনীয় পিন নম্বরটি মনে রাখতে হয় আর তা যাতে কেউ জানতে না পারেন, তার জন্য সব সময় সতর্ক থাকতে হয়, সৌরশক্তিতে চলা ওই এটিএমে টাকা তোলার জন্য তার দরকার হবে না। তার বদলে থাকবে একটি স্টিকার, যা মোবাইলের গায়েও লাগিয়ে রাখা যাবে।
যে পথে সৌরশক্তি পৌঁছবে জনতা সোলার এটিএমে
অথবা থাকবে একটি টোকেন। যা পকেটে, মানিব্যাগে রাখতে অসুবিধা হবে না। হারিয়ে গেলেও চট করে বিকল্প টোকেন মিলবে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক থেকে। কিন্তু সেই স্টিকার বা টোকেন কোনও কারণে আপনি যদি হারিয়ে ফেলেন, এমনকী, তা পৌঁছে যায় অন্য কারও হাতে, সেটাও বিপদের কারণ হবে না। কারণ, সেই স্টিকার বা টোকেন নিয়েও কেউ জনতা সোলার এটিএমে আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিতে পারবেন না। যেহেতু টাকা তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আঙুলের ছাপটা (বায়োমেট্রিক) মিলতে হবে। যে ছাপটা রয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের রেকর্ডে। আঙুলের সেই ছাপ না মিললে, টাকা বেরিয়ে আসার ‘অর্ডার’ আসবে না জনতা সোলার এটিএমের ভিতরে থাকা মাইক্রোপ্রসেসর থেকে।
যে ভাবে চলবে জনতা সোলার এটিএম, দেখুন ভিডিয়ো
কী কী থাকবে জনতা সোলার এটিএমে?
অন্যতম গবেষক ঋচিক ঘোষ ঠাকুর জানাচ্ছেন, থাকবে একটি সোলার প্যানেল। আর এটিএমের ভিতরে থাকবে বিশেষ ভাবে বানানো একটি সিপিইউ বা মাইক্রোপ্রসেসর। যার মধ্যে থাকবে ক্যামেরা-সহ বিভিন্ন অংশ। থাকবে সোলার পিভি, মাইক্রোপ্রসেসর, মাইক্রোকন্ট্রোলার, অন্যান্য ইনপুট, সার্ভার, স্পিকার, ক্যাশ ডিসপেন্সার, সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, টাচ স্ক্রিন ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট মডিউল।
চালু এটিএমের সঙ্গে তফাত কোথায় সোলার এটিএমের?
ঋচিকের কথায়, ‘‘সবচেয়ে বড় তফাতটা হল, বিদ্যুৎশক্তির প্রয়োজন হবে না। ফলে, যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি, সেখানেও এই এটিএম বসানো যাবে। আর এখনকার এটিএম চালাতে দিনে গড়ে যে পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তির প্রয়োজন হয়, এই জনতা সোলার এটিএমে সৌরশক্তির খরচ হবে তার অনেক কম।’’
এখনকার একটি এটিএম বানানোর গড় খরচ ৬ লক্ষ টাকা। এটিএম কার্ড বানাতে গড় খরচ হয় ১০ টাকা। এই খরচ সোলার এটিএমে হবে না। এটিএম কার্ডে প্লাস্টিক থাকে গড়ে ৫ গ্রাম। সোলার এটিএমে সেই প্লাস্টিক ব্যবহারেরও প্রয়োজন হবে না। একটি এটিএম চালাতে এখন দিনে গড়ে বিদ্যুৎশক্তি লাগে ৫.৫২ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এখনকার এটিএমে বিদ্যুৎশক্তি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা নেই। কিন্তু কোনও কাজ না করলে সৌরবিদ্যুৎ সঞ্চয় করা যাবে জনতা সোলার এটিএমে। তা ছাড়াও, টাকা তোলার সময় সৌরবিদ্যুৎ লাগবে বড়জোর ১৫০ ওয়াট। স্থানীয় ভাষা ব্যবহার করা যাবে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট থাকলে দু’জনেই আঙুলের ছাপ দিয়ে টাকা তুলতে পারবেন।
সোলার এটিএমের নিরাপত্তা কতটা নিশ্ছিদ্র হবে?
জিনিয়া হক (বাঁ দিক থেকে), ঋচিক ঘোষ ঠাকুর ও শান্তিপদ গণচৌধুরী
অন্যতম গবেষক জিনিয়া হক বলেছেন, ‘‘আমার এমন ভাবে ব্যাক-আপ প্রোগ্রামিং করেছি, যাতে কোনও আগন্তুকেরও ছবি তুলে রাখা যায়, তাঁর অজান্তে। কারণ, সেই ক্যামেরা থাকবে এটিএমের মধ্যেই। ফলে, যাঁর অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তিনি ছাড়া অন্য কেউ টাকা তুলতে এলে তাঁর ছবি তুলে নেবে সেই গোপন ক্যামেরা। এমনকী, কারও টোকেন বা স্টিকার চুরি করে কেউ সোলার এটিএম থেকে টাকা তোলার চেষ্টা করলেও টাকা তুলতে পারবে না। কারণ, টাকা তোলার জন্য তার আঙুলের ছাপ ব্যাঙ্কের রেকর্ডের সঙ্গে মিলতে হবে। ফলে, নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্রই হবে জনতা সোলার এটিএমের।’’
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: এন বি ইনস্টিটিউট ফর রুরাল টেকলোনজি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy