Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Al-Qaeda

‘গোঁড়া’ সুফিয়ানের পাতালঘর দেখে হতভম্ব প্রতিবেশীরাও

পড়শিদের কপালে অবিশ্বাসের কুঞ্চন ছিল— পাড়ার ছাপোষা দর্জি আবার কখনও আল কায়দা হয়!  

আবু সুফিয়ানের বাড়ির সেই ‘সুড়ঙ্গ’। রানিনগরের কালীনগরে। ছবি: সাফিউল্লা ইসলাম

আবু সুফিয়ানের বাড়ির সেই ‘সুড়ঙ্গ’। রানিনগরের কালীনগরে। ছবি: সাফিউল্লা ইসলাম

সুজাউদ্দিন বিশ্বাস
রানিনগর  শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৪:১২
Share: Save:

টিমটিমে আলোর দর্জির দোকানে মাথা গুঁজে কাজ আর নিয়ম করে পাঁচ ওয়ক্তের নমাজ পড়া আবু সুফিয়ানকে এনআইএ পাকড়াও করায় পড়শিদের কপালে অবিশ্বাসের কুঞ্চন ছিল— পাড়ার ছাপোষা দর্জি আবার কখনও আল কায়দা হয়!

রবিবার তার ঘরের মেঝেয় সুড়ঙ্গের মতো এক গর্তের খোঁজ মেলায় সেই অবিশ্বাস রাতারাতি উড়ে গিয়ে পাড়া-পড়শির মনে এখন দানা বেঁধেছে চাপা সন্দেহ। রানিনগরে তার আটপৌরে বাড়ির আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জটলায় কান পাতলে উঠে আসছে একটাই প্রশ্ন— ‘তলে তলে এত কিছু? জানতাম না তো!’
রবিবার, এনআইএ সূত্রে সুফিয়ানের পাতাল-ঘরের রহস্য ফাঁস হয়ে যেতেই গ্রামের মাঝবয়সি মহিলা থেকে উঠতি যুবা— সকলের ভিড় লেগে যায় কালীনগর গ্রামের ওই আপাত-নিরীহ দর্জির বাড়ির সামনে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, জানলাহীন, পুরু লোহার দরজার আড়ালে সুফিয়ানের ওই ‘ব্যক্তিগত চেম্বার’ আদতে অস্ত্র লুকিয়ে রাখার জন্য তৈরি। এনআইএ-র দাবি, ৮ ফুট বাই ১২ ফুট এবং ফুট আটেক গভীর ওই গর্ত থেকেই বিস্ফোরক তৈরির মশলা ও সরঞ্জাম, আগ্নেয়াস্ত্র, বিদ্যুৎবাহী তার— নানা কিছু উদ্ধার করেছে তারা।
রবিবার দুপুরে সেই ঘরে উঁকি দিয়ে দেখা গেল, গর্তের মধ্যে সটান নেমে গিয়েছে বাঁশের সিঁড়ি। গোয়েন্দারা বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যাওয়ার পরেও সেই গভীর গর্তে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র তার, সুইচ বক্স, বিভিন্ন যন্ত্র। গর্তটি যে লোহার চাদর দিয়ে ঢাকা থাকত, সেটি দেওয়ালে ঠেস দেওয়া। ফুট বারো দৈর্ঘ্যের সেই ঘরে একটিও জানলা নেই। তবে রয়েছে নিচু মাপের একটু পুরু লোহার দরজা। এমন অজ গাঁয়ে নিতান্ত দর্জির বাড়ির একটি ঘরে দরজা অত মজবুত করার প্রয়োজন পড়ল কেন? সে ঘরে পা রেখেছি দেখেই তড়িঘড়ি এগিয়ে আসেন সুফিয়ানের স্ত্রী নুরুন্নেসা। সটান জানিয়ে দেন, ‘‘অত কথায় কাম নেই, ঘর থেকে বের হন দেখি।’’ সুফিয়ানের পরিবারের অন্যদের দাবি, শৌচালয়ের চেম্বার করতেই ওই গর্ত খোঁড়া হচ্ছিল। কিন্তু তা ঘরের মধ্যে কেন? উত্তর এল, ‘‘আপনাদের এত প্রশ্ন থাকে কেন?’’

কালীনগর গ্রাম থেকে রানিনগর বাজার তেমন দূরের পথ নয়। সেখানে সুফিয়ানের এক ফালি দর্জির দোকান আপাতত বন্ধ। আশপাশের দোকানিরা জানাচ্ছেন, মাস কয়েক ধরে দোকান তেমন খুলত না সুফিয়ান। বাজারের এক পড়শি দোকানি বলছেন, ‘‘অনেক রাত পর্যন্ত দোকানে কাজ করত সুফিয়ান। কথা বলত কম। আমরা ভাবতাম, শিক্ষক বাবার ছেলে দর্জির পেশায় এসেছে তাই সবাইকে সমকক্ষ মনে করে না!’’

স্কুলে তার লেখাপড়ার দৌড় খুব বেশি দূর নয়। খারিজি মাদ্রাসায় কয়েক বছর পঠন-পাঠন তার। তবে সেই সময় থেকেই ধর্মীয় প্রথা মানার প্রশ্নে সে বরাবর অবিচল। বাজারে সুফিয়ানের পরিচিত এক দোকানি বলছেন, ‘‘খারিজি মাদ্রাসায় আমরাও পড়েছি। কিন্তু ওঁর মতো গোঁড়া মানুষ দেখিনি। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা-হইচই-ফূর্তি করতে কখনও দেখিনি।’’

এমন রসকষহীন গোঁড়া মানুষটার সঙ্গে কলেজপড়ুয়া ছেলেপুলেদের আলাপ হল কী করে? এনআইএ-র দাবি, কম্পিউটার সায়েন্স পড়ুয়া নাজিমুস, বসন্তপুরের এমএ পাশ করা লিউইয়ন আহমেদ কিংবা বিএলএড পাশ করা আতিউরের সঙ্গে সুফিয়ানের যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল বেশ কিছু দিন ধরেই।
কালীনগর থেকে লিউইয়ন বা নাজিমুসের গ্রাম গঙ্গাদাসপুর প্রায় তেরো কিলোমিটার রাস্তা। তবে, গোয়েন্দাদের দাবি, ইলেকট্রিকের কাজ জানার সূত্রেই লিউইয়নের সঙ্গে সুফিয়ানের যোগাযোগ। গ্রামে তাদের আনাগোনা তেমন না-থাকলেও, রানিনগর বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে ‘অচেনা’ লোকের সঙ্গে সুফিয়ানের কথাবার্তা নজর এড়ায়নি অনেকেরই। কিন্তু তারা কারা, সে প্রশ্ন অজানাই থেকে গিয়েছে। উত্তরহীন, তবু প্রশ্নটা থেকেই গেছে কালীনগরের— ছাপোষা দর্জির কাজের আড়ালে অন্য কোনও সঙ্গে কি পা পড়েছিল সুফিয়ানের!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Al-Qaeda Arrest, Terrorist Tunnel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE