ভোটবাক্সের ফায়দা তুলতে বালুরঘাট-হিলির মতোই বুনিয়াদপুর-কালিয়াগঞ্জের রেল প্রকল্পও ফের ‘জীবন্ত’ হয়ে উঠছে।
মাটির দেওয়ালে ঘুঁটে দিচ্ছিলেন এক বৃদ্ধ। মেঠো পথে ধুলো উড়িয়ে গ্রামে গাড়ি ঢুকতে দেখে কোনও রকমে গামছায় হাত মুছেই রাস্তার এক পাশে সটান দাঁড়িয়ে পড়লেন। আরও কাছে গাড়ি আসতে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে একবার থমকালেন। তার পরই ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে বললেন, “ও বাবু জমি মাপতে এসছেন নাকি?”
আগন্তুকের পরিচয় জানার আগেই যিনি এই প্রশ্ন করলেন, তিনি বাংলাদেশ লাগোয়া দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি ব্লকের শ্যামপুর গ্রামের বাসিন্দা হরিপদ ঘোষ। তাঁর মুখ থেকেই জানা গেল, প্রতিবার ভোটের সময় এই গ্রামে ‘সরকারিগাড়ি’ আসা-যাওয়া করে। তা সে বিধানসভাই হোক বা পঞ্চায়েত অথবা লোকসভা। এ বার মাস দুয়েক আগে থেকেই নাকি ঘন ঘন গাড়ি ঢুকছে হিলি ব্লকের বিনশিরা, জামালপুর, ধলপাড়া, পানজুল-সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকার সময় গ্রামের বাসিন্দাদের আশ্বাস দেওয়া হয়— ন্যায্যমূল্য দিয়ে জমি অধিগ্রহণের পর বালুরঘাট-হিলি রেললাইন প্রকল্প শুরু হবে। বাসিন্দাদের দাবি, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটেও সেই একই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে ভোটারদের। বিজেপির দাবি, আমরা ক্ষমতায় এলে প্রকল্প বাস্তব রূপ পাবে। তৃণমূল বলছে, কেন্দ্র থেকে বিজেপি সরলে আর কোনও বাধা থাকবে না। কেন্দ্রের উদাসীনতার জন্যে এই অবস্থা। প্রকল্পের জন্যে তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী সাংসদ অর্পিতা ঘোষকে ভোট দিয়ে মমতার হাত শক্ত করতে হবে। ভোটারদের কাছে টানতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আরএসপি-ও। ভোটবাক্সের ফায়দা তুলতে বালুরঘাট-হিলির মতোই বুনিয়াদপুর-কালিয়াগঞ্জের রেল প্রকল্পও ফের ‘জীবন্ত’ হয়ে উঠছে।
হরিপদ, গুপিন মুর্মু, পরিমল সাঁতরাদের মতো কয়েকশো গ্রামবাসীর বাড়ির চত্বরে, গোয়ালে, এমনকি চাষের জমিতে রেল মন্ত্রক কংক্রিটের খুটি পুঁতে দিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় প্রকল্পের জমি এখনও চাষিদের কাছ থেকে অধিগ্রহণই করা হয়নি। উল্টে তাঁদের বলে দেওয়া হয়েছে, এই জমির উপর দিয়েই রেললাইন পাতা হবে। তাই জমিতে কিছুই করা যাবে। ফলে গ্রামে গাড়ি ঢুকলেই সকলে ভাবেন, বোধহয় জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়ে গেল। এ বার একটা সুরাহা হবে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
প্রায় এক দশক ধরে নিজেদের জমিতে কোনও কিছুই করতে পারছেন গ্রামবাসীরা। সব গিয়েছে আটকে। জমি বেচাও যাচ্ছে না। অথচ এত কষ্ট সহ্য করলেও চালু হয়নি কোনওকাজ। হরিপদর ভাই ষষ্ঠীপদ ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, ‘‘সেই স্বাধীনতার পর থেকে দক্ষিণ দিনাজপুরের মানুষ রেল পরিষেবা নিয়ে বঞ্চিত। শুধু কি হিলি-বালুরঘাট! ও দিকে বুনিয়াদপুর-কালিয়াগঞ্জের রেললাইনের কাজও তো চালু হল না। বালুরঘাট থেকে কলকাতার ট্রেনওই একটা, গৌড় এক্সপ্রেস। এই তো সেদিন চালু হল তেভাগা। হাওড়া-বালুরঘাট এখনও সপ্তাহে সব দিন চলে না।’’
আরও পড়ুন: তৃণমূলের নেতৃত্বে হবে কেন্দ্রে সরকার: মমতা
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী বাচ্চু হাঁসদা এই অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে বলেন, “আমাদের জেলায় জনসংখ্যার তুলনায় ট্রেনের সংখ্যা সত্যিই কম। হিলি সীমান্ত দিয়ে প্রতি দিন বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ যাতায়াত করেন। ফলে আমাদের জেলার মানুষের সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টাতেই এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তা অস্বীকার করা যায় না।”
ভোট এলেই শুধু জীবন্ত হয়ে ওঠে প্রকল্পগুলো। ফলে হরিপদবাবুদের দুর্দশা যে তিমিরে ছিল, থেকে যায় সেই তিমিরেই।
আরএসপির বর্ষীয়ান নেতা, রাজ্যের প্রাক্তনমন্ত্রী বিশ্বনাথ চৌধুরীর দাবি, “তৃণমূল যতই সাফাই দিক না কেন, রাজ্যই তো জমি অধিগ্রহণ করে রেলের হাতে তুলে দেবে। জমি অধিগ্রহণই যখন হয়নি, তাহলে কেন রেল চাষিদের জমিতে খুঁটি পুঁতে দিয়ে গেল? মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি দেখবেন না!”
আরও পড়ুন: ‘আগে উত্তেজনা হত, এখন দুশ্চিন্তা হয়, হিংস্রতা কত দূর ছড়াবে!’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকার সময় রেলের মানচিত্রে জায়গা পায় ২৯ কিলোমিটারের বালুরঘাট-হিলি রেলপথ সম্প্রসারণ প্রকল্প। পরবর্তী সময়ে মুকুল রায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন রেলপথের জন্য জমি চিহ্নিতকরণের কাজ শেষ হয়েছিল। বালুরঘাট থেকে হিলি ২৯ কিলোমিটার রেলপথ সম্প্রসারণ প্রকল্পে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা প্রকল্প খরচ ধরা হয়। বুনিয়াদপুর থেকে কালিয়াগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ সম্প্রসারণে ২২১ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছিল।
কিন্তু, এ সব হিসেব খাতায়কলমেই রয়ে গিয়েছে। ভোট এলেই শুধু জীবন্ত হয়ে ওঠে প্রকল্পগুলো। ফলে হরিপদবাবুদের দুর্দশা যে তিমিরে ছিল, থেকে যায় সেই তিমিরেই।
—নিজস্ব চিত্র।
(পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেবাংলায় খবরজানতে পড়ুন আমাদেররাজ্যবিভাগ।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy