কলকাতা ময়দানে ম্যাচ গড়াপেটা কাণ্ডে ধৃতের সংখ্যা বেড়ে তিন। মঙ্গলবার সন্ধেয় বনগাঁ থেকে সুজয় ভৌমিককে গ্রেফতার করেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। বাংলার ফুটবল নিয়ামক সংস্থা আইএফএ-র অভিযোগের ভিত্তিতে গত রবিবার বেলঘরিয়া থেকে খিদিরপুর ক্লাবের ম্যানেজার আকাশ দাশ এবং ব্যারাকপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল মিডিয়া ম্যানেজার রাহুল সাহাকে। দুই ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই সুজয়ের নাম পান তদন্তকারীরা। আকাশ এবং রাহুল গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশে পালানোর পরিকল্পনা করেছিল অভিযুক্ত। কিন্তু সীমান্ত পেরোনোর আগেই গ্রেফতার করা হয় সুজয়কে।
ম্যাচ গড়াপেটা কাণ্ডে এখনও পর্যন্ত তিন জন গ্রেফতার হলেও এই অপরাধের শিকড় বাংলা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, দিল্লি, মণিপুর, মিজ়োরামেও। আকাশের নেতৃত্বে কলকাতা ময়দানে ম্যাচ গড়াপেটা কী ভাবে হত তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে। ভারতে বেটিং বেআইনি। কিন্তু অন্যান্য অনেক দেশেই তা বৈধ। বিদেশে থেকে কেউ ভারতে নিজেদের প্রতিনিধি ‘এজেন্ট’ নিয়োগ করে। তাদের মাধ্যমেই ম্যাচ গড়াপেটা করা হয়। কী ভাবে? কলকাতা ময়দানের এক কর্তা বলছিলেন, ‘‘ধরা যাক কলকাতা লিগের প্রিমিয়ার ডিভিশনে ক বনাম খ-এর ম্যাচ রয়েছে। বিদেশ থেকে কেউ বাজি ধরল ‘ক’ দল ৪-০ গোলে জিতবে। এর পরে সেই ব্যক্তি কলকাতার এজেন্টকে দায়িত্ব দেয়, ম্যাচের ফল যেন তার অনুকূলে যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। নির্দেশ পাওয়ার পরে সেই এজেন্ট সেই ম্যাচের এক বা দু’দিন আগে ‘খ’ ক্লাবের গোলরক্ষক ও স্টপারের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রস্তাব দেয়, চার গোল খেলে পাঁচ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে।’’ যোগ করলেন, ‘‘বিদেশ থেকে যে ব্যক্তি এক লক্ষ টাকার বাজি ধরছে, তার হিসেব হচ্ছে এক টাকার বিনিময়ে ১০ টাকা পাওয়া। ‘ক’ দল ৪-০ জিতলে সেই ব্যক্তি ১০ গুণ অর্থ অর্থাৎ, ১০ লক্ষ টাকা পাবে। এর মধ্যে ৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হল সংশ্লিষ্ট গোলরক্ষক ও স্টপারকে। বাকিটা অর্থ যে বাজি ধরেছে তার লাভ।’’
ময়দানের ক্লাবগুলিকে কী ভাবে বেটিং এজেন্টরা নিয়ন্ত্রণ করত সেই কাহিনিও চমকে দেওয়ার মতো। বেটিং এজেন্টরা প্রথমে ক্লাবের কর্তা, কর্মী ও ফুটবলারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলত। বিপদে-আপদে তাঁদের সাহায্য করত। বড় ক্লাবে খেলার সুযোগ করে দেওয়ার স্বপ্ন দেখাত। কয়েক জন ফুটবলারকে তা করেও দেওয়া হত বিশ্বাস অর্জন করার জন্য। তার পরে লক্ষ্য থাকত কোনও একটি ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। এ ভাবেই আকাশ খিদিরপুর দলের ম্যানেজার হয়েছিল। তার প্রধান শাকরেদ ছিল রাহুল। বুধবার গ্রেফতার হওয়া সুজয় ছিল ফুটবলারদের এজেন্ট। অর্থাৎ, ফুটবলারদের জন্য ক্লাব খুঁজে দেওয়াই ছিল প্রধান কাজ।
আকাশের ব্যাপ্তি অবশ্য খিদিরপুর ক্লাবেই সীমাবদ্ধ ছিল না। অভিযোগ আই লিগের দুই ক্লাব মণিপুরে নেরোকা এবং ট্রাউয়েরও দল গঠন করত আকাশ। এছাড়া বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের পাশাপাশি দিল্লি এবং মিজ়োরামেও নাকি ক্লাব রয়েছে। ফলে প্রতিবেশী দেশ এবং ভিন রাজ্যেও ম্যাচ গড়াপেটার জাল বিস্তারকরেছিল আকাশ।
কলকাতা লিগে যে ম্যাচ গড়াপেটা হচ্ছে কবে জানতে পেরেছিলেন? আইএফএ সচিব অনির্বাণ দত্ত বললেন, ‘‘আইএফএ-র নিজস্ব এবং সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের ইন্টিগ্রিটি এজেন্সি রয়েছে। তারাই আমাদের জানিয়েছিল, কলকাতা লিগে মূলত প্রিমিয়ার ভিডিশনে ব্যাপক হারে ম্যাচ গড়াপেটা হচ্ছে। এর পরেই আমরা পুলিশে অভিযোগ জানাই যাবতীয় তথ্য দিয়ে। বেটিংয়ের সঙ্গে যারা যুক্ত রয়েছে, তাদের নামও জানিয়েছি। আশা করছি, আরও ব্যক্তি ধরা পড়বে।’’ যোগ করেছেন, ‘‘কলকাতা পুলিশের কমিশনার মনোজ বর্মার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। পুলিশ পাশে না থাকলে শুধু বাংলা নয়, ভারতীয় ফুটবল অন্ধকারেচলে যেত।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)