Advertisement
E-Paper

জিকসনের গোল দেখার জন্যই বেঁচে ফেরা দেবেনের

লাজপত নগরের হোটেলের ২০৫ নম্বর ঘরের দরজায় ছোট্ট টোকা দিতেই হাসি মুখে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্র মহিলা। কোনও জবাব না দিয়েই ফিরে গিয়ে ডেকে তুললেন ছেলেকে। বেরিয়ে এলেন অমরজিৎ সিংহর দাদা।

সুচরিতা সেন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৭ ০৩:০৫
জিকসনের বাবা দেবেন ও মা বিলাসিনী। —নিজস্ব চিত্র।

জিকসনের বাবা দেবেন ও মা বিলাসিনী। —নিজস্ব চিত্র।

বিছানায় শুয়ে মধ্য বয়সের এক ভদ্রলোক। চোখ স্থির আটকে টিভির পর্দায়। সাংবাদিক দেখে উঠে বসতে বেশ সময় নিলেন।

তিনি দেবেন সিংহ। বিশ্বকাপের প্রথম গোলদাতা জিকসনের বাবা। পাশে বসা স্ত্রী হাত ধরে বসিয়ে দিলেন। এত কিছুর পরেও টিভির পর্দা থেকে চোখ সরে না সেই মানুষটির। ভারত-কলম্বিয়া ম্যাচের পুনঃসম্প্রচার চলছে। আর তখনই সেই কর্নার, লাফিয়ে হেড জিকসনের। গোওওওওওওল... প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরেও বিছানায় বসেই লাফিয়ে ওঠেন জিকসনের মা বিলাসীনি। তখনও টিভির পর্দায় স্থির বাবার চোখ চিকচিক করে ওঠে। সবার অজান্তে মুছেও নেন সেই আনন্দাশ্রু।

আরও পড়ুন
কর্নারের ঠিক আগেই প্ল্যান বদলেছিলাম আমরা: জিকসন

লাজপত নগরের হোটেলের ২০৫ নম্বর ঘরের দরজায় ছোট্ট টোকা দিতেই হাসি মুখে বেরিয়ে এসেছিলেন এক ভদ্রমহিলা। কোনও জবাব না দিয়েই ফিরে গিয়ে ডেকে তুলেছিলেন ছেলেকে। বেরিয়ে এসেছিলেন অমরজিৎ সিংহের দাদা। জানা গেল, অমরজিৎ এবং জিকসনের বাবা-মা কেউই মণিপুরী ছাড়া অন্য কোনও ভাষা বলতে পারেন না। তাই ভরসা উমাকান্তই (অমরজিতের দাদা)।

পাশাপাশি ঘরেই রয়েছে অমরজিৎ আর জিকসনের পরিবার। ওরা আত্মীয়ও বটে। মণিপুরের গ্রামেও ওদের পাশাপাশি বাড়ি। জিকসনের বাবার কাছেই দু’জনের প্রথম ফুটবল পাঠ। তাই হয়তো মনের কথা ভাষায় প্রকাশ করতে না পেরে চোখটা ছল ছল করে ওঠে দেবেন সিংহের। এক সময় তো নিজেই দাঁড়াতেন গোলের নীচে। তখন পুলিশে চাকরি করতেন। ভেবেছিলেন নিজের তো বড় ফুটবলার হওয়া হল না, কিন্তু ছেলেদের জন্য উজাড় করে দেবেন মাঠে।

সব ভেস্তে দিল ব্রেনস্ট্রোক। জীবন যুদ্ধে হয়তো জিতে গিয়েছেন, শুধু ছেলেকে বিশ্বকাপের মঞ্চে বিশ্বমানের গোল করতে দেখবেন বলেই! অসুস্থ শরীরে ছুটে এসেছেন সুদূর মণিপুর থেকে। ঠিক মতো কথা বলতে পারেন না এখনও। কথা জড়িয়ে যায়। বুজে আসে গলা কিছুটা আবেগে আর কিছুটা মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণায়। গর্বে নিশ্চই বুকটা ভরে ওঠে! বোঝাতে পারেন না সে কথা।

গোলের পর জিকসনকে ঘিরে দলের উচ্ছ্বাস। ছবি: এআইএফএফ।

উমাকান্তের মাধ্যমেই চলে কথা। দেবেন সিংহ বললেন, ‘‘আমিই তো ওদের ফুটবল শিখিয়েছি। সেই ছোটবেলা থেকে।’’ কিন্তু একটা সময় জিকসনের বাবা চাননি ছেলে ফুটবল খেলুক। খেলতে না দেওয়ায় দু’দিন খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল জিকসন। তার পরে বাধ্য হয়েই অনুমতি দিতে হয় ছেলেকে। বাবা ভেবেছিলেন ছেলে আইএএস অফিসার হবে। তাই পড়াশোনায় মন দিতে বলেছিলেন। কিন্তু, ছেলে ফুটবল ছাড়া আর কিছুই বুঝত না। জিকসনের মা বিলাসিনী দেবী বলছিলেন, ‘‘ক্লাসে প্রথম হত জিকসন। আর অমরজিৎ দ্বিতীয় বা তৃতীয়। একই স্কুলে পড়ত দু’জনে। বাড়ির সামনের ছোট্ট মাঠে সারা দিন খেলত। খেতেও ভুলে যেত। সেই চার বছর বয়স থেকে খেলার শুরু।’’

আরও খবর
‘সুযোগ পেলে ওরা সবাইকে ছাপিয়ে যাবে’

থৌবাল জেলার হাওখা মামাং গ্রামের যে বাড়ি ঘিরে আজ উৎসব সারা দেশ জুড়ে সেই বাড়িটাই অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল দু’বছর আগে। জিকসনের বাবার যখন স্ট্রোক হয়! সব দায়িত্ব এসে পড়ে বিলাসিনী দেবীর উপর। বাবা এত দিন অন্যের জমিতে চাষ করতেন। কিন্তু, এর পর সংসার চালাতে ২৫ কিলোমিটার দুরের বাজারে মণিপুরের ট্র্যাডিশনাল ড্রেস বিক্রি করতে যেতে হয় বিলাসিনী দেবীকে। কিন্তু, এত কষ্টের কথার মধ্যেও তাঁর ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা হাসিটার সঙ্গে বড্ড মিল খুঁজে পাওয়া যায় জিকসনের। টিভির পর্দায় ছেলের মুখ ভেসে উঠতেই নিজের দিকে আঙুল দিয়ে দেখান বিলাসিনী। বলেন, ‘‘আমার মতো দেখতে।’’

দিল্লির হোটেলে জিকসন ও অমরজিতের পরিবার।—নিজস্ব চিত্র।

বৃষ্টির মধ্যে মাথায় প্লাস্টিক বেঁধে কাদা মাঠে নেমে পড়ত জিকসন আর অমরজিৎ। ২০১০ সালে চণ্ডীগড় অ্যাকাডেমিতে চলে আসে দু’জনেই। সেখান থেকেই ২০১৫ সালে অনূর্ধ্ব-১৭ দলে যোগ দেয় অমরজিৎ। কিন্তু বাতিল হয়ে যায় জিকসন। বিলাসিনী বলেন, ‘‘ও খুব হতাশ ছিল। তার পরই বাড়ি ফিরে আসে জিকসন। ওর উচ্চতা দেখে সেই সময়ের কোচ ভেবেছিল ওর বয়স বেশি তাই ওকে নেয়নি। বাড়ি ফিরে জিকসন জানিয়েছিল ও এতটাই হতাশ ছিল যে মনে হয়েছিল প্লেন থেকে লাফিয়ে পড়ে মরে যাবে।’’ কিন্তু যার শেষ ভাল, তার যে সব ভাল। আরও এক বার তার প্রমাণ মিলল। গত মার্চে জিকসনকে বেছে নেন বর্তমান কোচ মাতোস। আর সুযোগ পেয়েই নিকোলাই অ্যাডামকে ভুল প্রমাণ করে দিল ১৬ বছরের এই মিডিও। নিকোলাই নিশ্চই দেখছেন।

দিল্লিতে এলেও ছেলেদের সঙ্গে একবারই দেখা হয়েছে। গ্রুপের শেষ ম্যাচের আগের দিন দেখা করানোর কথা রয়েছে। তবুও ছেলেদের অপেক্ষায় জ্বল জ্বল করে দুই মণিপুরী দম্পতির চোখ। কবে ফিরবে ওরা বাড়িতে? ওরাও জানে না। তবুও অপেক্ষায় থাকা। জিকসনের মা ছেলের পছন্দের জিনিস রান্না করবেন।

আর অমরজিতের পুরো পরিবার ছেলে ফেরার আগে সন্ত্রস্ত হয়ে যায়। ময়লা-অগোছালো ঘর একদম না-পসন্দ ভারত অধিনায়কের। তাই অমরজিৎ বাড়ি ফেরার খবর হলেই সব টিপটপ করে ফেলা হয়। অমরজিতের দাদা বলছিলেন, ‘‘ও আসার আগে আমি আর বাবা মিলে ঘর রং করি। সব ঠিকঠাক করে রাখি। ওর জন্যই গত বছর টিভি কেনা হয়েছে। এলে খেলা দেখতে পারে না বলে। কিন্তু, কেবলে টাকা ভরা হয় যখন ও আসে। না হলে পড়েই থাকে। ক্ষমতা নেই আমাদের।’’

ভয়ঙ্কর দৈন্যের মধ্যেও স্বপ্ন দেখে ওই মানুষগুলো। ছেলেদের বিশ্ব মঞ্চে বার বার ফিরে দেখার স্বপ্ন। ছেলেরাও চায় ফুটবল খেলেই বাবা-মাকে সব কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে। তার জন্য আর কিছুটা অপেক্ষা। বিশ্বমঞ্চে দাপিয়ে খেলা ছেলের দল সাফল্যের সিঁড়ি নিজেরাই তৈরি করবে। গানটাও নাকি ভাল গায় জিকসন। ‘‘ফুটবল না খেললে গায়ক হত’’—মজা করে বলেন উমাকান্ত। তাঁর আরও সংযোজন, ‘‘অমরজিৎ কিন্তু সব সময়েই চুপচাপ। একদম উল্টো। কিন্তু ওদের দারুণ বন্ধু্ত্ব।’’

বিশ্বকাপের মঞ্চে অধিনায়ক অমরজিৎ। ছবি: এআইএফএফ।

দিল্লি পর্ব সেরে এই বাবা-মায়েরা ফিরবেন সেই চেনা জীবনে। যার পরতে পরতে শুধুই জীবন যুদ্ধ। বেঁচে থাকার লড়াই। বিলাসিনী দেবী আবার যাবেন ২৫ কিলোমিটার দূরের বাজারে জামাকাপড় বিক্রি করতে। অমরজিতের পরিবার মন দেবে চাষবাস আর মাছ বিক্রিতে। ছেলেরা ডুবে থাকবে ফুটবলে। নতুন দিনের স্বপ্নে হয়তো কেটে যাবে আরও কয়েকটা বছর।

শুধু ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে লেখা থাকবে কয়েকটি নাম। তার মধ্যে অবশ্যই থাকবে অমরজিৎ ও জিকসন।

Football U-17 World Cup FIFA Amarjit Kiyam Jeakson অমরজিৎ কিয়াম জিকসন
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy