আলোচনা: ম্যাচের ফাঁকে যুবরাজ ও অরুণ। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
স্বপ্নভঙ্গ। গত ২৮ বছর ধরে এই দিন বারবার ফিরে এসেছে বাংলা ক্রিকেটে। বৃহস্পতিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সল্টলেক ক্যাম্পাসের মাঠে আবারও যা ফিরে এল— বঙ্গ ক্রিকেটে ব্যর্থতার কালো দিন। রঞ্জি ট্রফির শেষ আটের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল মনোজ তিওয়ারির দলের। পঞ্জাবের বিরুদ্ধে ম্যাচ ড্র হওয়ায় ফের রঞ্জি ট্রফি থেকে ছিটকে গেল বাংলা।
স্বাধীনতার পরে প্রথম বার রঞ্জি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলা ১৯৮৯-’৯০ মরসুমে। সেই মরসুমে বাংলার প্রধান ব্যাটসম্যান ছিলেন অরুণ লাল। ঘটনাচক্রে মনোজ তিওয়ারির দলের মেন্টর এখন তিনিই। তবুও ‘ফাইটার-লালের’ হার-না-মানা মানসিকতা গোটা মরসুমে বাংলার ক্রিকেটারদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল না। খুঁজে পেলেন না অরুণ নিজেও। ব্যর্থতার দিনে বাংলা ক্রিকেটের ময়নাতদন্ত করতে বসে বৃহস্পতিবার রাতে ক্ষুব্ধ অরুণ ফোনে বলেন, ‘‘কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার কোনও যোগ্যতাই নেই এই দলটার। যাদের ব্যাটসম্যানেরা সবাই মিলে আটটি ম্যাচে ছটির বেশি সেঞ্চুরি পায় না, প্রধান স্পিনারের ছয় ম্যাচে সংগ্রহ সাকুল্যে ৯ উইকেট। যারা ম্যাচ জু়ড়ে পাঁচ-পাঁচটা ক্যাচ ফেলে, তারা কোন যোগ্যতায় বাংলার হয়ে খেলে?’’
এ মরসুমে বাংলার অন্যতম প্রধান ব্যাটসম্যান সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের হাফসেঞ্চুরি মাত্র দু’টি। ওপেনার অভিষেক রামনের আট ম্যাচে রান ৪৫৩। তিনটি হাফসেঞ্চুরি অনুষ্টুপ মজুমদারের। ঋত্বিক চট্টোপাধ্যায়ের সংগ্রহ মাত্র একটি হাফসেঞ্চুরি। যা পরিষ্কার তুলে ধরছে ধারাবাহিকতার অভাবের ছবিটা। ব্যতিক্রম শুধু অভিমন্যু ঈশ্বরন। চলতি মরসুমে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ছয় ম্যাচে ৮৬১ রান। গড় ৯৫.৬৭। বৃহস্পতিবারও বাংলার বিপদের দিনে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান এল এই ডান হাতি ওপেনারের ব্যাটে। ৩৭৩ বলে তিনি অপরাজিত থাকলেন ২০১ রানে। পাশাপাশি মনোজ তিওয়ারির ১০৫ রানের সাহায্যে হারের লজ্জা থেকে মুক্তি পেল বাংলা।
কিন্তু কেন এই বিপর্যয়? অরুণের সাফ উত্তর, ‘‘এই দলের না আছে ফিটনেস, না আছে মানসিকতা, না আছে ধৈর্য, না আছে নিজেদের উপর আস্থা। জেতার জন্য যা, যা প্রয়োজন, তার কোনওটাই নেই। নিজেদের ভুল বোঝার ন্যূনতম বোধটুকু নেই ক্রিকেটারদের। তা হলে কী করে তারা নিজেদের ভুল শুধরোবে? কেউ ঠিক মতো প্র্যাক্টিসই করতে জানে না। শুধু হারের পরে অজুহাত দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে।’’
বৃহস্পতিবার ম্যাচের শেষ দিনেও দু’টি সহজ ক্যাচ ফস্কান রামন ও ঋত্বিক। যা হারের আশঙ্কা ফিরিয়ে এনেছিল বঙ্গ শিবিরে। ১৬ ওভারে ১৭৩ রানের লক্ষ্যে পঞ্জাব ব্যাট করতে নেমে ৯ ওভারেই ১০২ রানে তুলে দেয়। ২৮ বলে ৫৮ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলে বাংলা শিবিরে কম্পন ধরিয়ে দিয়েছিলেন বিপক্ষ পেসার মনপ্রীত গোনি। ৪৩ রানের মাথায় তাঁর ক্যাচ ফেলেই বিপদ ডেকে আনেন ঋত্বিক। শেষে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ১৩২ রান করে ম্যাচ ছাড়ে পঞ্জাব।
শেষ দিনেও বাংলার এই পারফম্যান্স দেখে নিজের মেজাজ ধরে রাখতে পারেননি অরুণ। ড্রেসিংরুমে ক্রিকেটারদের কড়া বার্তায় জানিয়ে দেন, এটাই তাঁদের শেষ সুযোগ। ‘‘ম্যাচের পরে টিম মিটিংয়ে সবাইকে বলে দিয়েছি, এটাই হয়তো তোমাদের একসঙ্গে বাংলার হয়ে শেষ ম্যাচ। যা মজা করার এখনই করে নাও। পারফর্ম না করলে কোনও ভাবেই দলে জায়গা হবে না,’’ বলে দেন অরুণ। সঙ্গো তিনি আরও যোগ করেন, ‘‘ওদের পিছনে এখনও ১০০টি ছেলে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলা দলে সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষায়। তারা কী দোষ করেছে? দলের বর্তমান ক্রিকেটারেরা স্থানীয় লিগে দুই হাজারের উপর রান করুক। নিজেদের ফিল্ডিং শোধরাক। তার পরে দেখা যাবে।’’
স্কোরকার্ড
বাংলা ১৮৭ ও ৪৩২-৬ ডি.
পঞ্জাব ৪৪৭ ও ১৩২-৫ (১৫ ওভার)
বাংলা ( আগের দিনের ২১৮-২ এর পর দ্বিতীয় ইনিংস)
অভিমন্যু ঈশ্বরন ন. আ ২০১
মনোজ তিওয়ারি বো বিনয় ১০৫
অনুষ্টুপ ক জীবনজ্যোৎ বো মার্কণ্ডে ৯
ঋত্বিক ক মনদীপ বো মার্কণ্ডে ৪৮
শ্রীবৎস স্টাঃ খেরা বো মার্কণ্ডে ৩২
প্রদীপ্ত প্রামাণিক ন. আ ৪
অতিরিক্ত ৮
মোট ৪৩২-৬ ডি.
পতন: ৩-২৬০ (মনোজ, ৭১.৩), ৪-২৭৩ (অনুষ্টুপ, ৭৬.৫), ৫-৩৫৯ (ঋত্বিক, ১১১.২), ৬-৪২৫ (শ্রীবৎস, ১২৮.৬)।
বোলিং: মনপ্রীত গোনি ১৯-৪-৪৩-১, বিনয় চৌধরি ৪৬-৬-১৩৫-১, সিদ্ধার্থ কল ২০-১-৮১-১, মায়াঙ্ক মার্কণ্ডে ৩৩-৪-১২৩-৩, যুবরাজ সিংহ ৭-০-২৫-০, গুরকীরত সিংহ ৪-০-১৮-০, শুভমন গিল ১-০-৪-০।
পঞ্জাব ( দ্বিতীয় ইনিংস, টার্গেট ১৭৩ রান)
আনমোলপ্রীত ক অনুষ্টুপ বো মুকেশ ৬
শুভমন গিল বো ডিন্ডা ৮
মনপ্রীত গোনি বো প্রদীপ্ত ৫৮
যুবরাজ সিংহ রান আউট ১২
মনদীপ সিংহ রান আউট ৩৫
গুরকীরত সিংহ ন. আ ৬
গীতাংশ খেরা ন. আ ১
অতিরিক্ত ৬
মোট ১৩২-৫
পতন: ১-১৩ (শুভমন, ২.২), ২-২৫ (আনমোলপ্রীত, ৩.১), ৩-৩৮ (যুবরাজ, ৪.৫), ৪-১২২ (গোনি, ১২.৩), ৫-১২৬ (মনদীপ, ১২.৬)।
বোলিং: অশোক ডিন্ডা ৭-০-৬২-১, মুকেশ কুমার ৩-০-৩৩-১, প্রদীপ্ত প্রামাণিক ৫-০-৩৩-১।
দলের এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একটিই উপায় দেখছেন মেন্টর— কঠোর পরিশ্রম ও নিজের ভুল বোঝার ক্ষমতা। তিনি বলেছেন, ‘‘এই মরসুম থেকে আমার দলের একটিই প্রাপ্তি। বোঝা গিয়েছে বাকি রাজ্যগুলো থেকে কতটা পিছিয়ে আমরা। পরিকাঠামোর কোনও গলদ নেই আমাদের। তবুও ক্রিকেটার উঠে আসছে না। আমরাই সুযোগ দিচ্ছি না। অনূর্ধ্ব-২৩, অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে যারা ভাল খেলছে তাদের সুযোগ দিয়ে কেন দেখা হচ্ছে না। সুযোগ দিলে কী হবে, খুব বেশি হলে হারব। এখনও কী এমন জিতছি!’’ স্পষ্টতই বিরক্ত শোনায় বাংলার মেন্টরকে।
এ দিকে বাংলার হারের দিনই তোপ দাগলেন অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারি। হারের ময়নাতদন্ত করতে বলা হলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন সিএবি প্রশাসনকে। মনোজ বলেন, ‘‘আমি শুধুমাত্র বাংলার অধিনায়ক। আমি ভিশন ২০২০ প্রকল্পেও নেই। নির্বাচনী কমিটিতেও নেই। তা হলে কী করে উন্নতির পথ দেখাতে সাহায্য করব! ক্লাব ক্রিকেটে মরসুমের শেষ পর্যন্ত আমি খেলি। কোন ক্রিকেটারের কী ক্ষমতা সেটা ভাল বুঝতে পারি। আমিও চাইব এ ধরনের কমিটিতে আমাকে জায়গা দেওয়া হোক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy