আমার রাতের ঘুম তো মাথায় উঠেইছে। কিন্তু সারাজীবনের সঙ্গী পাশের মানুষটির কথা ভেবে চোখের পাতা এক করতে পারছি না। আট রাত পার হয়ে গেল, ঘরে আলো-পাখা কিচ্ছু নেই, আমরা কি কলকাতা শহরের বাসিন্দা, বিল মিটিয়ে বিদ্যুতের পরিষেবা পাই, ভাবতে নিজেরই সন্দেহ হচ্ছে।
আর সাড়ে সর্বনাশ বোধহয় একেই বলে। করোনার ভয়, লকডাউন, আমপান ছাড়াও আমার স্বামী রবীন্দ্রকুমার দে-র হঠাৎ ডান দিকটা পড়ে গেল ঝড়ের পাঁচ দিন আগে। প্রায় ৮০ ছুঁই ছুঁই বয়স মানুষটার। এই দুঃসময়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াও তো ভয়ের। ভাগ্যিস আমার ভাই ছিলেন। ফোনে নেট ঘেঁটে অনলাইন ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করলেন। তখনই জানা গেল, ছোটখাট স্ট্রোক হয়েছে। এখন নেটের যা দশা! ফোনে চার্জ দিতে কাছে হাজারিপাড়ায় আমাদের পরিচারিকার বাড়িতে যাচ্ছি। আর ক’টা দিন বাদে অঘটনটা ঘটলে যে কী হত ভাবলে শিউরে উঠছি। বয়স্ক মানুষটা সারা দিন নিস্তেজ হয়ে খাটে শুয়ে কষ্টে গরমে গোঙাচ্ছেন। বাথরুম অবধি যেতেও হিমশিম। কোনওমতে দুপুরে খাটের পাশের টেবিলটায় বসিয়ে একটু ভাত খাইয়ে দিই।
দুধটা, মাছটা অবশ্য ফ্রিজ খালি করে কাছের প্রতিবেশীর বাড়িতে রেখেছি। এই মহেশতলায় পুর এলাকায় পাম্প না-চললে কলে জল থাকা অসম্ভব। আমার ভগ্নিপতি ৮৩ বছর বয়সে পাশের বাড়িতে উঠোনের টাইমের কল থেকে ৭-৮ বালতি জল তুলছেন। ৭০ বছর বয়সে আমার দ্বারা তা হত না। আমাদের দুই ছেলে লকডাউনের পর থেকে বাড়িতে থাকায় কিছুটা স্বস্তি! কিন্তু রোজকার রান্না তো করতেই হচ্ছে। এই সঙ্কটে ফ্রিজ ব্যাপারটাই যেন পরিত্যক্ত আলমারি। স্রেফ ঘরের শোভাবর্ধন করছে। খুব কষ্ট হচ্ছে, আমাদের সন্তানসম পোষ্য কুকুর কানঝোলার জন্যও। গরমে ঘর-বন্দি দশায় বেচারি অবলা প্রাণী ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে।
আরও পড়ুন: বাড়ি মেরামতে ২০ হাজার টাকা, তৈরি ২ টাস্কফোর্স
মহেশতলা জুড়েই সঙ্গীন দশা! সাত নম্বর পুরওয়ার্ডে রবীন্দ্রনগর বি-১ ব্লকের মুখটায় ১৪/১৮ আর ১৪/১৯ ল্যাম্পপোস্টের মাঝের ১৩-১৪টি পরিবার মনে হচ্ছে, এ দেশের বাইরে। কাছে এক বিদ্যুৎ-কর্তার বাড়িতেও ঝড়ের পর দিনই আলো চলে এল। আশপাশের কয়েকটা পাড়া শুনেছি, মারামারি করে সিইএসসি-র লোকজন ছিনিয়ে কাজ করল। এই বয়সে আমি তা কী করে পারব! আমার ভাই চন্দন দত্ত, পাশের বাড়ির কলেজশিক্ষক সুকান্ত দত্তেরা সরকারের মাথাদের ই-মেল করেছিলেন! কই কিছু তো হল না! এর মধ্যেই পাড়ায় ধৃতিমান বলে একটি অল্পবয়সি ছেলেকে শুনলাম থানায় খুব খারাপ কথা বলেছে। পাড়ার গুটিকয়েক কমবয়সী মেয়ে-বৌ বার বার থানায় গিয়ে বলার চেষ্টা করছে, শুনেছি লোকাল এক নেতা ওদের সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করেছে, যেন আমরা খুব মজাদার অবস্থায় আছি। আমার স্বামীর করুণ দশা, আশপাশেও বয়স্ক, অসুস্থ অনেকেই আছেন! এটা কি সভ্য দেশ? কারও কোনও হেলদোল নেই।
আরও পড়ুন: আমপানের ক্ষত মেলায়নি, ফের বৃষ্টির সতর্কতা সুন্দরবনে, বইবে ঝোড়ো হাওয়াও
আজ শুনেছি, পাড়ার মেয়েদের বলা হয়েছে, লাইন সারানোর জন্য বাড়তি টাকা দিতে হবে। এর আগে নিজেরা কয়েকশো টাকা তুলে গলির গাছ পরিষ্কার করিয়েছি। বিদ্যুৎ ফেরানোর জন্যও হয়তো এটা মেনে নিতে হবে। কবে আলো ফিরবে, তা এখনও জানি না!
(মহেশতলার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে রবীন্দ্রনগর বি-১ ব্লকের বাসিন্দা)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy