টসের পরেই অজিঙ্ক রাহানে জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাকি পাঁচটি ম্যাচের সব ক’টি জিততে হবে তাঁদের। তাই বেশি দূরে না তাকিয়ে একটি করে ম্যাচ ধরে এগোচ্ছেন। প্রথম লড়াইয়ে সফল হলেন রাহানে। সফল হল তাঁর পরিকল্পনা। আগের ম্যাচগুলিতে তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, মুখস্থ করে এসেছেন। সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তবে দিল্লি ক্যাপিটালসের বিরুদ্ধে এক অন্য রাহানেকে দেখা গেল। যিনি দল নির্বাচন থেকে শুরু করে বোলিং পরিবর্তন, সবেতেই চমক দিলেন। রাহানে বদলে যাওয়ায় বদলে গেল কলকাতা নাইট রাইডার্সও। দিল্লির মাঠে তাদের ১৪ রানে হারাল কলকাতা। এখনও প্লে-অফের লড়াইয়ে রয়ে গেল গত বারের আইপিএল চ্যাম্পিয়নেরা।
সুনীল নারাইনের উপর খুব ভরসা করে কেকেআর। সেই শুরুর দিন থেকে। এত বছরেও যে সেই ভরসা কেন একটুও কমেনি তার প্রমাণ এই ম্যাচে দিলেন তিনি। নারাইন কবে কী করবেন বোধহয় তিনি নিজেও জানেন না। তবে যে দিন করবেন, সে দিন কলকাতা জিতবে। দিল্লির বিরুদ্ধে ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং, তিন ক্ষেত্রেই নারাইন সফল। ব্যাট হাতে করলেন ২৭ রান। ফর্মে থাকা লোকেশ রাহুলকে সরাসরি থ্রোয়ে ফেরালেন। রাহুল থাকলে কলকাতার জেতা মুশকিল ছিল। পরে ভয়ঙ্কর দেখানো অক্ষর পটেল ও ফাফ ডু’প্লেসিকে ফেরালেন তিনি। আউট করলেন ট্রিস্টান স্টাবসকেও। তাঁর দু’টি ওভার খেলা ঘুরিয়ে দিল। আবার রাহানে চোট পেয়ে উঠে যাওয়ায় শেষ কয়েকটি ওভারে নারাইনই অধিনায়কত্ব করলেন কলকাতার। তাঁর বোলিং পরিবর্তনও নজর কাড়ল। আরও এক বার একার কাঁধে কেকেআরকে বৈতরণি পার করালেন সেই নারাইনই।
এ বার কেকেআর ব্যাট করার সময় অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। শুরুটা ভাল হলে শেষটা ভাল করতে পারছেন না ব্যাটারেরা। আবার কোনও ম্যাচে শেষটা ভাল করার চেষ্টা করলেও শুরুতেই গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। দিল্লির বিরুদ্ধে প্রথমটা হল। রহমানুল্লা গুরবাজ় ও নারাইন শুরুটা ভাল করেছিলেন। একের পর এক বড় শট মারছিলেন তাঁরা। ভাগ্যও কিছুটা সঙ্গ দিচ্ছিল তাঁদের। ব্যাটের কানায় লেগে দু’-একটি বল পিছন দিকে বাউন্ডারিতে গেল। তবে দুই ব্যাটারের খেলার ধরনটাই তেমন। ব্যাট চালান তাঁরা। এই ম্যাচে সেটা কাজে লাগছিল। গুরবাজ় আউট হলেও তিন নম্বরে নেমে রাহানে রান তোলার গতি বজায় রাখেন। পাওয়ার প্লে-তে ৬ ওভারে ৭৯ রান উঠল।
পাওয়ার প্লে দেখে মনে হচ্ছিল, অন্তত ২২৫-২৩০ রান হওয়া উচিত। তার একটা কারণ দিল্লির ছোট মাঠ। উইকেটেও বোলারদের জন্য কিছু ছিল না। পাটা উইকেটে বড় শট মারা সহজ ছিল। কিন্তু সেখানেও নির্দিষ্ট সময় অন্তর উইকেট হারাল কেকেআর। পাওয়ার প্লে-র পরেই আউট হলেন নারাইন। তার কয়েক ওভার পর রাহানের উইকেট বড় ধাক্কা দিল কলকাতাকে। এ বার দলের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটার তিনি। এই ম্যাচেও দ্রুত রান তুলছিলেন। সেই তিনিই অক্ষর পটেলের একটু বল বুঝতে না পেরে ফিরে গেলেন। আরও একটি ম্যাচে হতাশ করলেন বেঙ্কটেশ আয়ার। গত বারের ছায়া তিনি। মাত্র একটি ম্যাচে ভাল ব্যাট করেছিলেন। বাকি সব ম্যাচে খারাপ খেলেছেন। এই ম্যাচেও দলকে সমস্যায় ফেললেন। তিনি প্রতি ম্যাচে ব্যর্থ হওয়ায় সমস্যায় পড়ছে কলকাতার মিডল অর্ডার। এই ম্যাচেও তা-ই হল।
প্রথম ১০ ওভারে ১১৭ রান করেছিল কেকেআর। সাধারণ হিসাব বলে, পরের ১০ ওভারে আরও বেশি রান হওয়া উচিত। কিন্তু কেকেআরের মিডল অর্ডারে রান তোলার মতো ব্যাটার কোথায়? একাই অঙ্গকৃশ রঘুবংশী রান করলেন। তাঁকে সঙ্গ দিতে পারলেন না কেউ। রিঙ্কু সিংহ কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনিও এ বার আগের মতো খেলতে পারছেন না। প্রতিটি দলের সিনিয়র ক্রিকেটারেরা দলকে দায়িত্ব নিয়ে টানছেন। বেঙ্গালুরুতে বিরাট কোহলি, মুম্বইয়ে রোহিত শর্মা, সূর্যকুমার যাদবেরা যে কাজটা করছেন, কলকাতায় সেটা করার লোক কই? বার বার আন্দ্রে রাসেলের উপর ভরসা করছে কেকেআর। এই ম্যাচে একটি ছক্কা হয়তো মেরেছেন, কিন্তু শেষটা করতে পারলেন কোথায়? সুযোগ পেয়েছিলেন রভম্যান পাওয়েল। তিনিও ব্যর্থ।
অথচ কেকেআরকে কিছুটা হলেও সুবিধা করে দিয়েছিলেন দিল্লির অধিনায়ক অক্ষর। কুলদীপ যাদবের মতো বোলারের চার ওভার শেষ করালেন না। মুকেশ কুমার মাত্র দু’ওভার বল করলেন। তার পরেও কেকেআরের ইনিংস শেষ হল ২০৪ রানে। মিচেল স্টার্ক ৩ উইকেট নিলেন। আইপিএলের ইতিহাস বলে, কলকাতা ছেড়ে যাওয়া ক্রিকেটারেরা পরবর্তীকালে কলকাতাকে হারিয়েছেন। ক্রিস গেল, সূর্যকুমার থেকে কুলদীপ, তালিকাটা ছোট নয়। সেই তালিকায় যুক্ত হলেন স্টার্ক। শেষ ওভারে আর একটু হলে হ্যাটট্রিক করতে পারতেন তিনি।
আরও পড়ুন:
২০৪ রান করে জেতার জন্য বোলিংয়ের শুরুটা ভাল করতে হত কেকেআরকে। সেটাই করল তারা। ফর্মে থাকা অভিষেক পোড়েল, করুণ নায়ার রান পাননি। রান আউট হয়ে যান রাহুলও। দেখে মনে হচ্ছিল, হয়তো এই ম্যাচ নিজের হাতে নেবে কলকাতা। কিন্তু ডু’প্লেসি এই ম্যাচটাই বেছে নিয়েছিলেন ফর্মে ফেরার জন্য। পুরনো ছন্দে দেখা গেল তাঁকে। উইকেট পড়লেও বড় শট মারা থামাননি তিনি।
অধিনায়কের ইনিংস কাকে বলে তা দেখালেন অক্ষর। ফিল্ডিং করার সময় চোট পেয়েছিলেন তিনি। বল করতে গিয়ে কেটেছিল তাঁর বাঁ হাতের আঙুল। ঠিকমতো গ্লাভস পরতে পারছিলেন না। সেই পরিস্থিতিতেই তিনি খেললেন। শুধু খেললেন না, দলকে ভাল জায়গায় নিয়ে গেলেন। একটি করে বড় শট মারছিলেন আর যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন অক্ষর। তবু শট মারা থামাননি। কেকেআরের দুই সেরা অস্ত্র বরুণ চক্রবর্তী ও নারাইনের বিরুদ্ধে হাত খুললেন অক্ষর। তিনি জানতেন, কেকেআরকে হারাতে হলে এই দুই বোলারকে থিতু হতে দেওয়া যাবে না। সেই কাজে অনেকটাই সফল তিনি।
তবে শেষ করতে পারলেন না অক্ষর। ভাল খেলেও মোক্ষম সময়ে আউট হয়ে গেলেন। খেলা শেষ করা শিক্ষা এখনও বাকি তাঁর। যখন দেখে মনে হচ্ছিল খেলা কেকেআরের হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে ঠিক তখনই জ্বলে উঠলেন নারাইন। তাঁর দু’ওভার খেলার ছবিটা বদলে দিল। প্রথমে অক্ষর ও স্টাবসকে এক ওভারে ফেরালেন তিনি। পরের ওভারে আউট করলেন অর্ধশতরান করে খেলা ডু’প্লেসি। এই তিন ধাক্কা দিল্লিকে খেলা থেকে দূরে নিয়ে চলে গেল। ১৮তম ওভারের জন্য বরুণকে রেখে দিয়ে নারাইন প্রমাণ করে দিলেন, তিনি অধিনায়কত্বও ভাল করেন। সেই ওভারেই দিল্লির শেষ ভরসা আশুতোষ শর্মাকে আউট করলেন বরুণ। এই ম্যাচে কোনও কিছু বাদ রাখলেন না নারাইন। তাঁর দাপটে আইপিএলে টিকে থাকল কেকেআর।