Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
State News

বিপদ জেনেও পেটের দায়ে নিরুপায় ওঁরা

দোকানের মালিকের নাম তাজউদ্দিন। বছর ছয়েক ধরে দাদা শেখ সালেমের সঙ্গে যৌথ ভাবে ই-বর্জ্যের ব্যবসা করেন। বাতিল ল্যাপটপ-ডেস্কটপ, টেলিভিশন সেট ভেঙে, পুড়িয়ে ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রাংশ উদ্ধার করার কাজে বছরভর ব্যস্ত থাকে তাজউদ্দিনের গোটা পরিবার।

অরক্ষিত: কোনও সুরক্ষা ছাড়াই এ ভাবে ভাঙা হয় পুরনো কম্পিউটার। দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। —নিজস্ব চিত্র

অরক্ষিত: কোনও সুরক্ষা ছাড়াই এ ভাবে ভাঙা হয় পুরনো কম্পিউটার। দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। —নিজস্ব চিত্র

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৮ ০২:৩২
Share: Save:

গ্রামের নতুন পাকা রাস্তার পাশে একের পর এক দোকান। থরে থরে সাজানো ল্যাপটপ-ডেস্কটপ। তবে নতুন নয়। সবই বাতিল। আশপাশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের ভাঙা টুকরো। দোকানের কাছে গেলেই নাকে আসছে কটু গন্ধ। দোকানের বাইরে ও ভিতরে প্লাস্টিকের গুঁড়োর আস্তরণ।

গাড়ি থেকে নামতে দেখে দোকানে বসা এক জন চোখের ইশারায় জানতে চাইলেন, আগমনের হেতুটা কী? জিজ্ঞাসা করলাম, এত পুরনো জিনিস সাজিয়ে রেখেছেন, কিনবে কে?
উত্তর এল, ‘‘কেউ কিনবে না। আমিই কিনি। আমিই ভাঙি। গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে ফেলি। তার পরে লরিতে তুলে পাঠিয়ে দিই। এগুলো ভাঙার জন্যই রাখা আছে।’’

দোকানের মালিকের নাম তাজউদ্দিন। বছর ছয়েক ধরে দাদা শেখ সালেমের সঙ্গে যৌথ ভাবে ই-বর্জ্যের ব্যবসা করেন। বাতিল ল্যাপটপ-ডেস্কটপ, টেলিভিশন সেট ভেঙে, পুড়িয়ে ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রাংশ উদ্ধার করার কাজে বছরভর ব্যস্ত থাকে তাজউদ্দিনের গোটা পরিবার। তিনি বললেন, ‘‘শুধু দাদা আর আমিই নই। স্ত্রী ও সন্তানেরাও ভাঙাচোরার কাজে হাত লাগায়।’’

তাজউদ্দিনের পরিবারের মতো আরও শ’দেড়েক পরিবার একই ভাবে নিত্যদিন ই-বর্জ্যের বিষ ঘেঁটে দিন গুজরান করছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাট ও উস্তি থানার সিকন্দরপুর, টেকপাঁজা, গাববেড়িয়া, সংগ্রামপুর গ্রামের প্রায় সকলেই এই কাজে যুক্ত। কলকাতা ও শহরতলির ই-বর্জ্য নিয়ে গিয়ে ওই সব গ্রামে বিক্রি করছেন ফেরিওয়ালারা। তাজউদ্দিনরা হাতুড়ি দিয়ে ল্যাপটপ-ডেস্কটপ ভাঙার পাশাপাশি গ্যাস কাটার দিয়ে ধাতব ও প্লাস্টিক আলাদা করে ফেলছেন। তার পরে তা পৌঁছে যাচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন প্লাস্টিক কারখানায়।

দু’পা এগোতেই দেখা গেল, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে কাজ করছেন জারিনা বিবি, রশিদা খাতুন, মিনা বিবিরা। মায়েদের কাজে হাত লাগিয়েছে খুদেরাও। কারও হাতেই দস্তানা নেই। নেই মুখোশও। প্লাস্টিক ও ধাতু গলানোর ধোঁয়ায় কষ্ট হয় না? জারিনার কথায়, ‘‘হয় না আবার! অনেক সময়ে তো কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে যায়। চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে। রাতে ঘরে ফিরলে হাত চুলকোয়। নারকেল তেল হাতে লাগাই। কিন্তু দিনে মজুরি পাই দেড়শো টাকা। সেটা না পেলে খাব কী?’’ প্রায় একই সুরে রশিদা বললেন, ‘‘ স্বামী মারা গিয়েছেন। দু’টি ছেলেমেয়ে। কোথাও কোনও কাজ নেই। কষ্ট করেই এই কাজ করি।’’

স্থানীয় ব্যবসায়ী জাকির আলি, সইফুল মণ্ডলেরা জানালেন, ফেরিওয়ালাদের থেকে কেজি প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকায় কেনা হয় ই-বর্জ্য। কেনার পরে ধাতু আর প্লাস্টিক আলাদা করা হয়। ফের তা হাতবদল হয়। এ বার কেজি প্রতি প্রায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা মুনাফায় বিকিয়ে যায়। মাসে প্রায় হাজার কেজি প্লাস্টিক বিক্রি করেন তাজউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘‘এখানে এটাই তো বড় শিল্প।’’

কিন্তু এই কাজের বিপদ জানেন?

জাকির আলি বলেন, ‘‘বিপদ হতে পারে জেনেও এই কাজ করি। কারণ, এখানে রুজি-রুটির আর কোনও উপায় নেই।’’ সায় দিলেন সইফুল, তাজউদ্দিনরা। তাঁরা জানালেন, ব্যবসায়ী ও ফেরিওয়ালা মিলিয়ে হাজার দেড়েক পরিবারের রুজি-রুটির উৎস ই-বর্জ্য। দোকানি ছাড়াও প্রায় শ’তিনেক ফেরিওয়ালা রয়েছেন এ সব গ্রামে। সাতসকালে ট্রেনে উঠে কলকাতা-সহ আশপাশের নানা জায়গায় চলে যান ওঁরা। বাড়ি ও অফিসের বাতিল বৈদ্যুতিন পণ্য কিনে নিয়ে আসেন।

তার পরে চলে ভাঙনপর্ব। দূষণ-পর্বও বটে। কিন্তু দেখে কে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

E-Waste Environment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE