Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Ishan Porel

‘ব্যাটসম্যানদের নিয়ে বেশি ভাবলে নিজের বোলিং নিয়ে ভাবার সময় কম পড়ে যাবে’

সেমিফাইনালে কর্নাটকের তারকা ব্যাটসম্যানদের বাড়তি সমীহ করার সরণিতে একেবারেই নেই ঈশান। বরং নিজেকে নিয়েই ভাবছেন তিনি। চেষ্টা করছেন, মাঠে নামার আগে নিজেকে যতটা সম্ভব শাণিত করে তুলতে।

কর্নাটকের বিরুদ্ধে ইডেনে রঞ্জি সেমিফাইনালে এই মেজাজেই ঈশানকে দেখতে চাইছে বাংলা শিবির। —ফাইল ছবি।

কর্নাটকের বিরুদ্ধে ইডেনে রঞ্জি সেমিফাইনালে এই মেজাজেই ঈশানকে দেখতে চাইছে বাংলা শিবির। —ফাইল ছবি।

সৌরাংশু দেবনাথ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১১:২৮
Share: Save:

নাম নয়, এমনকি ব্যাটসম্যানও নয়। ঈশান পোড়েলের মন্ত্র একটাই। নিজের কাজটা ঠিকঠাক করা। উন্নতির রাস্তায় থাকা। এর পর বাকিটা তো আর হাতে নেই!

শনিবার থেকে ইডেনে রঞ্জি সেমিফাইনাল। কর্নাটক দলে হেভিওয়েট সব নাম। লোকেশ রাহুল থেকে মণীশ পাণ্ডে, করুণ নায়ার। এই মরসুমে রঞ্জিতে পাঁচশোর বেশি রান করে ফেলেছেন দেবদূত পাদিকাল, রবিকুমার সমর্থ। এহেন শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপের বিরুদ্ধে ঘাসের পিচে বাংলার প্রধান ভরসা চন্দননগরের ২১ বছর বয়সি পেসার।

স্বয়ং ঈশান অবশ্য উল্টোদিকের তারকা ব্যাটসম্যানদের বাড়তি সমীহ করার সরণিতে একেবারেই নেই। বরং নিজেকে নিয়েই ভাবছেন তিনি। চেষ্টা করছেন, মাঠে নামার আগে নিজেকে যতটা সম্ভব শাণিত করে তুলতে। আনন্দবাজার ডিজিটালকে তিনি সাফ বললেন, “বড় লেভেলে খেলতে হলে ভাল আন্তর্জাতিক ব্যাটসম্যানদেরই বল করতে হবে, তাদেরই আউট করতে হবে। এদের জন্য চিন্তা করে সময় নষ্ট করলে নিজের বোলিং নিয়ে ভাবার সময় কম পড়ে যাবে। আখেরে, নিজেরই ক্ষতি হবে। তাই কী করলে নিজে মানসিক ভাবে ভাল জায়গায় থাকব, সেটাই ভাবছি। কী করে ভাল জিম করব, ভাল ট্রেনিং করব, এগুলোই মাথায় ঘুরছে।”

তার মানে এমন নয় যে হোমওয়ার্কে ঘাটতি পড়ছে। বিপক্ষকে কাটাছেঁড়া করে শক্তি-দুর্বলতা মেপে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। থাকছে, স্ট্র্যাটেজি ঠিকঠাক করার পালাও। ঈশান বললেন, “সব ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধেই পরিকল্পনা থাকে। রাহুলের বিরুদ্ধেও থাকবে। শুধু রাহুল কেন, মণীশ পাণ্ডে-করুণ নায়ারও রয়েছে। কে কোন স্ট্রোক ভাল খেলে, কার কোথায় শক্তি, কে কোন সাইডে বেশি মারে— এ সব নিয়ে পরিকল্পনা তো হয়ই। আমরা ভিডিয়ো দেখে এগুলো ঠিক করি। তবে আলাদা ভাবে কোনও প্ল্যান নেই। কাউকে বাড়তি গুরুত্বও দিচ্ছি না।”

চলতি মরসুমে রঞ্জিতে ১৫ উইকেট নিয়েছেন ঈশান। গড় রীতিমতো ভাল, ১৮.২০। পাঁচ ইনিংসে হাত ঘুরিয়েছেন ১০৮.৩ ওভার। এর মধ্যেই নিউজিল্যান্ডে ‘এ’ দলের হয়ে লিস্ট এ ক্রিকেটে তিন ম্যাচে নিয়েছেন আট উইকেট। ক্রাইস্টচার্চে বেসরকারি টেস্টে নেন দুই উইকেট। দেশে ফিরে এসে কটকে রঞ্জির কোয়ার্টার ফাইনালে সদ্য ওড়িশার বিরুদ্ধে নেন তিন উইকেট। নিজের বোলিং নিয়ে খুশি ঈশান। বললেন, “আমি ভাল ছন্দে রয়েছি। সব কিছু ভাল হচ্ছে। যে পরিশ্রম করেছিলাম, তার ফল পাচ্ছি। যদিও জানি, আরও পরিশ্রম করতে হবে। এটা সবে শুরু।”

ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে দাঁড়িয়ে কেরিয়ারের সামনে তিনটি স্টেশন দেখছেন ঈশান। একটা অবশ্যই রঞ্জি ট্রফি। দ্বিতীয়টা ইরানি কাপ। আর তৃতীয়টা আইপিএল। একসঙ্গে সবগুলোয় ফোকাস রাখতে চাইছেন না। ধাপে ধাপে এগিয়ে চলাই প্রাধান্য পাচ্ছে। আর তাই সবচেয়ে কাছের লক্ষ্য হিসেবে মন দিচ্ছেন রঞ্জি সেমিফাইনালে। বললেন, “আমি দেখছি সামনে কতগুলো সুযোগ রয়েছে। রঞ্জি ট্রফি জিততে হলে দুটো ম্যাচ পাব। তার পর ইরানি। আর শেষে আইপিএল। আমার চোখের সামনে এগুলোই এখন থাকছে। তবে আইপিএল নিয়ে এই মুহূর্তে কমই ভাবছি। ওটা এখনও কিছুটা দেরি আছে। একদম সামনে রঞ্জি সেমিফাইনাল। তাই সেটাতেই নজর দিচ্ছি।”

আরও পড়ুন: ‘ইডেনে কর্নাটকের বিরুদ্ধে শেষ সেমিফাইনালে কিন্তু ১৫১ করে জিতিয়েছিলাম’

আরও পড়ুন: হোয়াইটওয়াশ ঠেকাতে কি দলে বদল? দেখে নিন ক্রাইস্টচার্চে ভারতের সম্ভাব্য একাদশ​

যে কোনও পরিবেশেই অভিমন্যু ঈশ্বরনের বাংলাকে এই মরসুমে অপ্রতিরোধ্য দেখিয়েছে। ঘূর্ণি পিচ হোক বা সবুজ উইকেট, কন্ডিশন উপযোগী ক্রিকেটার রয়েছে বাংলা ড্রেসিংরুমে। কিন্তু কন্ডিশনের বিরুদ্ধে খেলা এক জিনিস। আর ঘরের মাঠে প্রত্যাশার চাপ সামলানো অন্য জিনিস। বাংলা কি পারবে ক্রিকেটপ্রেমীদের স্বপ্নকে সত্যি করে ফাইনালে উঠতে? ঈশানকে নির্বিকার শোনাল, “কন্ডিশনের কথায় আসি। আমরা ইডেনে তিন-চারটে ম্যাচ খেলেছি এ বারে। তার মধ্যে আমি অবশ্য সব ম্যাচ খেলিনি। বাইরে ছিলাম। তবে ইডেনে দুটো ম্যাচ খেলেছি। জানি, ডিসেম্বরের তাজা উইকেট এখন ফেব্রুয়ারির শেষে, মার্চের শুরুতে পাব না। দুটো উইকেট এক হতে পারে না। আগে উইকেট যত জীবন্ত পেয়েছিলাম, এখন তত পাব না। তাই সবুজ উইকেট বাড়তি উৎসাহে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ার প্রশ্নই নেই। আমরা জানি, কাজটা কী করতে হবে। সেটাই করার চেষ্টা থাকবে। পরিকল্পনাটা প্রয়োগ করতে হবে বাইশ গজে। আলাদা করে তাই ভাবছি না।”

কিন্তু চাপ তো থাকছেই। ময়দান জুড়ে সাড়া পড়ে গিয়েছে। তিন দশক আগে শেষ বার বাংলা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল রঞ্জি। সেই দলের অন্যতম স্থপতি অরুণলাল এখন কোচ। সেই দলের স্পিনার উৎপল চট্টোপাধ্যায় স্পিন পরামর্শদাতার দায়িত্বে। ফাইনালে না খেললেও দলের অন্যতম সদস্য স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় এখন সিএবি সচিব। ফাইনালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এখন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট। ক্রিকেটমহল জুড়ে চলছে এমন সব মিল খোঁজার পালা। ইডেনে প্রবেশ অবাধ করে দেওয়া হয়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য। এই আবহই কি চাপ আমদানি করছে না? ঈশান সোজাসুজি বললেন, “আমরা চাপ নিয়ে কিছুই ভাবছি না। যদি এগুলো নিয়ে ভাবি, তা হলে মুশকিল। আর রঞ্জির সেমিফাইনাল আমার কাছে একেবারেই চাপের নয়। আমি অনেক সেমিফাইনাল, ফাইনাল খেলেছি। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনাল জিতেছি। দিন কয়েক আগেই অনূর্ধ্ব-২৩ ফাইনাল জিতলাম বাংলার হয়ে। তাই আবহ নিয়ে কিছু ভাববই না। যদি মনে করি যে আমরা রঞ্জি ট্রফির সেমিফাইনাল খেলতে নামছি, তা হলে চাপ ডেকে আনা হবে। বরং, এটা নিছক আরও একটা ম্যাচ ভাবলে ব্যাপারটা সহজ হবে।”

বাংলার বোলিং আক্রমণ প্রশংসা কেড়েছে ক্রিকেটমহলের। ঈশান তো আছেনই, আকাশদীপ, মুকেশ কুমার, নীলকন্ঠ দাসরা নিয়মিত উইকেট নিচ্ছেন। বাঁ-হাতি স্পিনার শাহবাজ আহমেদও সফল। অশোক ডিন্ডার অভাব অনুভূতই হচ্ছে না। ঈশান বললেন, “আমরা একে অপরের সাফল্য উপভোগ করি এবং করছিও। এমন মোটেই হচ্ছে না যে অন্য কেউ উইকেট পেলে আর নিজে না পেলে খারাপ লাগছে। আবার, আমি উইকেট পেলেও বাকিরা কিছু ভাবছে না। দিনের শেষে ম্যাচ জিতলে আমরা সবাই আর একটা ম্যাচ পাব। তখন সবাই পারফর্ম করার সুযোগ পাব। এটাই সকলের মাথায় থাকছে। আমাদের সামনে একটা লক্ষ্য রয়েছে। সেটাতেই সকলে ফোকাস করছি। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স নিয়ে বেশি ভাবছি না। আর ম্যাচ জিতলে সবাই সবাইকে সাহায্য করতে পারছি। নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ দিচ্ছি অন্যকেও। তাই একজোট হয়ে আমরা বল করছি। আর আমরা হ্যাপি যে দল জিতছে। এ ভাবেই খেলতে চাই। আলাদা করে কে কেমন করছে, কে বেশি বল করছে, কে কম বল করছে, কে উপরে নামছে, কে নীচে নামছে, এমন ভাবনা দলে নেই। কোথায় খেলছি, কার হয়ে খেলছি, সেটাই মাথায় থাকছে সবার।”

অর্থাৎ, টিম স্পিরিটের পতাকা উড়ছে দলে। বাংলার সাফল্যের যা বড় কারণ। দলকে একজোট রাখায় নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। এর মধ্যেই যেমন কোচ অরুণলাল সবার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। খুব ভাল সময় কেটেছে, নির্দ্বিধায় জানালেন ঈশান।

ফুরফুরে মেজাজের মধ্যেই আসছে লড়াকু মেজাজ। শিরায় শিরায় ফুটছে নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার তাগিদ। ঈশান বললেন, “নিজে যাতে স্বচ্ছন্দ থাকি, ম্যাচের আগে সে ভাবেই থাকতে চাইছি। অন্যদের নিয়ে ভাবতে চাইছি না একেবারেই। সেটা করলে নিজের ১০ শতাংশ দক্ষতা কমিয়ে ফেলব বলেই মনে করি। অন্য ব্যাটসম্যানদের নিয়ে বেশি ভেবে করবই বা কী। মাঠে নামলে তো এটা ব্যাট আর বলেরই খেলা। কোন মানুষ ব্যাট করছে সেটা দেখে লাভ নেই আমার। আমার কাজ ভাল বল করা। সামনে যেই ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থাকুক না কেন।”

ব্যাটসম্যান নন, তিনি দেখছেন স্টাম্প। ব্যাটসম্যানের মুখ নয়, মাথায় ঘুরছে তাঁকে ফেরানোর স্ট্র্যাটেজি। ঈশান জানেন, সেরাদের আউট করাই এগিয়ে যাওয়ার সহজ পাঠ!

গ্রাফিক: সৌভিক দেবনাথ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE