Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Diego Maradona

নায়ক, ফুটবলের ব্যাড বয়... সব বিতর্ক পেরিয়ে মারাদোনা শুধুই এক কিংবদন্তি

এক নজরে দেখে নেওয়া উল্কার গতিতে পেরনো ৬০টা বছর।

মাত্র ১৮ বছর বয়সেই দক্ষিণ আমেরিকার সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছিলেন মারাদোনা।

মাত্র ১৮ বছর বয়সেই দক্ষিণ আমেরিকার সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছিলেন মারাদোনা।

ঋত্বিক দাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২০ ০২:৪৪
Share: Save:

দিয়েগো মারাদোনা একটা আবেগের নাম। কিংবদন্তি, নায়ক, ফুটবলের ব্যাড বয়... কোনও একটা সংজ্ঞায় বাঁধা যেত না সাড়ে ৫ ফুট উচ্চতার মানুষটাকে। এক নজরে দেখে নেওয়া উল্কার গতিতে পেরনো ৬০টা বছর।

শুরুর দিনগুলো

৩০ অক্টোবর ১৯৬০। আর্জেন্টিনার বুয়েনাস আইরেস প্রদেশের লানুসের গোঁড়া ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনার। আট ভাইবোনের পরিবারে তিনি ছিলেন পঞ্চম। বাবা কাজ করতেন কারখানায়। পরিবারে অভাব ছিল যথেষ্টই।

ছোট্ট ছেলেটার ফুটবল স্কিল ছিল তাক লাগানোর মতো। ফুটবল স্কাউটদের নজর কাড়তে দেরি হয়নি। দিয়েগোর বয়স তখন ১০, বুয়েনাস আইরেসের বিখ্যাত ক্লাব আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স তাঁকে সই করিয়ে ফেলল। বয়স ১৬ পূর্ণ হওয়ার আগেই ক্লাবের সিনিয়র দলের দরজা খুলে গেল তাঁর সামনে। সিনিয়র দলে দিয়েগোর প্রথম মরসুম, সে বারেই স্থানীয় লিগে চ্যাম্পিয়ন হল ক্লাব। ঈশ্বর প্রদত্ত দক্ষতায় মাঠে তখন ফুট ফোটাচ্ছেন দিয়েগো, ডাক নাম হয়ে গেল ‘ফিওরিতো’ মানে ফুলের মতো সুন্দর।

আরও পড়ুন: মৃত্যুর তারিখটা পর্যন্ত মিলিয়ে দিল দুই বন্ধু ফিদেল-দিয়েগোকে

নীল-সাদা জার্সি

২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭, দেশের ইতিহাসে কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে সুযোগ পেলেন দিয়েগো। নীল-সাদা জার্সি, ‘অ্যালবিসেলেস্তে’-র হয়ে ডেবিউ ম্যাচ হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে। বয়স তখন ১৬ বছর ১২০ দিন। ৫-১ গোলে সেই ম্যাচ জেতে আর্জেন্টিনা। পরের বছর বিশ্বকাপের আসর বসল আর্জেন্টিনায়। কিন্তু জাতীয় কোচ লুই মেনত্তি তাঁকে দলে নিলেন না। কারণ মারাদোনা বয়সে ছোট, অভিজ্ঞতাও কম। নেদারল্যান্ডসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথম বার বিশ্বজয় করল আর্জেন্টিনা। ফাইনালে জোড়া গোল করে জাতীয় নায়ক মারিও কেম্পেস। মাঠের বাইরে থেকেই দেশের বিশ্বজয় দেখতে হল মারাদোনাকে।

বড়দের বিশ্বকাপে জায়গা হয়নি। পরের বছর মারাদোনার নেতৃত্বেই জাপানে অনুষ্ঠিত যুব বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্টিনা। বিশ্ব ফুটবলে আগমন হল ফুটবলের রাজপুত্রের। সে বছরই সিনিয়র দলের হয়ে প্রথম গোল করলেন মারাদোনা। স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে সেই ম্যাচ জিতল। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই দক্ষিণ আমেরিকার সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হলেন মারাদোনা।

আরও পড়ুন: আমার হেড আর হ্যান্ড অব গডেই গোল, বলেছিলেন মারাদোনা

ইউরোপে আগমন

১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপের দলে সুযোগ এল। ভালই খেলছিলেন। কিন্তু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিরুদ্ধেই ছন্দপতন। লালকার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হল মারাদোনাকে। আর্জেন্টিনাও সেই ম্যাচে ৩-১ গোলে হেরে ছিটকে গেল টুর্নামেন্ট থেকে। কিন্তু মারাদোনার ফুটবল তত দিনে দক্ষিণ আমেরিকার গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপে পৌঁছে গেছে। প্রায় ১১ লক্ষ পাউন্ডে তাঁকে সই করাল বার্সেলোনা। ক্লাবের ফুটবল ম্যানেজার সেই লুইস মেনত্তি। বার্সেলোনায় দু’টো মরসুম খেললেও সে ভাবে দাগ কাটতে পারলেন না মারাদনো।

পরের মরসুমে রেকর্ড ৪০ লক্ষ পাউন্ড দিয়ে তাঁকে সই করাল ইতালির ক্লাব নাপোলি। প্রায় একার দক্ষতায় এসি মিলান, ইন্টার, জুভেন্টাসের মতো বড় বড় ক্লাবকে পিছনে ফেলে নাপোলিকে ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন করলেন মারাদোনা।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

হ্যান্ড অব গড

মারাদানোর ফর্ম তখন তুঙ্গে। মাঝ মাঠ চিরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাঁর বাঁ-পা। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ বসল মেক্সিকোতে। শতাব্দীর সব চেয়ে নিন্দিত এবং প্রশংসিত দু’টি গোলই সে বার করলেন মারাদোনা। এবং একই ম্যাচে। বছর চারেক আগেই ফকল্যান্ড যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছে আর্জেন্টিনা। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালে যেন সেই যুদ্ধের উত্তাপ। পিটার শিল্টনের মাথার উপর দিয়ে গোল করে দলকে এগিয়ে দিলেন মারাদোনা। সবাই বলল হ্যান্ড বল, মারাদোনা হেসে বললেন ‘হ্যান্ড অব গড’। পরের গোলটা যেন ম্যাজিকের মতো। ৫ জন ইংরেজ খেলোয়াড়কে কাটিয়ে রাজপুত্র গোল করলেন। শতাব্দীর সেরা গোলের স্বীকৃতি পেল সেই গোল। ফাইনালে ৩-২ গোলে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্টিনা। মারাদোনা পেলেন সোনার বুট। হয়ে উঠলেন ফুটবল কিংবদন্তি।

আরও পড়ুন: একই ম্যাচে নিন্দিত ও প্রশংসিত, ফুটবলার হিসাবে যতটা সফল কোচিংয়ে ততটাই ব্যর্থ রাজপুত্র

নায়ক থেকে খলনায়ক?

বিশ্বজয়ের পর নাপোলিকেও তিনি পরের পর ট্রফি জেতাচ্ছেন। নেপলস শহরের কাছে তিনি তখন ঈশ্বরসম। কিন্তু উশৃঙ্খল জীবন তত দিন গ্রাস করতে শুরু করেছে তাঁকে। মারাদোনা কি মাদক নিচ্ছেন? উঠল প্রশ্ন। গ্রহণ লাগছে তাঁর ফুটবলেও। ব্যক্তিগত জীবনেও বিতর্ক। বিয়ে করেছেন ক্লদিয়া ভিলাফেনকে, এরই মধ্যে ক্রিস্টানা সিনাগ্রা মামলা করে দাবি করলেন তাঁরা সন্তানের বাবা মারাদোনাই। ১৯৯০ বিশ্বকাপেও ফাইনালে গেল আর্জেন্টিনা। প্রতিপক্ষ সেই পশ্চিম জার্মানি। কিন্তু ইতালি থেকে রানার্স হয়েই ফিরতে হল মারাদোনার দলকে। গোটা টুর্নামেনেটে চেনা ফর্মের ধারেকাছেও দেখা গেল না মারাদোনাকে। যে ইতালিতে ফুটবল খেলতে খেলতে তিনি বিশ্বসেরা হয়েছিলেন, সেই ইতালিতেই তিনি এ বার নিন্দিত, ধিকৃত। ডোপ পরীক্ষায় ধরা পড়লেন। ইতালির ফুটবলে ১৫ মাসের নির্বাসন হল। ইতালি ছাড়লেন মারাদোনা। দেশে ফিরে গ্রেফতার হলেন কোকেন নেওযয়ার অপরাধে। দু’বছর ফুটবল খেলা হল না। ১৯৯২ সালে আবার স্পেনের সেভিয়াতে যোগ দিলেন মারাদোনা। কোচ ১৯৮৬ এবং ১৯৯০ বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তোলা কার্লোস বিলার্দো। কিন্তু এ বার আর ক্লিক করল না সেই জুটি। ২৬ ম্যাচে ৫ গোল করে সেভিয়া ছাড়লেন মারাদোনা। ফিরে এলেন আর্জেন্টিনায়।

‘ভাল খেলোয়াড় মানেই ভাল কোচ নয়’। মারাদোনার ক্ষেত্রে এই প্রবাদ বাক্যটা ধ্র‌ুব সত্যি।

খেলা শেষে

মারাদোনা তখন চোট আঘাতে জেরবার। খেলছেন আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের নিউওয়েলস ওল্ড বয়েস ক্লাবে। বিশ্বকাপে প্রাথমিক দলে তাঁর জায়গা হল না। শেষমেশ বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে আর্জেন্টিনা যখন খাদের কিনারে, তখন তাঁর ডাক পড়ল। ১৯৯৪ সালের আমেরিকা বিশ্বকাপের খেলতে নামলেন মারাদোনা। তবে তখন তিনি অতীতের ছায়া মাত্র। গ্রিসের বিরুদ্ধে ৪-০ গোলে জিতল আর্জেন্টিনা। গোল করলেন মারাদোনাও। আস্ফালন করলেন টিভি ক্যামেরার সামনে এসে। সেটাই হয়ে থাকল দেশের জার্সিতে তাঁর শেষ ম্যাচ। নিষিদ্ধ ড্রাগ এফেড্রিন নেওয়ায় বিশ্বকাপ থেকে তাঁকে ফেরত পাঠানো হল। লিগ পর্যায় হেরে ফিরল আর্জেন্টিনাও। ফিফা মারাদোনাকে ১৫ মাসের নির্বাসনে পাঠাল। দেশের হয়ে ১০০টা ম্যাচ খেলা হল না মারাদোনার। আন্তর্জাতিক কেরিয়ার শেষ হল ৯১ ম্যাচে ৩৪ গোল নিয়ে। ১৯৯৭ সালে বোকা জুনিয়র্সের হয়ে খেলতে খেলতে ৩৭ বছর বয়সে ফুটবলকে বিদায় জানালেন মারাদোনা। রেকর্ড বইয়ে তাঁর নামের পাশে লেখা থাকল ৬৭৮ ম্যাচে ৩৪৫টা গোল। পরে কোচ হয়ে মারাদোনা ফিরলেন বটে, কিন্তু ওই যে কথায় আছে, ‘ভাল খেলোয়াড় মানেই ভাল কোচ নয়’। মারাদোনার ক্ষেত্রে যে এই প্রবাদ বাক্যটা ধ্রুব সত্যি। ২০১০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলোয়াড় জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বী যুরগেন ক্লিন্সম্যানের জার্মানির কাছে হারল কোচ মারাদোনার আর্জেন্টিনা।

পেলে না মারাদোনা?

বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে? নতুন শতকের শুরুতে ২০০০ সালের পেলের সঙ্গে যৌথ ভাবে শতাব্দীর সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হলেন দিয়েগো মারাদোনা। সে বছরই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হতে হল হাসপাতাল। অত্যধিক মাদক সেবনই অসুখের কারণ, জানালেন চিকিৎসকরা। সেই হৃদরোগ আর পিছু ছাড়েনি। ২০ বছর পর ২৬ নভেম্বর সেই হৃদরোগই থামিয়ে দিল মারাদোনার হৃদস্পন্দন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE